Originally posted in দৈনিক ইনকিলাব on 14 May 2025
রপ্তানি এপ্রিলে কমেছে ১৯ শতাংশ, মার্চে ২৬ শতাংশ
কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ভাটা, উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কা
ফের ছন্দপতন ঘটেছে কৃষিপণ্য রপ্তানিতে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম সম্ভাবনাময় এই খাতের রপ্তানিতে গত কয়েক মাস ধরে চলছে নিম্নমুখী প্রবণতা। বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কৃষিপণ্যের রপ্তানি কমেছে প্রায় ১৯ শতাংশ। সবজি, তামাক ও শুকনো খাদ্য- এই তিন প্রধান কৃষিপণ্যেই রপ্তানি কমেছে উদ্বেগজনক হারে। এর আগের মাস মার্চেও কৃষিপণ্য খাতের রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে যায়।
বিশ্লেষকদের মতে, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষিজাত পণ্যের রপ্তানিতে সম্ভাবনা ব্যাপক। রপ্তানিতে তৈরি পোশাকের ওপর অতি নির্ভরতা কমাতে ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই খাত ভূমিকা রাখতে পারে। কয়েক বছর আগে সে সম্ভাবনার জানানও দেয় কৃষিপণ্য খাত। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ খাত থেকে রপ্তানি আয় প্রথমবারের মত এক বিলিয়ন ডলার ছাড়ায়। রপ্তানি হয় প্রায় ১০৩ কোটি ডলার বা ১ দশমিক শূন্য তিন বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয় ১৯ শতাংশের বেশি।
আশা জাগানিয়া এ ধারা অব্যাহত থাকে পরের বছরও। ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ডলারের মতো কৃষিপণ্য রপ্তানি হয় বাংলাদেশ থেকে। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি আসে ১৩ শতাংশ। কিন্তু এরপরের অর্থবছর ছন্দপতন ঘটে এ খাতের রপ্তানিতে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের তুলনায় কৃষিপণ্য রপ্তানি ২৭ শতাংশ কমে যায়। রপ্তানি হয় ৮৪ কোটি ডলারের পণ্য। তবে গত ২০২৩ ২৪ অর্থবছরে আবার কিছুটা বেড়ে হয় ৯৬ কোটি ডলার। প্রবৃদ্ধি আসে ১৬ শতাংশ।
কিন্তু চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শেষ অর্ধে ফের নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। গত এপ্রিল মাস পর্যন্ত চলতি অর্থবছরের মোট ১০ মাসে এ খাতের রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৪ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এতো কম রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়নি। আর গত কয়েক মাসের অবস্থা খুবই উদ্বেগজনক। এপ্রিল মাসে কৃষিপণ্যের রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের তুলনায় কমে গেছে ১৮ দশমিক ৯২ শতাংশ। রপ্তানি হয়েছে ৫ কোটি ১৮ লাখ ডলারের। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল ৬ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে কৃষিপণ্যের রপ্তানি কমেছিল প্রায় ২৬ শতাংশ।
গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় হয় দেশের যে তিনটি কৃষিপণ্য থেকে সেগুলো হচ্ছে- শুকনো খাদ্য, তামাক ও সবজি। এর মধ্যে শুকনো খাদ্য থেকে ২১ কোটি ৭১ লাখ ডলার,তামাক থেকে ১৮ কোটি ১৫ লাখ ডলার এবং সবজি থেকে ১২ কোটি ২৪ লাখ ডলারের রপ্তানি হয়েছে।
চলতি বছরের এপ্রিল মাসে এ তিনটি প্রধান কৃষিপণ্যের রপ্তানি আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ব্যাপক হারে কমে গেছে। এর মধ্যে শুকনো খাদ্য রপ্তানি কমেছে ৩৫ শতাংশ। গত এপ্রিলে এ পণ্য রপ্তানি হয়েছে সাড়ে ৯৮ লাখ ডলারের মতো। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল দেড় কোটি ডলারের বেশি। গত এপ্রিলে তামাক রপ্তানি হয়েছে প্রায় সাড়ে ৭৭ লাখ ডলারের। ২০২৪ সালের এপ্রিলে হয়েছিল ১ কোটি ডলারের বেশি। অর্থাৎ তামাক রপ্তানি কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আর প্রায় ২২ শতাংশ কমেছে সবজি রপ্তানি। ৯৩ লাখ ডলার থেকে নেমেছে ৭৩ লাখ ডলারে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কৃষিপণ্যে রপ্তানির অনেক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমরা নানান কারণে এখনও সেই সুযোগ পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষিপণ্য রপ্তানি ছিল প্রায় এক বিলিয়ন ডলার। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই থেকে এপ্রিল- এই ১০ মাসে প্রবৃদ্ধি ৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও গত এপ্রিল মাসে রপ্তানি কমেছে ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে বড় বাজার থাকলেও আমরা অনেক সময় সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে পারছি না। কৃষিপণ্যের বাণিজ্যিকীকরণ বাড়াতে রপ্তানি মান ও পরিবহণ সমস্যা দূর করতে হবে। স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলতে পারছি না। এগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলে রপ্তানি বাড়বে।’
রপ্তানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেসব কৃষিপণ্য রপ্তানি হয় সেগুলোর উৎপাদন পর্যায়ে অস্থিরতাসহ নানা সমস্য দেখা দিয়েছে। এর ফলে গত কয়েক মাসে কৃষিপণ্য রপ্তানি ব্যাপক হারে কমে গেছে। যেমন, দেশ থেকে যে তামাক রপ্তানি হয়, তার একটি বড় অংশ যায় কুষ্টিয়া থেকে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ায় অবস্থিত দেশের সবচেয়ে বড় তামাক প্রক্রিয়াজাত কারখানায় মৌসুমি শ্রমিকদের আন্দোলনকে ঘিরে ব্যাপক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। গত ২৩ এপ্রিল থেকে বন্ধ রয়েছে কারখানার কাজ। এ অচলাবস্থা চলতে থাকলে তামাক থেকে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে সার্বিকভাবে দেশের কৃষিপণ্য রপ্তানি সামনের মাসগুলোতে আরও কমে যাবে।
কুষ্টিয়ার ওই কারখানায় শুধু ২০২৪ সালেই ৮৩৪ কোটি টাকা সমমূল্যের রপ্তানিযোগ্য তামাক প্রক্রিয়াজাত করা হয়েছে। অনেক বছর ধরে কারখানাটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছিল। শ্রমিক-কর্মচারী ছাড়াও প্রায় ৫০ হাজার কৃষক কারখানাটির ওপর নির্ভরশীল। কৃষকদের অনেকেই ইতোমধ্যে তাদের ফসল সংগ্রহ করে রেখেছেন। কিন্তু কারখানা বন্ধ থাকায় চরম অনিশ্চয়তায় পড়েছেন তারা। কারখানায় তামাক সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াকরণ না হলে, নষ্ট হবে তাদের কষ্টের ফল। তাই কারখানাটি বন্ধ থাকায় তামাক রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষি ও কৃষকের ওপরও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের সর্বোচ্চ রাজস্ব হয় তামাক থেকে। কুষ্টিয়ার কারখানাটির উৎপাদন দিনের পর দিন এভাবে বন্ধ থাকলে এই খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। অর্জিত হবে না লক্ষ্যমাত্রা। বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কারখানায় এই অচলাবস্থা অন্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মাঝেও উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। তাই সার্বিকভাবে এ ধরনের ঘটনা দেশের অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এ অবস্থায় কারখানায় উৎপাদন কার্যক্রম সচল রেখে আইনি প্রক্রিয়া ও আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
বিশেষজ্ঞ এবং রপ্তানি সংশ্লিষ্টদের মতে, বাংলাদেশের কৃষিপণ্য খাতে ব্যাপক সম্ভাবনার পাশাপাশি নানা চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, কিছু রপ্তানিযোগ্য কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক খাদ্য নিরাপত্তা ও মানের মানদণ্ড পূরণে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে রয়েছে। নতুন বাজারে প্রবেশ ও পণ্যের প্রচারণার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। প্রচলিত কয়েকটি দেশের ওপর নির্ভরশীলতা রপ্তানিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। সীমাবদ্ধতা রয়েছে লজিস্টিক ও অবকাঠামোর ক্ষেত্রে। রপ্তানিযোগ্য মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদনের জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি এখনো পর্যাপ্ত নয়। হঠাৎ কর বাড়ানোসহ সরকারি নীতির ধারাবাহিকতার অভাবেও উৎসাহ হারান রপ্তানিকারকরা। এ খাতে সরকারের রপ্তানি প্রণোদনাও কম। এর সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে যোগ হয়েছে কারখানায় ধর্মঘটের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ নানা অস্থিরতা। এতে কৃষিপণ্য রপ্তানি নিয়ে বড় অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এসব সমস্যার সমাধানে নীতি নির্ধারকদের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।