কোরবানি দেওয়া পশুর প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক তথ্য এখনও বের করা যায়নি। এক হিসাবে যদি এ সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হয়, তো আরেক হিসাবে দেখানো হয়_ ৬০ থেকে ৭০ লাখ গরু-ছাগল জবাই হয় কোরবানির তিন দিনে। এত পশু আসে কোত্থেকে?
Published in Samakal on Wednesday, 23 September 2015.
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
কোরবানির অর্থনীতি
ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম
বাংলাদেশে এখন চারটি বড় উৎসব রয়েছে, যাকে কেন্দ্র করে ঘরে ঘরে চলে প্রস্তুতি এবং একই সঙ্গে বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এগুলো হচ্ছে_ ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, পহেলা বৈশাখ এবং শারদীয় দুর্গোৎসব। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে মাসব্যাপী কেনাকাটা চলে। খাদ্যদ্রব্য ও পোশাকের জন্য ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রতিটি পরিবার কিছু না কিছু ব্যয় করে। ঈদুল আজহার সময়ে বেশিরভাগ অর্থ ব্যয় হয়ে যায় কোরবানির পশু ক্রয়ে। আমরা জানি যে, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। সব পরিবারের আয় সমান নয়, কিন্তু তারপরও সবারই কমবেশি সঙ্গতি বাড়ছে এবং তার প্রভাব দেখি আমরা দুই ঈদের বাজারে। ঈদের সময় লাখ লাখ পরিবারে বোনাস মেলে। প্রবাসে কর্মরত বিপুলসংখ্যক পরিবারও এ উপলক্ষে স্বজনদের কাছে বাড়তি অর্থ প্রেরণ করেন। এ অর্থে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার ভরপুর থাকে এবং অনেক পরিবার ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রথম বছরগুলোতেও দেখা গেছে, বেশিরভাগ কোরবানি দেওয়া হতো শহরে। কিন্তু এখন সুদূর গ্রামেও গরু-ছাগলের হাট বসে এবং সেখানে ক্রেতার সংখ্যা থাকে অনেক। কোরবানির পশুর চাহিদার বড় অংশই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন থেকে মেটানো হয়। বাকিটা আসে প্রধানত ভারত থেকে। এবারে ভারত থেকে পশু কম আসতে পারে, এমন শঙ্কা সৃষ্টি হওয়ায় অপর প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকেও গরু আসার খবর মিলেছে।
কোরবানির পশুর বাজারকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গরু-খাসি পালনের জন্য অনেকেই বিনিয়োগ করেন। কেউ মাত্র কয়েক মাসের জন্য বিনিয়োগ করেন। আবার অনেকের পরিকল্পনা থাকে দীর্ঘমেয়াদি। লাখ টাকা বা তার চেয়েও বেশি দামে পশু বিক্রির টার্গেট থাকে অনেকের। পারিবারিক পর্যায়ে পশু পালনের আয়োজন যেমন দেখা যায়, তেমনি বড় ধরনের অর্থ বিনিয়োগ করেও খামার গড়ে তোলা হচ্ছে।
কোরবানি দেওয়া পশুর প্রকৃত সংখ্যা কত, তার সঠিক তথ্য এখনও বের করা যায়নি। এক হিসাবে যদি এ সংখ্যা ৩০ লাখ বলা হয়, তো আরেক হিসাবে দেখানো হয়_ ৬০ থেকে ৭০ লাখ গরু-ছাগল জবাই হয় কোরবানির তিন দিনে। এত পশু আসে কোত্থেকে? পশুসম্পদ বিভাগের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩-১৪ সালে বাংলাদেশে গরুর সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৩৫ লাখের মতো। মহিষ ছিল সাড়ে ১৪ লাখ। ভেড়া ৩২ লাখ এবং খাসি-ছাগল আড়াই কোটির কিছু বেশি। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে গবাদিপশুর উৎপাদন প্রায় স্থিতিশীল রয়েছে (মাত্র ০.৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি); কিন্তু ছাগল-খাসির উৎপাদন যথেষ্ট বেড়েছে। কোরবানির জন্য এ দুই ধরনের পশুর ওপরই চাপ পড়ে। অনেকেই এ সময়ে ভালো দাম পেয়ে ঘরের গরু-ষাঁড়-খাসিও বিক্রি করে দেন। কোরবানির বাজারে ভারতীয় গরুরও যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সেখানের ব্যবসায়ীদেরও নজর রযেছে এই বড় বাজারের প্রতি। ভারত থেকে প্রতিদিনই গরু আসছে বাংলাদেশে। এজন্য একটি ‘ইনফরমাল সাপ্লাই চেইন’ গড়ে উঠেছে বহু বছরের অভিজ্ঞতায়। এখন পর্যন্ত যে হিসাব আমাদের জানা আছে তাতে ধারণা করা হয় যে, বছরে ১৫ লাখের মতো গরু আসে। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার গরু বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এ সাপ্লাই চেইনের সঙ্গে যুক্তদের জন্য এটা বেশ লাভজনক। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে যে গরু ৫০০ থেকে তিন হাজার রুপি বিক্রি হচ্ছে, তার বিক্রয় মূল্য বাংলাদেশের বাজারে ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকা। এর অর্থ হচ্ছে, লাভের মার্জিন ১২৩০ শতাংশ থেকে তিন হাজার ৯০০ শতাংশ পর্যন্ত। অবিশ্বাস্য অঙ্ক বৈকি। এ থেকে চেইনের ভারতীয় অংশীদাররা সাড়ে চার হাজার রুপির মতো পেয়ে থাকেন। বাকিটা থাকে বাংলাদেশিদের। তাদের লাভ ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। সম্প্রতি ভারত সরকার গবাদিপশুর এ ধরনের সাপ্লাই চেইন ভেঙে দেওয়ার কথা বলতে শুরু করেছে। এর প্রভাব এবারের কোরবানির পশুর বাজারে ব্যাপকভাবে পড়বে, এমন শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা হয়নি। যে কারণে দেশি-বিদেশি গরুর উপস্থিতিতে হাটগুলো সরগরম। কিন্তু যদি এই ইনফরমাল চেইন ভেঙে যায়? তেমনটি ঘটলে দেশের মাংসের বাজারের পাশাপাশি চামড়া শিল্পেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু একটু করে ভালো হচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মাংস, দুধ ও চামড়ার চাহিদা। দেশে উৎপাদন যেহেতু একই মাত্রায় রয়েছে, তাই ‘আমদানিতে’ হেরফের ঘটলে বাজার অস্থির হওয়ার শঙ্কা থাকে।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। বিশ্ববাজারে রয়েছে আমাদের চামড়ার ভালো চাহিদা। বাংলাদেশে বছরে যে চামড়া মেলে তার অর্ধেক দেশের বাজারে বিক্রি হয়, বাকি অর্ধেক আধপাকা ও পাকা চামড়া হিসেবে রফতানি হয়। এ শিল্পকে সম্ভাবনাময় ধরা হয়। ভালোভাবে প্রক্রিয়াজাত করে রফতানি করা গেলে মূল্য সংযোজন হয় উচ্চহারে। এ শিল্পে এখন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। এমতাবস্থায় বাজারে কাঁচামালের সরবরাহে বিঘ্ন ঘটলে তার প্রভাব সহজেই অনুভূত হবে।
ঈদুল ফিতরের সময় পোশাকের কেনাবেচা বেশি হয়। মুসলিম পরিবারের ধনী-দরিদ্র সবাই এ সময়ে সাধ্যমতো কিছু না কিছু কেনে। জুতা, জামা, প্রসাধনী_ এসবেরও প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয়। এ উৎসবের দুই মাস যেতে না যেতেই আসে কোরবানির ঈদ, যখন প্রধান ব্যয়ের খাত হয় পশু কেনাকাটা। এ সময়ে সব পরিবার পশু কেনে না। প্রধানত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তরা থাকে ক্রেতা। দুই উৎসবেই লাখ লাখ পরিবার নাড়ির টানে দেশের নানা প্রান্তে স্বজনদের কাছে ছুটে যায়। বেশিরভাগের গন্তব্য গ্রামে। পরিবহন খাতে এ সময়ে ভালো ব্যবসা হয়। অনেকে পর্যটনেও যান। কক্সবাজার, সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কুয়াকাটা, সুন্দরবন, পাহাড়পুর_ এসব স্থান লম্বা ছুটির সময় জমজমাট হয়ে ওঠে। মানুষ যেহেতু ঘুরে বেড়াতে চাইছে, তাই নতুন নতুন আকর্ষণীয় স্থানের খবরও তারা জানতে পারছে।
রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে ঈদের একটি সম্পর্ক রয়েছে। স্থানীয় কিংবা জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন সামনে থাকলে সম্ভাব্য প্রার্থীরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় কোরবানি দেন এবং পোশাক ও অন্যান্য উপহার বিতরণ করেন। নির্বাচন না থাকলেও কিছু না কিছু তারা করেন, যাতে তাদের উপস্থিতি অনুভূত হয়। জাকাতের জন্য শাড়ি-লুঙ্গির চাহিদা এ সময় বাড়ে।
কোরবানির পশুর চামড়া এতিমখানা ও মাদ্রাসাগুলোর আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। চামড়ার ব্যবসায়ী এবং ট্যানারি শিল্প মালিকরাও এ উৎসবের দিকে তাকিয়ে থাকেন ভালো মানের চামড়ার জন্য।
এ বছর ভারত থেকে গরু আসায় শেষ পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু যদি ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়? সম্ভাব্য যে কোনো ধরনের পরিণতি ভেবে রাখতে হয় নীতিনির্ধারকদের। পশু আমদানির ইনফরমাল সাপ্লাই চেইন বিঘি্নত হলে কোরবানির পশুর বাজারে প্রভাব পড়বে। বছরের অন্যান্য সময়েও বাজারে সংকট দেখা দেবে। এর ফলে দাম বাড়বে। গরুর মাংসের ঘাটতি এবং মূল্য বৃদ্ধির কারণে তখন খাদ্যাভ্যাস অনেকে পাল্টাবেন। নজর যাবে খাসি ও হাঁস-মুরগির দিকে। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে গরুর মাংস আমদানির কথাও অনেক ব্যবসায়ী ভাববেন। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে পশু পালন খাতে বাংলাদেশকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। প্রথম করণীয় হবে আমদানিনির্ভরতার পরিবর্তে দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো। এজন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের সহজশর্তে ঋণ প্রদান করার কাজটি করতে হয় ব্যাংককে। আর সরকারের কাজ হবে উন্নত জাতের গবাদিপশু পালনের জন্য যেসব উপকরণ ছোট-বড় উদ্যোক্তাদের জন্য অপরিহার্য, তা সহজলভ্য করা। মসলা জাতীয় পণ্য উৎপাদনে ব্যাংকগুলো স্বল্প হার সুদে ঋণ দেয়। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভর্তুকি দেয়। পশু পালনের ক্ষেত্রেও এটা করা যেতে পারে। পশু চিকিৎসাও সরকারের বড় ধরনের মনোযোগের কেন্দ্র হতে পারে। পশু পালন খাতে বিনিয়োগ যথেষ্ট লাভজনক তাতে সন্দেহ নেই। মাংস, দুধ, সার ও চামড়া_ কত ধরনের প্রয়োজন মেটাচ্ছে গৃহপালিত এ পশু। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। হাঁস-মুরগির উৎপাদন অনেক বাড়ানো গেছে। সবজি চাষেও সাফল্য আছে। পশু পালনে কেন সেটা সম্ভব হবে না?
অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক, সিপিডি