Originally posted in কালের কন্ঠ on 9 February 2025
নীতি সুদহার না বাড়ার ইঙ্গিত
তীব্র অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামীকাল সোমবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিময়হারের স্থিতিশীলতা, পর্যাপ্ত রিজার্ভ সংরক্ষণ ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিকে গুরুত্ব দেওয়া হবে এবারের মুদ্রানীতিতে। জানুয়ারির মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে আসায় নীতিসুদহার আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নীতিসুদহার ওঠানামাকরণের মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে সূত্র তা আর কাজে আসছে না। নীতিসুদহার ১০ শতাংশে উঠিয়েও মূল্যস্ফীতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তাই আপাতত এই ভোঁতা হাতিয়ার সাবধানে চালাতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সরবরাহ ব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগে বাস্তবতার নিরীখে লক্ষ্য নির্ধারণ ও বিনিময়হারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। তা ছাড়া আর্থিক খাতের সংস্কারের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দিয়ে রোডম্যাপ তুলে ধরা উচিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকগুলোর তারল্যের সংকটের কারণে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের পরিবেশ ছিল না। এ জন্য এই খাতের বিনিয়োগ কমেছে।
তবে সরকারের স্থিতিশীলতায় এটি আবার বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই আগামী মুদ্রানীতি ঘোষণা করবে। আগামী মুদ্রানীতিতে নীতিসুদহার বাড়ানোর বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো বর্তা নেই। যেহেতু জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি একটু কমেছে। তাই নীতিসুদহার বাড়ানো হবে না বলে আশা করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্য সংকাচনমূলক ধরন বজায় রেখে এবং মূল্যস্ফীতি মোকাবেলাকে অগ্রাধিকার দিয়ে এমপিএস প্রণয়ন করা হচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হওয়া ড. আহসান এইচ মনসুর প্রথমবারের মতো মুদ্রানীতি ঘোষণা করবেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, মুদ্রানীতি প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভেতরের ও বাইরের অংশীজনের পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের সঙ্গে বৈঠক করছে। তারা বিভিন্ন পক্ষের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের অর্থনীতিবিদদের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে দেশের শীর্ষস্থানীয় গবেষণা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য নীতিগত পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করেছে। সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে—বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ নীতি গবেষণা ইনস্টিটিউট ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং। মুদ্রানীতি কেমন হওয়া উচিত এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের প্রধান হাতিয়ার নীতিসুদহার প্রয়োগের মাধ্যমে বাজারের অর্থের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। যেহেতু এটি কোনো ফল দিতে পারেনি। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে আর কোনো হাতিয়ারও নেই, তাই বর্তমানে প্রধান সমস্যা সরবরাহব্যবস্থার দুর্বলতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক উদ্যোগ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পক্ষগুলোকে নিয়ে সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।
২০২৩ সালের মার্চ থেকে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিদ্যমান সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এখনো কাঙ্ক্ষিত হারে দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন থেকে নীতি সুদের হার কয়েকবার বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করেছে। তার পরও দেশের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের কাছাকাছি। যদিও জানুয়ারি মাসের মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৯৪ শতাংশে নেমেছে। কিন্তু এটাও সন্তুষ্টিমূলক নয়।
মুদ্রানীতিতে কোন কোন বিষয় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত সে বিষয়ে জানতে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ কেবল বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ নয়, দরকার সমন্বিত পদক্ষেপ। আসন্ন মুদ্রানীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত হবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও কৃষকের ঋণ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া। এ ছাড়া বেসরকারি ঋণে সময়োপযোগী টার্গেট নির্ধারণ এবং ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে পদক্ষেপের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা দেওয়া। একই সঙ্গে বিনিময়হারের স্থিতিশীলতার বিষয়ে রোডম্যাপ এবং বকেয়া পেমেন্ট কেমন আছে এবং সেগুলো পরিশোধের বিষয়ে পরিকল্পনা তুলে ধরা।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, অর্থবছরের ছয় মাস শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.২৮ শতাংশ। এই হার ইতিহাসের সর্বনিম্ন। শুধু তা-ই নয়, এ সময় শিল্পের প্রয়োজনীয় মধ্যবর্তী পণ্য ও মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিও কমেছে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় ২০২৪ সালের একই সময় ভোগ্য পণ্য আমদানির ‘এলসি সেটেলমেন্ট’ কমেছে ১৩ শতাংশ। অর্থাৎ ঋণপত্রের নিষ্পত্তি হয়েছে কম।
ভোগ্য পণ্যের আমদানি কমলে বাজারে জোগান কমে দাম বেড়ে যায়, এটাই অর্থনীতির চিরাচরিত নিয়ম। অন্যদিকে মূলধনী ও মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি কমলে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ ও সক্ষমতা কমে যায়। এ সব কিছুর প্রভাব পড়ে প্রবৃদ্ধির ওপর। বিশ্বব্যাংকের মতে, চলতি অর্থবছরে যা ৪.১ শতাংশে নামবে। সেটা হলে তা হবে দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি, কেবল কভিড-১৯-এর ২০২০-২১ অর্থবছর বাদে।