Published in ভোরের কাগজ on Monday 29 June 2020
ব্যাংকিং কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে
ব্যাংকে সংকটের প্রতিফলন নেই প্রস্তাবিত বাজেটে
বিপুল খেলাপি ঋণ ও শৃঙ্খলার অভাবে ব্যাংক খাত সরকারের যে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে, তা থেকে উত্তরণের স্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই প্রস্তাবিত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে। মাত্র তিন মাস আগে ব্যাংকিং খাতে যে কমিশন গঠনের কথা বলা হলো সরকারের পক্ষ থেকে সে বিষয়েও অর্থমন্ত্রীর কোনো প্রতিশ্রুতি দেখা যায়নি। তবে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকার বড় অঙ্কের ঋণ নেবে এমন পরিকল্পনার কথাই তুলে ধরেছেন তিনি। ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা সরকার একাই ঋণ নিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি তলানিতে ঠেকবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু বিষয়টি মানতে নারাজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। বাজেট ঘোষণার পরদিন অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর জানালেন, দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে, কোনো সংকট নেই। ফলে বাজেটে ব্যাংক খাত থেকে বাড়তি ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে যে শঙ্কা অনেকেই প্রকাশ করছেন, সেই শঙ্কার কারণ নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা, আর ২০১২ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২ লাখ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি থেকে বাদ পড়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রকৃত খেলাপি ঋণ কয়েক গুণ বেশি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও এসব
ধরে খেলাপি ঋণ হিসাব করার পক্ষে। আবার ডিসেম্বর শেষে দেশের ১৫ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের ওপরে। অনিয়ম-জালিয়াতি সামলাতে ১৫ ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, নতুন ব্যাংকের বেশি পরিচালন ব্যয়, সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ দেয়া, সরকারি ব্যাংকের পর্ষদের দুর্বলতা, মূলধন ঘাটতি প্রভৃতি কারণকে সামনে এনে বিশেষজ্ঞরা ব্যাংক খাত সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে আসছেন গত ১০ বছর ধরে। অবস্থা সংকটজনক থাকলেও রহস্যজনক কারণে সরকার ব্যাংক খাত সংস্কারের প্রয়োজন বোধ করেনি। অর্থাৎ এ খাত সংস্কারে কমিশন গঠনের বিষয়টি বারবার এড়িয়ে গেছে সরকার। সর্বশেষ গত মার্চে ব্যাংকিং খাতে একটি কমিশন গঠনের উদ্যোগের কথা জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। কিন্তু তিন মাস পর যে বাজেট প্রস্তাব অর্থমন্ত্রী দিলেন তাতে এমন কমিশন গঠনের প্রতিশ্রুতি দেখা যায়নি।
এর আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় প্রথম বলেছিলেন, ব্যাংক খাতের কার্যক্রম মূল্যায়নে তিনি একটি কমিশন গঠন করতে চান। মুহিতের যুক্তি ছিল, ব্যাংক খাতের উল্লেখযোগ্য প্রসার হয়েছে। এখন প্রয়োজন এই খাতের সঞ্চয়ন, সুষ্ঠু নীতিমালা ও প্রবৃদ্ধির ধারা নির্ধারণ। মুহিতের ভাষায়, ‘ব্যাংক খাতের প্রচলিত কার্যক্রম এবং এ খাতের সার্বিক অবস্থান মূল্যায়ন ও বিবেচনা করার জন্য একটি কমিশন গঠনের চিন্তাভাবনা আমাদের রয়েছে।’ এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত প্রতিটি বাজেট বক্তব্যেই মুহিত ব্যাংক কমিশন গঠনের পক্ষে কথা বলে গেছেন। কিন্তু সেটা আর হয়নি। অর্থমন্ত্রী হয়ে আ হ ম মুস্তফা কামালও ঘোষণা দেন, ব্যাংক খাত নিয়ে একটি টাস্কফোর্স গঠনের চিন্তা রয়েছে তাঁর। মাঝখানে কমিশনের পরিবর্তে কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংস্কারের উদ্যোগও নিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান বলেন, দুর্দশায় থাকা ব্যাংক খাত নিয়ে যতটা মনোযোগ দেয়া উচিত ছিল, বাজেটে তা দেয়া হয়নি।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকিং খাতে চোখে পড়ার মতো যা ছিল তা হলো উচ্চ মাত্রায় সরকারের ব্যাংক ঋণ। দেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেবে সরকার একাই। এর বাইরে সরকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ১ লাখ ৩ হাজার ১১৭ কোটি টাকা ঋণ নেবে ব্যাংকিং খাত থেকে। প্রশ্ন উঠছে পর্যাপ্ত অর্থ দেয়ার সক্ষমতা আছে কিনা ব্যাংকগুলোর? যদি সরকার চাহিদামাফিক ঋণ না নিতে পারে তা হলে তার খরচ জোগাতে পারবে না। বেসরকারি খাত ঋণ না পেলে বিনিয়োগ বাড়বে না। বিনিয়োগ না বাড়লে কর্মসংস্থান হবে না। ফলে করোনার কারণে যেসব মানুষ কাজ হারিয়েছেন তারা কাজের সুযোগ পাবেন না। আবার প্রণোদনার অর্থ দেয়া না হলে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হবে। ব্যাংক যদি এসব অর্থ দিতে না পারে তা হলে কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি হবে না। অর্থাৎ ত্রিমুখী চাপের মধ্যে পড়েছে ব্যাংকগুলো।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ভোরের কাগজকে বলেন, বিশাল ঘাটতি পূরণে ব্যাংক ঋণ নেয়া হবে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। প্রণোদনার অর্থ দেবে ব্যাংক খাত। নতুন বছরের বাজেটে এই বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা দ্বিগুণ ধরা হয়েছে। সুতরাং ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাত বড় অঙ্কের একটা ঋণ পাবে, সেটা সংকটের মধ্যে পড়বে। বাজেটে বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে যে ব্যাংক নির্ভরতা, এটি বাস্তবসম্মত নয়। কারণ ব্যাংক খাত নিজেই নানা কারণে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। করোনায় ব্যাংকের সংকটও বাড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো প্রকট হয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে সব খাতে অর্থ সরবারহ বাধাগ্রস্ত হবে। অর্থায়নের জন্য ব্যাংকের বাইরে বিকল্প উৎসের ওপর নির্ভরশীলতার সুযোগ ছিল।
তবে বাজেট প্রস্তাবের পরদিন অর্থমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির জানালেন, বাজেটে ঘাটতি পূরণে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ চলতি অর্থবছরে ইতোমধ্যে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৭৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। কোনো সমস্যা হয়নি। চলতি অর্থবছর ৮২ হাজার কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে। এতেও সমস্যা হবে না। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি নগদ তারল্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। এ ছাড়া রিজার্ভ রয়েছে ৬২ হাজার কোটি টাকা। ফলে ব্যাংক খাতের তারল্য সমস্যা নেই। ঋণ নিলে এ খাতের কোনো সমস্যা হবে না। সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা বাস্তবায়নেও কোনো সমস্যা হবে না বলেও জানান গভর্নর।