Originally posted in সমকাল on 12 November 2023
শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২-এর তথ্য
কর্মক্ষেত্রে শব্দ-ধুলোয় বিপর্যস্ত ৩২ শতাংশ শ্রমিক
অর্থনীতিবিদরা জানান, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে শিল্পের অবদান বাড়লেও সেভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। ফলে অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। সরকারি নজরদারি না থাকায় এ খাতে কর্মপরিবেশ খারাপ। দীর্ঘ সময় ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করার ফলে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যহানি থেকে শুরু করে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সাম্প্রতিককালে প্রবৃদ্ধি অর্জনে শিল্পের অবদান বাড়লেও তা পুঁজিঘন শিল্পের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের মাধ্যমে হয়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে যথেষ্ট কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়ায় অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে। আর অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মপরিবেশ অবধারিতভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হবে। কারণ এখানে মজুরি কম, উৎপাদনশীলতা কম এবং সরকারি কোনো নজরদারি নেই। ঝুঁকিপূর্ণ কর্মসংস্থানের ভেতরে অনেক শিশুশ্রমও আছে। এটিও একটি বড় চিন্তার বিষয়। এখানে নজর দেয়া উচিত।’
দেশের বিভিন্ন খাতে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছেন শ্রমিকদের একটি বড় অংশ। ২০২২ সালে দেশে কর্মরত ছিলেন ৭ কোটি ৪ লাখ শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৩২ শতাংশ শ্রমিক ধুলো, শব্দ ও কম্পনের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কর্মরত ছিলেন। আর তীব্র ঠাণ্ডা এবং গরমের মধ্যে কাজ করেছেন ৩০ শতাংশ। এমন পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে প্রায় ২৪ লাখ ১০ হাজার শ্রমিক দুর্ঘটনায় পড়েছেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ-২০২২-এ এমন চিত্র উঠে এসেছে।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দীর্ঘ সময় উচ্চশব্দ কিংবা ধুলোবালিতে কাজ করলে নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ বিষয়ে হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘দীর্ঘ সময় উচ্চশব্দের মধ্যে কাজ করলে শ্রবণশক্তি কমে যায়। এমনকি বধির হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। আবার উচ্চশব্দে মস্তিষ্কে এক ধরনের বিরক্তি তৈরি হয়, যা ব্যক্তির আচরণকে রুক্ষ করে তোলে।’ এ ধরনের কর্মপরিবেশে নিদ্রাহীনতা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগের তীব্র ঝুঁকি রয়েছে বলে জানান এ জনস্বাস্থ্যবিদ।
বিবিএসের তথ্যমতে, ঝুঁকিপূর্ণ খাতে কর্মরত শ্রমিকদের সাড়ে ১৬ শতাংশ বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ যন্ত্রের সঙ্গে কাজ করেন। প্রায় ৭ শতাংশ শ্রমিক রাসায়নিক বিস্ফোরক দ্রব্যের সঙ্গে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। আগুন ও গ্যাসযুক্ত পরিবেশে কাজ করেন ৫ দশমিক ৪ শতাংশ শ্রমিক। আর তাদের প্রায় ৪ শতাংশ মাটির নিচে বা অধিক উচ্চতায় কর্মরত আছেন। দেশে ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকদের প্রায় ৮৭ শতাংশ পুরুষ ও বাকি ১২ শতাংশ নারী।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কান্ট্রি ডিরেক্টর টুওমো পোটিআইনেন বণিক বার্তাকে জানান, ফুটওয়্যার, জাহাজ ভাঙা, নির্মাণ খাত, মৎস্য ও কৃষিসহ রাস্তায় যারা কাজ করছেন, তারা অনেকে যথাযথ নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করছেন। যথাযথ প্রশিক্ষণ ছাড়া যন্ত্রের সঙ্গে কাজ করাটাও ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা তৈরি এবং যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগেও কাজ করা যায়। শ্রমিকের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, মাতৃত্ব এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে সব খাতে ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।
জরিপ বলছে, ২০২২ সালে জাতীয় পর্যায়ে মোট শ্রমিকের প্রায় সাড়ে ৩ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৬২ শতাংশ শ্রমিক কমপক্ষে একবার, ২৫ শতাংশ দুইবার এবং ৮ শতাংশ শ্রমিক তিনবার দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এক বছরে প্রায় ২ শতাংশ শ্রমিক ৫-৯ বার পর্যন্ত দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন।
তবে উদ্যোক্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, বর্তমানে দেশে কর্মপরিবেশ আগের তুলনায় অনেক উন্নত হয়েছে। বিশেষ করে পোশাক খাতে ভারত, চীন এমনকি ভিয়েতনামের চেয়ে কর্মপরিবেশ অনেক ভালো। বাংলাদেশ চেম্বারের সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরী বলেন, ‘ক্রেতারা কর্মপরিবেশ নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। কমপ্লায়েন্স না মানলে এখন অর্ডার পাওয়া যায় না। তাই আন্তর্জাতিক সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কারখানা পরিচালনা করা হয়। আর কর্মপরিবেশ উন্নতির জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করতে হয়।’
ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত থেকে আহত হলেও কোনো ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই বলে দাবি করছেন শ্রমিক নেতারা।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, ‘দেশে কর্মপরিবেশ নিরাপদ না এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। এমনকি অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি সব কর্মক্ষেত্রেই একটি বড় ঝুঁকি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাজ করে অনেকে নানা অসুখে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু ক্ষতিপূরণের কোনো বিধান নেই।’ দেশের সব খাতে শ্রমিকের যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিতে একটি পূর্ণাঙ্গ আইন করার দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম অনুবিভাগ অতিরিক্ত সচিব মো. তৌফিকুল আরিফ জানান, কর্মপরিবেশ উন্নত করতে প্রতিনিয়ত কাজ করছে সরকার। কলকারখানা পরিদর্শন করে বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। শোভন কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য একটি প্রকল্প চলমান। এছাড়া আইএলও ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় বিভিন্ন কারখানায় সচেতনতা তৈরির কাজও চলমান। এখন দেশে ২০২টি সবুজ কারখানা রয়েছে। ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। ভবিষ্যতে একটি স্বাস্থ্যকর এবং উন্নত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার প্রক্রিয়াটি চলমান।