ত্রাণ বিতরণে অবাধ তথ্য প্রবাহ, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি-বেসরকারি অধিকতর সমন্বয় প্রয়োজন

চলমান কোভিড-১৯ অতিমারি এবং রংপুর অঞ্চলে সাম্প্রতিক বন্যা পরিস্থিতির কারণে যে ধরনের ত্রাণ কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে, সেখানে স্থানীয় জনগণ, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় বৃদ্ধি করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে এই সমন্বয় সাধন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ত্রাণ বিতরণ সম্পর্কিত অবাধ তথ্য প্রবাহ ও তথ্যের প্রচারের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমের কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হবে।

২৫ আগস্ট ২০২০ তারিখে আয়োজিত করোনা ও বন্যা মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচিঃ সরকারি পরিষেবার কার্যকারিতা শীর্ষক একটি ভার্চুয়াল সংলাপে এই বক্তব্য উঠে আসে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) ও অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক সহায়তায় “গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ” শীর্ষক চলমান প্রকল্পের আওতায় এ সংলাপটি আয়োজিত হয়। এ সংলাপটির সহযোগী আয়োজক ছিল আরডিআরএস বাংলাদেশ এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ।

https://www.facebook.com/cpd.org.bd/videos/725689838286982/

চলমান কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় সুদূরপ্রসারী চিহ্ন রেখে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এই দুর্যোগ পূর্ব-বিদ্যমান দুর্বলতাগুলোকে আরও সংকটময় এবং এসডিজির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ব্যাহত করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সিপিডি’র প্রাক্কলন অনুযায়ী কোভিড-১৯ এর কারণে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে আছেন এমন মানুষের সংখ্যা প্রায় ১.৩ কোটি, যা সর্বশেষ জরিপকৃত শ্রমশক্তি (২০১৬-১৭) এর প্রায় ২০.১ শতাংশ। সিপিডি আরও প্রাক্কলন করেছে যে এই মহামারি (উচ্চ) দারিদ্র্যের হার ২০১৬ সালের ২৪.৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০২০ সালে ৩৫ শতাংশে উন্নীত করবে। এই “নতুন দরিদ্র”র সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ। সিপিডি’র সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, জনাব মোস্তফা আমির সাব্বিহ তার উপস্থাপিত মূল প্রতিবেদনে এই তথ্যগুলো উল্লেখ করেন। তিনি রংপুর জেলায় করোনা ও বন্যা মোকাবেলায় গৃহীত সরকারি ত্রাণ কর্মসূচির কার্যকারিতার একটি প্রাথমিক মূল্যায়নও তুলে ধরেন।

করোনা ও বন্যা মোকাবেলায় ত্রাণ কর্মসূচি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ পরিলক্ষিত হয়েছে। সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয় (বিশেষ করে নগদ সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে) এবং সুবিধাভোগী নির্বাচন অনেক ক্ষেত্রেই অংশগ্রহণমূলকভাবে হয়নি। ত্রাণ সেবা সম্পর্কিত হটলাইন নাম্বারগুলো সম্পর্কে স্থানীয় পর্যায়ের সুবিধাভোগীরা এখনও সচেতন নন এবং ইউনিয়ন বা উপজেলা পর্যায়ে ত্রাণ সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। বন্যা মোকাবেলায় ত্রাণ (জিআর-চাল এবং জিআর-নগদের) কর্মসূচি বিতরণের ক্ষেত্রে বন্যার তীব্রতা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সংখ্যার ওপর ভিত্তি না করে শুধুমাত্র দারিদ্র্যের হারের ভিত্তিতে সরকারি ত্রাণ কর্মসূচিকে নির্ধারণ করা হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত আলোচ্য চার জেলার তথ্য বিশ্লেষণেও দেখা যায় চাহিদার সাথে বরাদ্দ এবং বিতরণের সামঞ্জস্য নেই।

এ মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে সিপিডি সুপারিশ করে যে, সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য বাস্তবায়ন নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা নিশ্চিত করা এবং তা বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে এবং সুবিধাভোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া অংশগ্রহণমূলক করতে হবে। সুবিধাভোগীরা যেন সহজেই ত্রাণ গ্রহণ করতে পারেন এবং কোনো অপ্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ত্রাণ সেবা সংক্রান্ত প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোগ (যেমনঃ হটলাইন/নির্ধারিত মোবাইল নাম্বার) সম্পর্কে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সিপিডি আরও সুপারিশ করে যে স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোগ নিষ্পত্তি করার সুযোগ রাখতে হবে। বন্যায় ত্রাণসামগ্রী এবং নগদ অর্থ যেন দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে এবং সঠিক পরিমাণে পৌঁছায় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং ত্রাণ সেবাসমূহের ডুপ্লিকেশন রোধ, আওতা বাড়ানো জন্য জিও-জিও এবং জিও-এনজিও কর্মসূচিগুলোর মাঝে সমন্বয় বৃদ্ধি করা।

ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, আহ্বায়ক, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি এবং এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ সংলাপে আলোচনার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে ত্রাণ কার্যক্রম আরও কার্যকর করতে সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ে করতে হবে। ত্রাণ কার্যক্রমের পর্যাপ্ততা কেন্দ্রীয়ভাবে সরকারের নিশ্চিত করতে হবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে সমন্বয়ের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম আরও স্বচ্ছ করতে হবে।

সংলাপের সম্মানিত অতিথি জনাব মোঃ আসিব আহসান, জেলা প্রশাসক, রংপুর জেলা বলেন যে স্থানীয় পর্যায়ে তথ্য প্রচারের কাজ আরও বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি মনে করেন যে স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রমের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তথ্য প্রচার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। নগদ অর্থ বিতরণের ক্ষেত্রে কেউ যদি মোবাইলে অর্থ স্থানান্তরের মেসেজ পেয়েও নগত অর্থ না পেয়ে থাকেন, তবে তিনি সরাসরি জেলা প্রশাসকের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করার আহ্বান জানান এবং সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন।

জনাব মোঃ রাশেদুল ইসলাম, মহাপরিচালক, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য প্রদান করে বলেন যে জিও-এনজিও সমন্বয় নিশ্চিত করতে এনজিও বিষয়ক ব্যুরো আরও সক্রিয় প্রচেষ্টা করে যাবে যেন এই সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম কার্যকরভাবে বিতরণ করা যেতে পারে।

অ্যাডভোকেট জনাব মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া, মাননীয় ডেপুটি স্পিকার, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সংলাপে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।

ড. ফাহমিদা খাতুন, নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি, ড. দীপঙ্কর দত্ত, কান্ট্রি ডিরেক্টর, অক্সফ্যাম ইন বাংলাদেশ এবং জনাব মোহাম্মদ আব্দুর রহমান, পরিচালক, আরডিআরএস বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন।  অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি সংলাপে সভাপতিত্ব করেন।

এই সংলাপে রংপুর, নীলফমারি, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা অঞ্চলের প্রায় শতাধিক তৃণমূল সংস্থার প্রতিনিধিরা ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন এবং মাঠপর্যায়ে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

সংলাপে রংপুরের কমিউনিটি-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী, এনজিও প্রতিনিধি, ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তা, সমাজকর্মী, পেশাজীবি এবং গণমাধ্যমকর্মী সহ রংপুর অঞ্চলের নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।