Originally posted in বণিকবার্তা on 11 May 2025
প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী
অর্থনীতির শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে
আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেয়ার পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে।
আর্থিক খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেয়ার পর কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। এ অবস্থায় অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এর ফলাফলগুলো হারিয়ে গেছে বা থেমে গেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী জানিয়েছেন, আর্থিক খাতের শ্বেতপত্রের সুপারিশ বাস্তবায়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
রাজধানীর বনানীতে একটি হোটেলে গতকাল ‘বাংলাদেশ ২০৩০: অংশীদারত্বমূলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে’ শীর্ষক বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই) ও নিমফিয়া পাবলিকেশনস।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘শ্বেতপত্র প্রকাশের পর অনেকের কাছে মনে হতে পারে, এর ফলাফলগুলো হারিয়ে গেছে বা থেমে গেছে। তবে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, আমি নিজে এবং আমার অনেক সহকর্মী প্রতিদিন আমাদের কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে শ্বেতপত্র প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বিবেচনায় আনছি। প্রধান উপদেষ্টাও তা করছেন।’
তিনি বলেন, ‘জনসমক্ষে তেমন অগ্রগতি দেখা না গেলেও শ্বেতপত্রের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কীভাবে সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা যায়, সেদিকেই মূল মনোযোগ রয়েছে।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘যেদিকে তাকাই, ব্যবসায়ীদের কোনো না কোনো সিন্ডিকেট সক্রিয় দেখি। আমরা যেসব কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে পারছি না, তার অন্যতম কারণ হলো ব্যবসায়ী মহলের অনেকেই সরকারের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থে গোপনে সমঝোতায় যান।’
সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত বলেন, ‘অনেকে সেমিনারে এসে বড় বড় কথা বলেন, বলেন কীভাবে কাঠামোগত পরিবর্তন দরকার। অথচ পরে দেখা যায়, তারা নিজেরাই কোনো মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে গোপনে চুক্তিতে গেছেন, যা পুরো পরিবর্তনের প্রয়াসকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।’
অনুষ্ঠানে পিআরআই ভাইস চেয়ারম্যান সাদিক আহমেদ ‘বাংলাদেশ ২০৩০: অংশীদারত্বমূলক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে’ বইটি সম্পর্কে সবাইকে অবগত করেন। তিনি জানান, এ বইয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাব্য পথ নিয়ে বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন লেদার অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর। তিনি বলেন, ‘বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বেসরকারি খাতের নেতৃত্ব বাংলাদেশ খুব দ্রুতই উপলব্ধি করতে পেরেছে। জনসংখ্যা দেশের জন্য বড় সম্পদ। তবে এ সম্পদ খুব দ্রুত দায়বদ্ধতায় পরিণত হতে পারে। আমরা এখন সংখ্যার চেয়ে গুণগত মানকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি বলে নীতিনির্ধারকরা মনে করেন।’
দেশের স্বাস্থ্য খাত উন্নত করা প্রসঙ্গে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাত উন্নত না করা গেলে প্রতি বছর বৈধ-অবৈধভাবে বিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে চলে যাবে। এটা আটকানোর সুযোগ নেই। এ খাতে বিদেশী বিনিয়োগকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। বিদেশী চিকিৎসক, নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের এ খাতে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। তবেই দেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত মান উন্নত হবে।’
নগর উন্নয়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও উচ্চ মহলের তদারকির অভাবে নগর উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অধিকাংশই বিপদে ও বিপদমুখী অবস্থায় রয়েছে। রাজধানীতে শুধু যানজটের কারণেই ১-১ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি কম্প্রোমাইজ করতে হয়।’
অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। নানা রকম চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তা সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এটি অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি রাজনৈতিক উত্তরণ, যা হতে হবে টেকসই ও অর্থবহ। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধির বিষয়ে সানেমের নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘শেষ কয়েক বছর জিডিপির ২ শতাংশ শিক্ষায় এবং স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ছিল ১ শতাংশেরও নিচে। যে দেশ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ব্যয় এত কম, সেখানে আমরা কীভাবে উন্নত জীবনধারণের আশা করব?’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘গত এক থেকে দেড় দশকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্যাটার্ন ছিল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এটি খুবই উদ্বেগের বিষয়। উন্নয়ন তিনটি স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে— অর্থনৈতিক, সামাজিক ও টেকসই পরিবেশের ওপর। বিশেষত পরিবেশের যত্ন না নিলে উন্নয়ন টেকসই হয় না। আমাদের অর্থনৈতিক নানা পলিসি আছে। কিন্তু সেগুলোর সঠিক ব্যবহার নেই। বিগত বছরগুলোয় দেশের আর্থিক খাত থেকে শুরু করে ব্যাংক খাতের কোথাও স্থিতিশীলতা ছিল না। রাজনৈতিক নানা জটিলতা ছিল। ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। এরপর তারা সংসদে গিয়ে নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে দেশের অর্থনীতিকে দেখেছেন। ফলে জনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নীতি পাল্টে গেছে। ’
ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) কান্ট্রি ম্যানেজার মার্টিন হল্টম্যান বলেন, ‘এটি একটি চমৎকার প্রকাশনা। এতে গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ, নীতিনির্ধারণী, বিভিন্ন সমস্যার সমাধান রোডম্যাপে একসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশের এ ট্রানজিশনাল পিরিয়ডে এ বইটি শিক্ষার্থী, রাজনৈতিক নেতা সবার জন্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন পিআরআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। এছাড়া আরো বক্তব্য দেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি কামরান টি রহমান।