দৈনিক প্রথম আলো
পোশাকশিল্প বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড। বিশ্বের প্রধান পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশের এ অর্জন দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফসল। তবে পোশাক খাতের ব্র্যান্ড ইমেজ ধরে রাখতে সনাতন বিষয়গুলোতে জোর দেওয়াই আগামী দিনের জন্য যথেষ্ট নয়। আগামী দিনে দেশের পোশাক খাত শুধু স্বল্পমূল্যের পোশাকই রপ্তানি করবে না, পাশাপাশি মধ্য ও উচ্চমূল্যের পোশাক রপ্তানির অন্যতম উৎস হতে পারে। এসব পণ্যের ক্রেতার কাছে মূল্যের চেয়ে পণ্যের মান অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। পণ্যের মানের ক্ষেত্রে শুধু পণ্যের গুণাগুণ বিবেচিত হয় না, কারখানার শ্রম-পরিবেশ, শ্রমিকের জীবনধারণ, শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নে কারখানার ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্ব দেওয়া হয়। তাই আগামী দিনে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড ইমেজ নির্ভর করবে সস্তা শ্রমে পণ্য রপ্তানিতে নয়, বরং শ্রমমানের ওপর।
শ্রমিক ইস্যু নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে পোশাক খাত খুব অস্থির সময় পার করছে। বর্তমানে শ্রমিক সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণ করলে চার ধরনের সমস্যা চিহ্নিত করা যায়। প্রথমত, জীবনধারণ সম্পর্কিত সমস্যা, যেমন মজুরি-ভাতার যৌক্তিক বৃদ্ধি না হওয়া, সময়মতো মজুরি না পাওয়া, বোনাস না দেওয়া ইত্যাদি। দ্বিতীয়ত, জীবনমান সম্পর্কিত সমস্যা, যেমন সাপ্তাহিক ছুটি ঠিকমতো না পাওয়া, মাতৃত্বকালীন ছুটি না পাওয়া, বাসস্থানের সংকট, শিশু পরিপালনে অসুবিধা, শ্রমিকদের যাতায়াতের অসুবিধা ইত্যাদি। তৃতীয়ত, শ্রমিকদের অধিকার সম্পর্কিত সমস্যা, যেমন মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে দর-কষাকষির অধিকার না পাওয়া, সংগঠন করার অধিকার না থাকা এবং কারখানা ব্যবস্থাপনা-শ্রমিক সুসম্পর্ক না থাকা। চতুর্থত, অন্যান্য সমস্যা, যেমন রাজনৈতিক ইস্যু, ঝুট ব্যবসা সম্পর্কিত বা শিল্প পুলিশের অতি ব্যবহার ইত্যাদি। এসব সমস্যার প্রতিটির প্রকৃতি, গভীরতা এবং শ্রমিকদের জীবনে এর প্রভাব ভিন্ন ভিন্ন। এসব বিষয় সম্যক উপলব্ধি না করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করলে খুব কার্যকর ফল লাভ করা যাবে না। বাস্তবে তা-ই দেখা গেছে।
শ্রমিকদের সমস্যাগুলো সমাধানের ক্ষেত্রে সমস্যার প্রকৃতি, গভীরতা এবং বিভিন্ন পক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্য বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, শ্রমিকের জীবনধারণ সম্পর্কিত সমস্যাগুলো প্রায়ই ঘটে থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিকদের সময়মতো মজুরি এবং ওভারটাইম পরিশোধ না করা আইনত দণ্ডনীয় (বাংলাদেশ শ্রমব্যবস্থা ২০০৬, ধারা ২৯২)। এ ধরনের পরিস্থিতি দেখা দিলে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ত্বরিত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। কোনো কারখানায় এ ধরনের সমস্যা একাধিকবার দেখা দিলে অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ওই কারখানাকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত। শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির দাবির এলাকাভিত্তিক একটি প্রবণতা রয়েছে। মূলত ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় (আশুলিয়া বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য) জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে নির্দিষ্ট আয়ের শ্রমিকদের (ওভেন কারখানায়) জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পরবর্তী ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণকালে জীবনযাত্রার ব্যয়ের প্রতিটি উপাদান (বিশেষত বাড়িভাড়া, মূল্যস্ফীতি এবং জীবনমানের উন্নতি) বিবেচনা করা উচিত।
দ্বিতীয় ধরনের সমস্যা মূলত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন সম্পর্কিত। এ ধরনের সমস্যা সমাধানে কারখানার সার্বিক উৎপাদনশীলতা, শ্রমবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি এবং সর্বোপরি করপোরেট সুশাসন প্রতিষ্ঠার দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করা উচিত। শ্রমিকদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করা, দুপুরের খাবার সরবরাহ করা এবং বাসস্থান সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছে অতিরিক্ত ব্যয় মনে হতে পারে। কিন্তু এ ধরনের ব্যয়ের মাধ্যমে শ্রম উৎপাদনশীলতার যে উন্নতি হতে পারে, সে বিষয়টি বিবেচনা করা দরকার। সিপিডির (২০০৮) গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কারখানা শ্রমিকদের এ ধরনের সুবিধা দিয়ে থাকে, তাদের উৎপাদনশীলতা অন্যান্য কারখানার তুলনায় বেশি। অন্যদিকে কারখানা কর্তৃপক্ষের এ ধরনের বিনিয়োগ শ্রমিকদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারখানার শ্রমিকদের জন্য নিজস্ব বাসস্থানের ব্যবস্থা করার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কারখানা কর্তৃপক্ষ দীর্ঘমেয়াদি লিজে বাসা ভাড়া নিয়ে অথবা তৃতীয় পক্ষের সঙ্গে চুক্তির অধীনে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারে। সরকারঘোষিত স্বল্প সুদের ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে ডরমিটরি বানিয়ে এ ব্যবস্থা করা যেতে পারে। শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে অ্যাসোসিয়েশনের সুনির্দিষ্ট অবস্থান থাকা উচিত। এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের ব্যয় কাঠামোতে ধরে প্রয়োজনীয় অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করবে।
তৃতীয় ধরনের সমস্যাগুলো শ্রমিকদের অধিকার বা শিল্পসম্পর্কের সঙ্গে জড়িত। ২০০৬ সালের শ্রম অ্যাক্টের ১৭৬ ধারা অনুযায়ী, শ্রমিকের দর-কষাকষির অধিকার বা সংগঠনের অধিকার থাকার কথা। কোথাও কোথাও ‘শ্রমিক কল্যাণ কমিটি’ রয়েছে, তবে তা ততটা কার্যকর নয়। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার কারখানাগুলোতে শ্রমিক কল্যাণ কমিটিগুলো মোটামুটি কাজ করছে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কারখানা পর্যায়ে কার্যকর মালিক-শ্রমিক আলোচনার প্লাটফর্ম থাকা গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের প্লাটফর্ম দুই পক্ষকে আলোচনার সুযোগ করে দেয় শ্রম অধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে গ্রহণযোগ্য সমাধানের জন্য। প্রয়োজনে শিল্পসম্পর্ক উন্নত করার স্বার্থে ‘শিল্পসম্পর্ক আইন’ করা যেতে পারে। প্রস্তাবিত এ আইনের আওতায় একদিকে শ্রমিকেরা তাঁদের অধিকার/ দর-কষাকষি করতে পারবেন এবং এ জন্য তাঁদের কর্মচ্যুতির আশঙ্কা থাকবে না; অন্যদিকে মালিকেরা নিশ্চিত হবেন যে শ্রমিকেরা দাবিদাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ বন্ধ করবেন না। এ ধরনের আইন বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সহযোগিতা নিশ্চিত করবে।
মালিক-শ্রমিক সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের দুর্বলতা দূর করা দরকার। শ্রমিক সম্পর্কিত বিষয়ে অনেক ক্ষেত্রেই ত্বরিত এবং কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে। কারখানার মালিকদের তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে উপস্থিত থাকা এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তাঁদের সরাসরি ভূমিকা বাড়ানো প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময় আর্থিক এবং অন্যান্য ব্যবস্থাপনাগত বিষয় জড়িত থাকে। অন্যদিকে ব্যবস্থাপক পর্যায়ে শ্রমিক-সংক্রান্ত বিষয়ে আরও সংবেদনশীল আচরণ নিশ্চিত করা দরকার। সার্বিকভাবে ব্যবস্থাপক পর্যায়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। শ্রমিকদের বিভিন্ন ইস্যুতে কারখানা পর্যায়ে প্রস্তুতির জন্য বর্তমানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বেটার ওয়ার্কস প্রোগ্রাম’কে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা দরকার। এ ক্ষেত্রে অ্যাসোসিয়েশনগুলোর এগিয়ে আসা উচিত।