Published in কালের কন্ঠ on Tuesday, 16 January 2018
‘অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অগ্রগতি হয়েছে’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির বিশেষ ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, ‘নির্বাচনী বছরে সরকারের নীতিনির্ধারকরা সাধারণত নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব ও আলোকপাত করে থাকেন। তাই এ সময় দেশের অর্থনীতি একটু ঝুঁকির মধ্যেই থাকে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকা দরকার।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতিতে যে স্থিতিশীলতা ছিল, আমরা ইতিবাচক ফলও পেয়েছি। প্রবৃদ্ধিতে কিছুটা তরণ হয়েছে, বিনিয়োগে সেটা দেখা গেছে। কিন্তু ২০১৭ থেকে যখন ২০১৮ সালের দিকে যাচ্ছি, অর্থনীতিতে বেশ কিছু ঝুঁকি আমরা লক্ষ করছি। ইতিবাচক দিকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এর ভেতরের বেশ কিছু দিকে বাড়তি নজর দিতে হবে।’
রবিবার বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের টক শো রাজকাহনে ‘নির্বাচনী বছরে অর্থনীতির ঝুঁকি’ শীর্ষক আলোচনায় ড. মোস্তাফিজুর রহমান এসব কথা বলেন।
প্রণব সাহার সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘২০১০ সালের খানা জরিপ আর ২০১৬ সালের খানা জরিপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দারিদ্র্য ৩২ থেকে ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু ২০০০ থেকে ২০০৫ ও ২০০৫ থেকে ২০১০ সালে যে হারে দারিদ্র্য কমেছে, ১ দশমিক ৮ ও ১ দশমিক ৭ হারে, ২০১০ থেকে ২০১৬ সালে এটা ১ দশমিক ২ হারে কমেছে। অর্থাৎ দারিদ্র্য নিরসন হলেও এর হার কমে এসেছে। অন্যদিকে সর্বনিম্ন আয়কারী ৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ আয়কারী ৫ শতাংশ মানুষের ব্যবধান আগে (২০১০) যেখানে ৩১ গুণ ছিল, সেটা ২০১৬ সালে এসে ১২১ গুণ বেড়েছে। এই অবস্থায় বণ্টনের বিষয়ে জোর দিতে হবে। সরকার দারিদ্র্য কমাতে কাজ করছে। কিছু ক্ষেত্রে গড় কমলেও সারা দেশে বেড়েছে। যেমন রংপুরে দারিদ্র্যসীমার নিচের অংশ ১ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে সারা দেশে প্রায় ৮ শতাংশ কমেছে। তাই নীতিনির্ধারকরা যাতে এই চিত্রের দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে কাজ করতে পারেন সেদিকে আমরা দৃষ্টিপাত করেছি। সরকারকে সতর্ক করেছি।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সময়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ধারাবাহিক অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু এই অগ্রগতির পেছনে বণ্টনের দিকগুলোও দেখতে হবে। সেটার বণ্টন ঠিক হয়নি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী দেখবে যে তারা কী পেল। তাদের সংখ্যা অনেক। ভোটের রাজনীতিতেও তাদের গুরুত্ব অনেক বেশি।’
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশের যে উন্নতি ও অগ্রগতি হয়েছে সেটা সবাই জানি। এটা আমাদের গর্বেরও বিষয়। যেমন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। কিন্তু এর সঙ্গে যে ঝুঁকিও বেড়েছে, সেটাও দেখতে হবে। সরকারি উদ্যোগের কারণে মঙ্গা বা দারিদ্র্যসীমার অংশ কমেছে। কিন্তু রংপুর এলাকায় দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকার সংখ্যা ৪৬ থেকে ১ শতাংশ বেড়েছে। এগুলো থেকে নীতিনির্ধারকদের সতর্ক হতে হবে। কী ধরনের প্রগ্রাম নিলে আরো উন্নতি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করবেন। এ জন্য এগুলো ধরিয়ে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। যেমন নতুন ব্যাংকগুলোর কী অবস্থা, আরো ব্যাংক অনুমোদন দেওয়ার আগে এগুলো দেখতে হবে। নজরদারি আরো বাড়াতে হবে।’
আলোচনায় অংশ নিয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট-পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘নির্বাচনী বছরে সরকারও সতর্ক থাকে। তারা দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে চায়। একদিকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা। অর্থনৈতিক ভারসাম্য বা স্থিতিশীলতা নষ্ট হোক—এটা কোনো সরকারেরই চাওয়া উচিত হবে না। এটাকে আরো বিশ্লেষণ ও দূরদর্শিতার সঙ্গে দেখা উচিত। আমাদের দেশে বর্তমানে অর্থনীতিতে কিছুটা ভারসাম্যহীনতা চলে এসেছে। এখানে সরকার যথাযথ হস্তক্ষেপ করে প্রশমিত করলে সরকার, দেশ ও নাগরিকদের জন্য ভালো হবে। কারণ কিছু বিষয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা বড় রকমের পটপরিবর্তন নিয়ে আসে।’
ড. আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য এক ধরনের চাপের মুখে পড়ে গেছে। গত পাঁচ মাসে কারেন্সি পেমেন্টে কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি হয়েছে চার মিলিয়নের ওপরে। এই অবস্থা চলতে থাকলে কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। গত পাঁচ মাসে দেড় বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ লস হয়েছে। রিজার্ভ লস চলতে থাকলে আমাদের জন্য ভালো পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না। তাই সরকারের উচিত হবে, বাস্তবতার আলোকে ব্যালান্স অব পেমেন্টের ইমব্যালান্স দূর করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। বহু বড় প্রকল্প আছে, তার চাপ এখানে আসবে। যে প্রকল্পগুলো সামগ্রিকভাবে বিদেশি সাহায্যে করা হচ্ছে, সেখানে চাপটা পড়বে না। পদ্মা সেতুর মতো যেসব প্রকল্প নিজেদের অর্থায়নে করা হচ্ছে, সেখানেই চাপটা আসবে। অর্থনীতিতে ভারসাম্য না আনলে আগামীতে তা ভয়াবহ রূপ নেওয়ার আশঙ্কা আছে। সে জন্য সতর্ক হয়ে এখনই একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। ডিপোজিট ও ক্রেডিটের যে বড় ধরনের গ্যাপ রয়েছে তা কমাতে হবে।’