Published in www.dw.com on Tuesday, 23 May 2017
সাক্ষাৎকার
২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি এক প্রতিবেদনে বলেছে৷ (সিপিডি)-র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ প্রকৃতপক্ষে অনেক বেশি৷
অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)-এর প্রতিবেদনে উঠে আসা বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করবে৷
তবে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলছেন, ‘‘এটা দিয়ে কেবল বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকার ব্যাপকতা বোঝা যায়৷ পাচারকৃত টাকার পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি৷”
দৃষ্টান্ত হিসাবে তিনি রেমিটেন্স ও হুন্ডির প্রসঙ্গ টানেন৷ তিনি জানান, যখন প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেল বেশি ব্যবহার করতো, তখনও অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলার হুন্ডিতে দেশে যেতো, টাকার অঙ্কে যেটা ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো দাঁড়ায়৷ বিষয়টা হচ্ছে, যে পরিমাণ টাকা প্রবাসীরা হুন্ডিতে পাঠায়, সে পরিমাণ টাকা আসলে পাচার হয়ে যায়৷
তৌফিকুল ইসলাম খান বাংলাদেশের অর্থপাচারের নানা দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন ডয়চে ভেলের সঙ্গে৷
ডয়চে ভেলে: ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) এক প্রতিবেদনে বলেছে৷ অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এটা তদন্ত করবে৷ এর পূর্বে এ ধরণের তদন্ত হয়েছিল কি?
তৌফিকুল ইসলাম খান: না৷ সার্বিকভাবে এই রিপোর্টটা মূলত একটা অ্যাকাডেমিক এক্সারসাইজ৷ এটা ভালো যে, বাংলাদেশ ব্যাংক এটা গুরুত্বের সাথে নিয়ে একটি কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলেছে৷ এটা সত্যিকার অর্থে যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে অর্থ পাচারবিরোধী এবং অবৈধ অর্থনৈতিক প্রবাহের মতো বিষয়গুলো নিয়ে নীতিগত পদক্ষেপ সুদৃঢ় অবস্থানে যাবে৷
এই তদন্ত কোন পথে যাওয়া উচিত?
আমাদের দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ কী কী পথে পাচার হচ্ছে, তার জন্য আমাদের নীতিগত দুর্বলতাগুলো কোথায় আছে, কোথায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা অর্জন করতে হবে – এই বিষয়গুলো যদি উঠে আসে, তাহলেই নীতিগত জায়গা থেকে আমরা একটা বড় পরিবর্তনের আশা করতে পারি৷
এখানে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে যেটা দেখতে হবে, তা হলো, অর্থপাচারে বাণিজ্য প্রবাহের দ্বারা ৮০ শতাংশ লেনদেন হয়েছে৷ ফলে আমাদের যেটা স্বাভাবিকভাবে মনে হতো, এটা কেবল চোরাচালানকারী, অস্ত্রপাচারকারী করেন বা যারা ঘুস নিয়ে দুর্নীতির সাথে যুক্ত আছেন, তারাই কেবল অর্থ পাচারের সাথে যুক্ত, তা না৷
‘যে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন যদি চান, সেক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে’
এখানে বড় করে উঠে এসেছে, বিশ্বব্যাপী বাণিজ্যিক লেনদেনের ভেতরে অনেক ফাঁক আছে৷ এর বড় কারণ, কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা৷ ফলে এই কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা যদি আমরা রোধ করতে পারি, একদিক থেকে আমাদের বৈদেশিক লেনদেনের চাপটা কমে আসবে, একইসাথে দেশজ সম্পদ আহরণেও উন্নতি করতে পারবো৷
চোরাচালান বা দুর্নীতির টাকা কি তাহলে এই (জিএফআই-র) হিসাবে নেই?
এটার একটা অংশ হয়ত এখানে আছে৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে যারা আন্তর্জাতিক চোরাচালান, অস্ত্র পাচারের সঙ্গে আছে, বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় বাণিজ্যিক লেনদেনের মাধ্যমেও আসে৷ হুন্ডির অংশ হয়ত এখানে আসেনি৷ ফলে এটা একটা আংশিক হিসাব৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটাকে প্রাক্কলণ বলতে পারি৷ এটা পূর্ণ হিসাবপদ্ধতি না৷
সেই টাকার পরিমাণ কত হতে পারে?
এটা যেহেতু একটা অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রের হিসাব৷ এখানে সত্যিকার অর্থে কত টাকা গেছে, সেই হিসাব পাওয়া খুব কঠিন হবে৷ আমাদের অর্থ লেনদেনের পরিমাণ কত ব্যাপক হতে পারে, সেই প্রবণতা বাড়ছে নাকি কমছে, সেই বিষয়গুলো নির্দেশ করে৷
আনুমানিক বা কোনো ধারণা দেয়া যেতে পারে?
আমাদের এখানে সে ধরনের কোনো সমীক্ষা নাই৷ বড় আকারে যদি দেখেন, রেমিটেন্সের বিষয়ে একটা সমীক্ষা দেখেছি৷ কিছুদিন আগের কথা বলছি৷ সাম্প্রতিক সময়ের কথা নয়, যখন ব্যাপক আকারে অবৈধ লেনদেন বেড়েছে বলে আমরা ধারণা করছি, তখন তার প্রমাণও পাওয়া গেছে৷ যখন আমাদের ব্যাংকিং খাতে রেমিটেন্স অনেক ভালো ছিল, তখন ১৫ বিলিয়ন ডলার যেখানে ব্যাংকিং খাতে আসতো, প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স অবৈধ পথে আসতো৷ যখন এই অবৈধ পথে লেনদেন হয়, মাথায় রাখতে হবে, যে টাকা এই পথে দেশে আসে, সমপরিমাণ টাকা বিদেশে চলে যায়৷
স্বর্ণ চোরাচালান বা অন্যান্য বিষয় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটার সঙ্গে যুক্ত বলে অনেকে ধারণা করেন৷
গত ১০ বছরের হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ৫৫৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যার ৮৮ শতাংশই হয়েছে আমদানি ও রপ্তানিতে মিথ্যা মূল্য ঘোষণা দিয়ে৷ এই মিথ্যা ঘোষণা ঠেকানোর উপায় কী?
আমাদের কাস্টমসের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সেখানে সুশাসন নিশ্চিত করা৷ তাদেরকে যথাযথ পরিমাণ কারিগরি সহায়তা দেয়া৷ অনেক ক্ষেত্রে তাদের জনবল ও মেশিনপত্রের অভাব আছে৷ এখন সফটওয়ার এসেছে, তারা যেন রিয়েল টাইমে’ মূল্য দেখতে পারে৷ পরিদর্শন করার জন্য ডকুমেন্টে সংস্কার আনতে হবে৷ এই জায়গাতে কাজ না করতে পারলে হবে না৷
আরেকটা বড় ব্যাপার হলো, আমরা কতখানি এই সব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করতে পারবো৷ অনেক সময় দেখা যায়, ব্যাংকে এক ধরনের কাগজপত্র জমা দেয়া হচ্ছে৷ আবার কাস্টমস পয়েন্টে আরেক ধরনের কাগজপত্র জমা দেয়া হচ্ছে৷ এই জায়গাগুলোতে সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে৷ যেসব প্রতিষ্ঠান সরকারি পর্যায়ে এই কাজে যুক্ত আছেন, তাদের মধ্যে একটা সমন্বয় লাগবে৷
এই টাকার মালিক কি আমদানি রপ্তানিকারকগণ? নাকি অন্যদের টাকা তারা পাচার করে দিচ্ছেন?
যারা ব্যবসা করেন, তারা নিজের টাকাই পাচার করে দেন৷ আর যারা এটাকেও একটা ব্যবসা হিসাবে দেখেন, তারা হয়ত এখানে ব্যবসা করছেন, যেটাকে আমরা বলি, হুন্ডি ব্যবসা৷ এটা দু’ভাবেই আছে৷
আপনারা বলেছেন, আইনগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুই ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধি; সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় রক্ষা; অন্য দেশের সঙ্গে সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা৷ এগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত বলবেন?
আমাদের দেশের অর্থ পাচার আইনে একটা পরিবর্তন লাগবে৷ আমাদের কাস্টমস আইনে একটা পরিবর্তন লাগবে৷ এই সংস্কারগুলো কিছুটা গত কয়েক বছরে হয়েছে৷ কিছু কিছু জায়গায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে, সেগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে৷ অনেক ক্ষেত্রে এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহায়তা দরকার হবে, কারণ, যখন বাণিজ্য হয়, তখন কিছু দেশের মধ্যে হয়৷ এখন বিশ্বব্যাপী আলোচনা চলছে যে, এখন যদি দেশগুলোর ভেতরে একটা স্বয়ংক্রিয় তথ্য বিনিময় হতো, তাহলে সেটাকে কাজে লাগিয়ে, এগুলোকে রোধ করা যেত৷ সেই জায়গাগুলোতে শক্তিশালী করার ব্যাপার আছে৷
রাজনৈতিক সদিচ্ছা কি নেই?
রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই-সেটা বলবো না৷ এই সমস্যাগুলো যে, কতখানি জটিল ও ব্যাপক হতে পারে, অনেকের যদি আগ্রহও থেকে থাকে, তিনি হয়ত অতটা গুরুত্ব দেন নাই৷ যে কোনো কাঠামোগত পরিবর্তন যদি চান, সেক্ষেত্রে অবশ্যই রাজনৈতিক সদিচ্ছা লাগবে৷ এটা কেবল রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে না, রাজনৈতিক সদিচ্ছা শব্দটাকে যখন আমরা ব্যবহার করি, তখন আমরা এটাকে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করি৷ সার্বিকভাবে যারা নীতি নির্ধারক আছেন, অন্যান্য অংশীদার আছেন, তাদের ভেতরে বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন লাগবে৷ সেখানে সরকারি আমলা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, গবেষক বা সিভিল সোসাইটির মধ্যে আগ্রহ থাকতে হবে৷
মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম প্রজেক্টে বাংলাদেশিরা তৃতীয় সর্বোচ্চ বিনিয়োগকারী৷ অস্ট্রেলিয়া, ক্যানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিরা বিনিয়োগ করছে৷ ক্যানাডাতে নাকি একটা বেগম পাড়া আছে, যেখানে বাংলাদেশের প্রভাবশালীদের স্ত্রীদের নামে বাড়ি আছে৷ এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
আমরা ক্যানাডার কথা শুনেছি, আমরা মালয়েশিয়ার কথা শুনেছি৷ বড় বিষয় হলো, এই জায়গাগুলোতে সরকার তো তদন্ত করে দেখতে পারেন , কারা এর মালিকানায় আছেন৷ স্ট্যাটাসকোতে বসে থাকলে এটার পরিবর্তন হবে না৷
বাংলাদেশে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের ইতিহাস কেমন? কতবার এটা ফেরত আনা গেছে৷ টাকার অঙ্কে সেটা কত? কার অর্থ ফেরত এসেছে? কোন প্রক্রিয়ায় এসেছে? বাকি অর্থ কোন প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা যাবে?
সম্পদ উদ্ধারে বড় কোনো সাফল্য নাই৷ অনেক ক্ষেত্রে এটা প্রমাণসাপেক্ষই নয়৷ ফলে টাকা উদ্ধারের পরিমাণ খুবই কম৷ এখানে দ্বৈত অপরাধের বিষয় আছে৷ এটা খুব দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া৷ এটা দ্বৈত-অপরাধ প্রমাণ করে আনতে হয়৷
আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেটা সরাসরি চুরি হলো, তার বড় অংশই আমরা আসলে ফেরত পাইনি৷
টাকা ফেরতের কয়টা কেইস আছে?
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটা কেসই আমরা জানি৷ কোকোর মামলায় যেটা ফেরত পাওয়া গেছে৷
ফেরত আনার জটিল প্রক্রিয়াকে সহজ করার উপায় কী?
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতি পরিবর্তন না করতে পারলে এটা হবে না, কারণ, তদন্ত ও ফেরত আনার নীতিটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে হয়৷
পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে কোনো দেশ কি ভালো সফলতা পেয়েছে?
কোনো দেশেরই খুব বেশি সফলতা নাই৷