Published in সমকাল on Wednesday, 8 March 2017
পরিবর্তনের জন্য সাহস
নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা
ড. ফাহমিদা খাতুন নির্বাহী পরিচালক, সিপিডি
নিজেকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য, নিজের স্বপ্নকে ছোঁয়ার জন্য অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া জরুরি। আমরা নারীর সমতার কথা বলি, অধিকারের কথা বলি। সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলি, এ সবকিছুর মূলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। গত দুই দশক ধরে নারীর জীবনযাত্রার মান এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রভাব ক্রমান্বয়ে বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির নারীর মধ্যকার জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বা কমাতে এবং আয়, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের মধ্যকার ফারাক বৃদ্ধিতে বা সংকোচনে সহায়তা করে। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিমালায় জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন থাকলে তা নীতিমালায় সমতা এবং দক্ষতা বাড়াতে সহায়তা করে; ফলে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়নের পথ প্রশস্ত হয়।
নারীর প্রতি বৈষম্যের আর একটি কারণ নিহিত রয়েছে খোদ অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোর মধ্যে। প্রচলিত অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশের মধ্যে নারীর কাজকে অর্থপূর্ণ ও উৎপাদনশীল ধরা হয়নি। অর্থনৈতিক তত্ত্বগুলোতে নারীর অ-আর্থিক কাজগুলোকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বাইরে ধরা হয়। গতানুগতিক নয়া-ক্ল্যাসিকাল ব্যাষ্টিক অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী একজন ব্যক্তি যদি এমন কোনো পণ্য বা সেবা উৎপাদন বা ভোগের সঙ্গে জড়িত থাকে যার বিনিময়মূল্য আছে অর্থাৎ বাজারে যা অর্থের বিনিময়ে কেনাবেচা করা যাবে শুধু সেসব পণ্যই হিসাবের মধ্যে থাকবে। নারী এবং পুরুষের কর্ম পরিধির ভিন্নতার কারণে অর্থনীতিতে নারীর ভূমিকা ভিন্নভাবে প্রতিফলিত হয়। মূলত পুরুষের প্রধান ভূমিকা হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের ভরণপোষণের জন্য ঘরের বাইরে কাজ করা। আর এই কাজের বিনিময়ে সে অর্থ উপার্জন করে। অন্যদিকে বেশিরভাগ নারী ঘরের কাজকর্ম করে থাকে যার কোনো আর্থিক বিনিময় মূল্য নেই। পুরুষ বাজারে যা উৎপাদন করছে, কিনছে বা ভোগ করছে তা হয়ে যাচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড; আর নারী ঘরে পরিবারের জন্য যে পণ্য বা সেবা উৎপাদন করছে এবং ভোগ করছে তা হচ্ছে অ-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। এই ধরনের অর্থনৈতিক তত্ত্ব নারী-পুুরুষের অর্থনৈতিক বৈষম্যের অন্যতম কারণ। এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই একটি দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি হিসাব করা হয়ে থাকে। কিন্তু এই তত্ত্ব খণ্ডিত এবং ভ্রান্ত। এ কারণেই জিডিপিতে নারীর অবদান খুব কম দেখানো হয়।
বর্তমানে আমাদের দেশে যে উন্নয়ন প্রক্রিয়া চলছে তাতে নারীরা উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় পুরোপুরি অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। প্রথমত বিদ্যমান অর্থনীতি নারীর জন্য কাজের এবং আয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ করে দিতে পারে না। তবে সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়াটাই যথেষ্ট নয়। সুযোগ কোনো কাজেই লাগবে না যদি না তার ব্যবহার করা যায়। তাই দ্বিতীয় প্রয়োজনটি হলো সক্ষমতার, যেটির অভাব রয়েছে নারীর। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এই দুটি বিষয়কে তার ‘কমোডিটিজ অ্যান্ড কেপেবিলিটিজ’ প্রবন্ধে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে, কাউকে কোনো পণ্য দিলেই তার জীবনযাত্রার মান বদলে যায় না। বদলানোটা নির্ভর করে ওই পণ্যটির ব্যবহার করার সক্ষমতা ওই ব্যক্তির রয়েছে কি-না তার ওপর। আমাদের সমাজে যে সুযোগগুলো অর্থনীতিতে রয়েছে সেগুলো ব্যবহার করার জন্য নারীর উপায় বা ক্ষমতা থাকে না। যেমন_ শিক্ষা ও দক্ষতার অভাবে নারীরা অনেক কাজ করতে পারে না। কিংবা শুধু স্বল্প আয়ের এবং নিচু পর্যায়ের কাজগুলোতে অংশ নিতে পারে। আর এ কারণেই দেখা দেয় আয় বৈষম্য। অর্থনীতিবিদ এবং সমাজ বিজ্ঞানীরা, যেমন জন স্টুয়ার্ট মিল, অ্যাডাম স্মিথ এবং কার্ল মার্কস যুক্তি দিয়েছিলেন মানুষের সহজাত ক্ষমতা নয়, বরং শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়। সমাজের আয় বৈষম্য শিক্ষার অভাবেই হয়। তাই গ্যারি বেকার, থিওডোর শুলজ এবং অ্যাডাম স্মিথের মতো অর্থনীতিবিদরা তাদের বিখ্যাত ‘মানব মূলধন’ তত্ত্বের মাধ্যমে মানব মূলধনের ওপর বিনিয়োগ করতে বলেছেন। মানব মূলধনের আরেকটি অংশ হচ্ছে স্বাস্থ্য, সেখানেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছে। তবে শুধু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য থাকলেই সমাজে নারীর অবস্থান পাল্টে যাবে তা নয়। সম্পদের মালিকানা কার হাতে রয়েছে তার মাধ্যমেই নির্ধারিত হয় ক্ষমতার ভারসাম্য। কার্ল মার্কস এবং ফ্রেডরিক এঙ্গেলস নারীর অধস্তন অবস্থানকে সম্পদের মালিকানার প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করেছেন। তাদের মতে অর্থনৈতিক অবস্থানই সমাজে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা থেকে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় উত্তরণের ফলেই সমাজে এবং পরিবারে নারীর অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে। আর তাই বর্তমানে এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে যেসব নারী নিজেরা সাফল্য অর্জন করছে, অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ করছে তারাও মুক্তি পাচ্ছে না পুরুষতন্ত্রের অন্যায় থেকে। সাংস্কৃতিক মুক্তি না হলে এখানে কোনো পরিবর্তন হবে না।
নারীর প্রতি বৈষম্য ঘোচনার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে তার উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। নারী বাজেট হচ্ছে বাজেটের জেন্ডারভিত্তিক মূল্যায়ন, বাজেটের সকল পর্যায়ে জেন্ডার দৃষ্টিভঙ্গির অন্তর্ভুক্তি এবং রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের পুনর্বিন্যাসে জেন্ডার সমতা রক্ষা করা। জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেটের অর্থ এই নয় যে, নারীর জন্য আলাদাভাবে বাজেট তৈরি করতে হবে। বরং বিদ্যমান জাতীয় বাজেটে জেন্ডার সমতা রক্ষার জন্য নীতিমালা ও বরাদ্দ করাই হচ্ছে জেন্ডার বাজেটিং এর উদ্দেশ্য। এ ক্ষেত্রে সরকারি অর্থায়নের লক্ষ্য হওয়া উচিত খানা বা পরিবার নয় বরং নারী এবং পুরুষের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদার ভিত্তিতেই রাজস্ব আহরণ এবং সরকারি ব্যয় নির্ধারণ করতে হবে। কেননা একই পরিবারের মধ্যেও সদস্য ভেদে দারিদ্র্যের মাত্রা ভিন্ন হয়। দেখা যায়, নারী সদস্যটিই উচ্ছিষ্ট খাদ্য গ্রহণ করে অপুষ্টিতে ভুগছে কিংবা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে আয় করতে পারছে না।
আমরা দেখছি যে, শিক্ষা ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নারীরা উল্লেখযোগ্য হারে অগ্রগতি লাভ করেনি। উচ্চতর শিক্ষায় নারী শিক্ষার্থীর হার প্রাথমিক পর্যায়ের চেয়ে অনেক কম। নারী শিক্ষার্থীর পেছনে একটি পরিবার ব্যয় করে পুরুষ শিক্ষার্থীর চেয়ে কম। শিক্ষার এই হারের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে নারী কতটা পিছিয়ে আছে আমরা পর্যবেক্ষণ করতে পারি। বাংলাদেশে নারীর শিক্ষার শুরুটাই হয়েছে কিছুটা দেরি করে। সেই সময়টুকু আমাদের পুষিয়ে নিতে হবে। সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অগ্রগতি হবে নারীর। একজন নারী অর্থনৈতিক স্বাধীনতার মধ্য দিয়ে আত্মবিশ্বাসী হবেন। দৃঢ়চিত্তে নিজের কাজ করবেন। নারী নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলবেন। এবং নিজেকে যোগ্যতর করে তোলার সেই সিঁড়ির ধাপে ধাপে রাষ্ট্রের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো থাকতে হবে।