Originally posted in সমকাল on 20 August 2022
সমকাল: জ্বালানি সংকটের এ সময়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি কীভাবে উপকারে আসতে পারে?
গোলাম মোয়াজ্জেম: বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি ছিল ২০ থেকে ২২ ডলার, যা এক পর্যায়ে বেড়ে ১৪০ ডলারে পৌঁছায়। এখন আবার ৯৫ থেকে ৯৭ ডলারে নেমে এসেছে। এলএনজির দর ছিল ইউনিটপ্রতি ২ থেকে ৩ ডলার। বর্তমানে বেড়ে হয়েছে ৪০ ডলার। সহযোগী জ্বালানি হিসেবে কয়লারও উচ্চমূল্য রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশসহ জ্বালানি আমদানিনির্ভর দেশগুলো এখন বিপদে আছে। বিদেশি মুদ্রার মজুত যেখানে কমে আসছে, সেখানে বেশি দামে জ্বালানি কিনতে হচ্ছে। এ নিয়ে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। ডলারের ওপর এ চাপ খুব সহজেই এড়ানো যেত যদি বিকল্প এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকত। লোডশেডিং এবং অন্যান্য সাশ্রয়ী পরিকল্পনার মাধ্যমে যে ৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাঁচানোর চেষ্টা সরকার করছে, স্থানীয়ভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে তা পূরণ করা সম্ভব ছিল। এতে একদিকে পরিবেশের জন্য সহায়ক পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সহজলভ্য হতো, অন্যদিকে ব্যয়ের দিক থেকে সাশ্রয়ী হতো। ফলে জ্বালানি সংকটের বাস্তবতায় সবচেয়ে ভালো বিকল্প হতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি।
সমকাল: এখন দেশে কতটুকু নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন এবং ব্যবহার হচ্ছে?
গোলাম মোয়াজ্জেম: এখন সব মিলিয়ে মাত্র ৭০০ মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য জ্বালানি দেশে উৎপাদন এবং ব্যবহার হচ্ছে, যা মোট বিদ্যুতের জাতীয় চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশের মতো। অথচ সরকারের লক্ষ্য ছিল ২০২০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ১০ শতাংশে উন্নীত করা। পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ৪০ শতাংশ করার পরিকল্পনা আছে সরকারের। অর্থাৎ সরকারের পরিকল্পনা আর বাস্তবতার মধ্যে এখনও বিস্তর ব্যবধান।
সমকাল: এত সুবিধা থাকলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কেন বাড়ছে না?
গোলাম মোয়াজ্জেম: অনেক কারণ আছে। প্রথমত, নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সহায়ক নীতিকাঠামো নেই। যে ধরনের নীতিসহায়তা থাকলে এ খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে এগিয়ে আসতেন, তা নেই। ব্যাংক ব্যবস্থা থেকেও অর্থায়নের বিষয়টি সহজ নয়। সরকারের ঘোষণা আর পদক্ষেপের মধ্যে মিল নেই। আবার নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিরুদ্ধে আছে অপপ্রচার। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়লে যাদের রমরমা মুনাফা কমে যেতে পারে তাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্লান্ট করতে বেশি জমির প্রয়োজন, উৎপাদনশীলতা কম, ব্যয় বেশি এবং বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক নয়। আরও বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের আবহাওয়ায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি লাভজনক হবে না। সৌরবিদ্যুতে দিনে চলবে, রাতে কী হবে। এগুলো আসলে অপপ্রচার। রেলের বিরুদ্ধে যেমন বাসওয়ালারা অপপ্রচার চালায়। এভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রতি নীতিনির্ধারক এবং সাধারণ মানুষের মনে একটা বাজে ধারণা তৈরি করার জন্য একটা গোষ্ঠী খুব তৎপর।
সমকাল : আপনি বলছেন এগুলো অপপ্রচার, তাহলে সত্যটা কী?
গোলাম মোয়াজ্জেম: সত্যটা হচ্ছে, প্লান্ট স্থাপনে জমি বেশি লাগে না। প্রথম দিকে যে পরিমাণ জমি লাগত, এখন তার অর্ধেকও লাগে না। এ ছাড়া উৎপাদনশীলতা বেড়েছে আগের চেয়ে অন্তত ৫ গুণ। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে দিনের উৎপাদিত বিদ্যুৎ রাতের জন্য সংরক্ষণ করা যায় অন্তত ৬ ঘণ্টা। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দামও অনেক কমে এসেছে। ইউরোপ-আমেরিকা তো আগে থেকেই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার করছে। আমাদের প্রতিবেশী ভারত এবং ভিয়েতনামেও পরিচ্ছন্ন এবং সাশ্রয়ী জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। এসব দেশের সরকারও সহায়ক নীতিকাঠামো দিয়ে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করছে।
সমকাল :বিকল্প কোন কোন জ্বালানি দেশে ব্যবহার করা হয় বা হওয়ার সুযোগ রয়েছে ?
গোলাম মোয়াজ্জেম: আমাদের দেশে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ, বায়োফুয়েল, জিওথার্মাল, নদীর স্রোত ও সমুদ্রের ঢেউ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ইত্যাদিকে শনাক্ত করা হয়েছে। অনেকে বলে থাকেন আমাদের দেশে বায়ুশক্তির মাধ্যমে জ্বালানি উৎপাদন সম্ভব নয়। আমি মনে করি এটা বড় উৎস হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর সম্ভাবনা এখন আরও বেড়েছে। শিল্পকারখানা, সেচকাজ, বাসাবাড়িতে ব্যবহার- যে কোনো প্রয়োজনেই এই বিদ্যুৎ ব্যবহার করা যায়।
সমকাল: জীবাশ্ম জ্বালানির তুলনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির বাণিজ্যিক ব্যবহার কতটা লাভজনক?
গোলাম মোয়াজ্জেম: বিদ্যুৎ উৎপাদনে জীবাশ্ম জ্বালানি হিসেবে খনিজ তেল, গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার করা হয়। আমদানিনির্ভর এসব জ্বালানি কত ব্যয়বহুল এবং তার পরিণতি কেমন হতে পারে তা তো আমরা এখন খুব হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রাথমিক বিনিয়োগের পর আর খুব বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির দর-দামও কমেছে বিশ্ববাজারে। ফলে বাণিজ্যিক বিবেচনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি টেকসই এবং অনেক বেশি লাভজনক।
সমকাল: নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে আপনি কী পরামর্শ দেবেন?
গোলাম মোয়াজ্জেম: জ্বালানিসংক্রান্ত সরকারের নীতিকাঠামো নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য সহায়ক নয়। এটা এখনও এককেন্দ্রিক। এই বৈষম্য দূর কতে হবে। সহায়ক নীতিকাঠামো হিসেবে গ্রিড ক্যাপাসিটি ও ভূমি উন্নয়ন সুবিধা দেওয়া দরকার। পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং কুইক রেন্টাল অপসারণ করা দরকার। উৎপাদন সক্ষমতা কমে গেছে এমন বিদ্যুৎকেন্দ্র নতুন করে আর নবায়ন না করা উচিত। এ ধরনের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করলে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিত হবে। তা নাহলে জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ক্ষমতা ৪২ থেকে ৪৮ শতাংশ উদ্বৃত্ত থাকার বাস্তবতায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানো সহজ নয়। সরকার যদি সত্যিই পরিবেশ সহায়ক সাশ্রয়ী জ্বালানির ব্যবহার চায় তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতেই হবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক সিপিডি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবু হেনা মুহিব