মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতি সুদহার বাড়ানো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ – ফাহমিদা খাতুন

Originally posted in দৈনিক সমকাল on 23 October 2024

ব্যাংক ঋণের সুদহার আরও বাড়ছে

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়বে রোববার থেকে

মূল্যস্ফীতি কমাতে নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশের অন্যতম প্রধান নীতি সুদহার রিপারচেজ অ্যাগ্রিমেন্ট বা রেপো রেট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। কার্যকর হবে আগামী রোববার থেকে। এ নিয়ে চলতি বছর পঞ্চম দফায় বাড়ছে নীতি সুদহার।

গতকাল মঙ্গলবার এ বিষয়ে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংকোচনমূলক পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নীতি সুদহার বিদ্যমান ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ১০ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে সুদের হারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে স্বল্পমেয়াদি ধার দেয়, সেটিই হচ্ছে রেপো সুদহার।

দেশে কয়েক বছর ধরে চলছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। অর্থের জোগান কমিয়ে এই মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাই নীতি সুদহার বারবার বাড়ানো হচ্ছে। এর আগে চলতি বছর চার দফা বাড়ানো হয় নীতি সুদহার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত অনুসারে, চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি রেপো হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে হয় ৮ শতাংশ। গত ৮ মে বাড়ানো হয় আরও ৫০ বেসিস পয়েন্ট। রেপো হার দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৫০ শতাংশে। এর পর ২৫ আগস্ট ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে রেপো হার করা হয় ৯ শতাংশ। সর্বশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে রেপোর সুদহার ৫০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে হয় ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ।

ঋণের সুদহার নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা

নীতি সুদহার বাড়ানোর প্রভাবে ব্যাংকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের সুদহার বাড়ে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এটি ভূমিকা রাখলেও এর প্রভাবে একদিকে গ্রাহক পর্যায়ে ঋণের খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে বেসরকারি খাতে কমছে ঋণপ্রবাহ। সুদহার বাড়ার বিরূপ প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে।

এক বছর আগে ব্যাংক ঋণে সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ৯ শতাংশ। বর্তমানে কোনো কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে প্রায় ১৫ শতাংশ সুদহার রয়েছে। সব ব্যাংক মিলিয়ে ঋণের গড় সুদহারও ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জুলাইয়ে ব্যাংক ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ৭৯ শতাংশ। চলতি বছরের আগস্টে তা বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

নীতি সুদহার আরেক দফা বাড়ানোয় ব্যাংক ঋণের সুদহারও আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা বলছেন, এমনিতেই বিগত সরকারের আমলে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম অনেক বাড়ানোর কারণে ব্যবসার খরচ বেড়েছে। এ ছাড়া গত কয়েক মাসের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সুদহার এভাবে বাড়তে থাকলে আরও বিপাকে পড়তে হবে ব্যবসায়ীদের। উৎপাদন ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ার পাশাশাশি নতুন করে খেলাপি হয়ে পড়বেন অনেকে।

এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন সমকালকে বলেন, সম্প্রতি খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন নীতি সুদহার বাড়িয়ে দুই অঙ্কের ঘরে নিয়ে গেছে। এ কারণে অনেকেই ঋণ শোধ করতে পারবে না। দেখা যাবে বছর শেষে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ বাড়বে। ঋণের বোঝা আরও বড় হবে। এ পরিস্থিতিতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, ডলার সংকটসহ নানা কারণে কয়েক বছর ধরেই ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো নয়। এর মধ্যে সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান ঘিরে অনেক দিন ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দাভাব ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন পদক্ষেপের কারণে ব্যবসা করা মুশকিল হয়ে পড়বে।

প্রসঙ্গত, সার্বিক বিনিয়োগ পরিস্থিতি বোঝার জন্য অনেক সময় মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের আমদানি এবং বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ দেখা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত জুলাই ও আগস্ট মাসে অর্থাৎ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল দুটোরই আমদানি ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তি কমেছে। মূলধনি যন্ত্রপাতির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা ৩৩ শতাংশ কম। কাঁচামালের এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৬৫ কোটি ডলারের মতো। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা সাড়ে ৪ শতাংশ কম। গত আগস্টে বেসরকারি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, যা ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।

উল্লেখ্য, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে দেশে মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের আশপাশে রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। এর আগের মাস আগস্টে ছিল আরও বেশি, প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ।

অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতি এত বেশি বেড়ে গেছে যে, সব ধরনের পদক্ষেপই নিতে হবে। কাজ না করলেও অনেক দিন সুদহারের ওপর একটি সীমা ছিল অর্থাৎ মুদ্রানীতিতে তেমন পরিবর্তন আনা হয়নি। সেজন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের সময় এসে নীতি সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। কারণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এতে ব্যবসায়ীদের ওপর চাপ তৈরি হবে। তবে সুষ্ঠু ব্যবসা পরিবেশ সৃষ্টি এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি ও অবকাঠামোগত সমস্যা দূর করতে পারলে ব্যবসায়ীদের জন্য সুবিধা হবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে একই সঙ্গে বাজেটে অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করতে হবে বলে মনে করেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, উন্নয়ন ব্যয়ের পাশাপাশি পরিচালন ব্যয়েও কাটছাঁট করতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি বাজার ব্যবস্থাপনায় সিন্ডিকেশন ভেঙে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করা দরকার। এ ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিযোগিতা কমিশনকে শক্তিশালী করে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। পণ্য পরিবহনে সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শুধু সুদের হার বাড়িয়ে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। শুল্কহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার পাশাপাশি বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনে হয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে বাজারে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এমনটি হলে দ্রুত চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি করতে হবে। মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়ানোর চেয়ে এ বিষয়গুলোতে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যেই বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এর পরও সুদহার আরও বাড়তে থাকলে ব্যবসা পরিবেশে বড় ক্ষতি হবে। তবে আশা করি, সমন্বিত উদ্যোগে দ্রুত উন্নতি ঘটবে মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে। তখন সুদহার কমানোরও সুযোগ তৈরি হবে।’

রেপোতে ধারের সুযোগ সীমিত হচ্ছে

এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা ধার করার সুযোগ আরও সীমিত করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, আগামী মাস থেকে সপ্তাহে এক দিন রেপো নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমানে সপ্তাহে দুই দিন রেপো নিলামের মাধ্যমে টাকা ধার করার সুবিধা রয়েছে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহীদের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংক গত সোমবার এ-সংক্রান্ত চিঠি পাঠিয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহের মঙ্গলবার ৭, ১৪ ও ২৮ দিন মেয়াদি রেপো নিলাম অনুষ্ঠিত হবে। তবে মঙ্গলবার ছুটি থাকলে পরবর্তী কর্মদিবসে নিলাম অনুষ্ঠিত হবে।