Originally posted in বণিক বার্তা on 30 June 2024
মূল্যস্ফীতির চাপ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন, ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খলা, উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্বলতা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে যে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছে এর ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ভঙ্গুর হয়ে গেছে। অথচ বহু বছর ধরে আমরা ভালো অবস্থানে ছিলাম। আমাদের উচ্চ প্রবৃদ্ধি ও নিম্ন মূল্যস্ফীতি ছিল। বহির্খাত খুব শক্তিশালী ছিল। সেই অবস্থান থেকে আজকের এ ভঙ্গুর অবস্থানে কীভাবে এলাম? এর উত্তরে তিনটি বিষয় বলতে চাই। প্রথমত, সমস্যা কী তা স্বীকার করতে হবে। বস্তুনিষ্ঠ চুলচেরা বিশ্লেষণ থেকে আসে সমাধান। এরপর সমাধান করতে গেলে নীতির বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যে নীতিমালাগুলো দেখেছি, মোটাদাগে সেগুলো তিন ধরনের—নীতির ভ্রান্তি ও দুর্বলতা, নীতি গ্রহণে দ্বিধা এবং এ দুটোর মেলবন্ধনে হয়েছে নীতির অসারতা। অর্থাৎ নীতি অকার্যকর হয়ে গেছে। দুই বছর ধরে মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ পতনে দুরবস্থা চলছে। এক্ষেত্রে আমরা কী নীতি গ্রহণ করলাম? সংকটের সময় কোনো উদ্ভাবনী নীতির দরকার পড়ে না, প্রথাগত নীতি আঁকড়ে ধরতে হয়। মূল্যস্ফীতি কমানোর মৌলিক নীতি হলো বাজারে মুদ্রা সরবরাহ কমানো ও সুদের হার বাড়িয়ে দেয়া। সারা বিশ্ব এ নীতি অনুসরণ করেছে। কিন্তু আমরা এ পথে অগ্রসর হইনি। কভিডকালে সুদহারের নয়-ছয় নীতি করেছিলাম। কাদের সঙ্গে আলাপ করে এটি করা হয়েছিল সেটিও আমরা জেনেছি। কিন্তু এর ফলে কি বিনিয়োগ এসেছে, ব্যক্তি খাতে কর্মসংস্থান বেড়েছে? এমন কিছুই ঘটেনি। একদিকে আমরা বাজারভিত্তিক অর্থনীতির কথা বলছি, অন্যদিকে চরম নিয়ন্ত্রণমূলক অর্থনৈতিক নীতিমালা বজায় রেখেছি। যার ফলে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। উল্টো ২৪ মাস ধরে এটি বেড়েই চলেছে; ১৫ মাসের বেশি সময় ধরে ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে—১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। অথচ ‘তারা’ বলেছিলেন সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি উন্নত দেশের জন্য কার্যকরী সমাধান, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য নয়। আমরা ব্যতিক্রমী বা উদ্ভাবনী কিছু চিন্তা করব। কিন্তু সময়টা আলাদা কিছু চিন্তা করার সময় না। এমন সংকটের সময়ে মৌলিক নীতিই অনুসরণ করতে হয়।
আমাদের কাছের দেশ শ্রীলংকার মূল্যস্ফীতি প্রায় ৭০ শতাংশে পৌঁছেছিল। দেশটির অর্থনীতি খাদে পড়েছিল। আর আমরা সেই খাদের কিনারায় দাঁড়ানো। শ্রীলংকা কীভাবে খাদ থেকে উত্তরণে সফল হলো? এর পেছনে রয়েছে সঠিক সময়ে সঠিক নীতি গ্রহণ ও স্বাধীনভাবে কাজ করার সুবিধা। আমাদের দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতিই বলে দিচ্ছে আমরা যথাসময়ে সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছি।
নীতি অকার্যকর হওয়ার আরেকটি উদাহরণ হলো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পতন। রিজার্ভ ক্রমে নিম্নমুখী। এ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই। আমরা ডলার বিনিময় হারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান ধরে রাখতে চেয়েছি যেন জিডিপিতে মাথাপিছু আয় বেশি দেখানো যায়। আমাদের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এটি এক ধরনের ধারণাগত ভুল। যেখানে ভারত, চীন, ভিয়েতনামসহ অন্য দেশ ডলারের বিপরীতে মুদ্রার মান অবমূল্যায়ন করল, সেখানে আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় টাকা শক্তিশালী করে রাখা হয়। এরপর হঠাৎ করেই টাকার মানের অবমূল্যায়ন করা হলে সেই চাপ গিয়ে পড়ে আমদানিতে। রিজার্ভ ক্ষয় বাড়তে থাকে। পরবর্তী সময়ে এ পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে (বাজারভিত্তিক সুদহার ও ক্রলিং পেগ) সেগুলোও সময়মতো গ্রহণ করা হয়নি। দেরিতে গ্রহণ করা হয়েছে, সেটিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে। অথচ দেশের অর্থনীতিবিদরা এসব সুপারিশ অনেক আগে থেকেই করে আসছেন যা গ্রহণে আমাদের এক ধরনের মানসিক প্রতিবন্ধকতা দেখা যায়। অবশ্য অনেক সুপারিশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু মনে রাখা দরকার মুদ্রানীতি এককভাবে কাজ করে না। আর্থিক নীতির সঙ্গে এর সামঞ্জস্যতা রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে আর্থিক কাঠামো সংস্কারের কোনো প্রাক্কলন নেই।
বাজেটে কী আছে, কীভাবে আছে ও কী নেই—এ তিন দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বিচার করি—বাজেটে মধ্যমেয়াদি প্রাক্কলনগুলো গতানুগতিক চিত্র ভেবেই স্থির করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আইএমএফের কথা শুনে যোগ-বিয়োগ করে নতুন বাজেট করা হয়েছে। বাজেটে দুটি সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়া যেত—মূল্যস্ফীতি কমানো ও সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া।
প্রস্তাবিত বাজেটে উন্নয়ন বাজেট ও পরিচালন ব্যয় সমন্বয় করা হয়নি। অথচ সংকটের সময়ে কৃচ্ছ্রসাধন দরকার। কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য অনেক পরিচালন ব্যয় কাটছাঁট করা সম্ভব যেটি আমরা কভিডের সময় দেখেছি। পাশাপাশি উন্নয়ন বাজেটও কমানো যেত। বড় বড় মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে চারটি এ বছর আর ছয়টি ২০২৫ সালে শেষ হওয়ার কথা। প্রতি বছর স্বল্প বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্পগুলোকে চলমান রাখার তো কোনো দরকার নেই। বরং যেগুলো শেষের পথে কেবল সেগুলোর জন্য বরাদ্দ দিয়ে প্রকল্প দ্রুত সম্পন্ন করা যেত। পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেট সমন্বয়ের অভাবে আসন্ন অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি রাখা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। গত বছর এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। তাহলে মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টা কীভাবে করা হলো? আর মানুষকে স্বস্তি দেয়া যেত সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দের মাধ্যমে। কিন্তু এ খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ।
সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর বিষয়টি যদি জিডিপির শেয়ারে বা মোট বাজেটের আকারে দেখি—সামান্য একটু পরিবর্তন হয়েছে। বাজেটের হিসাবে দেখলে গত বছর যেটা ১৭ শতাংশ, এ বছর সেটা ১৭ দশমিক ১ শতাংশ। জিডিপির আকারে দেখলে সেক্ষেত্রেও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এখানে শুভঙ্করের ফাঁকি আছে। এ খাতের বরাদ্দ ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। বিস্তারিত দেখলে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে রয়েছে সরকারি কর্মচারী ও তাদের পরিবারদের পেনশনের টাকা, সঞ্চয়পত্রের সুদের অর্থ, কৃষি খাতে ভর্তুকি, মুক্তিযোদ্ধাদের যে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ খাতে। এগুলো করার ফলে এ খাতের বরাদ্দে একটা বড় অ্যামাউন্ট দেখা যায়। কিন্তু সেগুলো যদি বাদ দেয়া যায় তাহলে কিন্তু খুব একটা বাড়েনি, বরং কমেছে। তবে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সরকার বেশকিছু পণ্যের ওপর কর ছাড়ের প্রস্তাবও করেছে। এটি একটি ভালো প্রস্তাব। কিন্তু বিষয়টি হচ্ছে কীভাবে তা বাস্তবায়ন হবে। দেখা যায় কর কমানোর পর বাজারে পণ্যের দাম সেই অনুপাতে কমে না, এক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। করের দোহাই দিয়েই মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়, বাজার মনিটরিং করা হয় না।
বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রতি বছরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। যদিও রাজস্ব বোর্ডের ওপর দেয়া লক্ষ্যমাত্রা গত ১০ বছরে কোনোভাবেই পরিপালন করা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরে যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছিল সেটার তুলনায় আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। অথচ চলতি বছরের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ঘাটতি রয়ে গেছে। তাই লক্ষ্যমাত্রাটা বাস্তবসম্মতভাবে করা উচিত। রাজস্ব আহরণের জন্য অনেক প্রচেষ্টা দেখছি। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জুসের ওপর, মোবাইল ফোনের টকটাইমের ওপর, পার্কে প্রবেশ ফির ওপরে দেয়া হচ্ছে। এগুলো তো ভোক্তাদের ওপরে গিয়ে পড়ে। বিদ্যমান কাঠামো দিয়ে বেশি রাজস্ব আহরণ সম্ভব নয়। এছাড়া করনীতি ও কর প্রশাসন এখনো আলাদা নয়। আবার অনেকে কর দিতেও চান, ভাবেন সৎভাবে বেঁচে থাকার কথা। কিন্তু তা নেয়ার সক্ষমতা নেই সরকারের। তাই কর কাঠামোর সংস্কার প্রয়োজন। কর কাঠামোর সঙ্গে প্রযুক্তির সংযোগ ঘটিয়ে এ ব্যবস্থার সরলীকরণ আবশ্যক। আরেকটি সংস্কারের কথা অর্থনীতিবিদরা সর্বদাই বলে আসছেন তা হলো ব্যাংক খাতের সংস্কার। ব্যাংক খাতকে অর্থনীতির ‘প্রাণকেন্দ্র’ বলা হয়। বিভিন্ন খাতকে চলমান রাখার জন্য দরকার ভালো ব্যাংক খাত। অথচ খাতটি ভঙ্গুর থেকে ভঙ্গুরতর হয়ে গেছে। এ খাতে সাধারণ মানুষের জন্য কিছু নেই, আস্থাও নেই। কিছু ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে গড়িমসি করে। ব্যাংক খাত গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা করে চলছে। এ খাতে চালু হয়েছে ঋণ পুনঃতফসিল করার সংস্কৃতি এবং নতুন নতুন কায়দায় তা করা হচ্ছে। ২ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে বারবার পুনঃতফসিল করার সুযোগ দেয়া হয়েছে কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া। এতে মানুষের আস্থার জায়গাটা ভেঙে গেছে। জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে তা ফিরিয়ে আনবেন, সেটাও এ বাজেটের একটা লক্ষ্য হওয়া উচিত।
আমরা কেবল প্রবৃদ্ধির কথা বলছি। কিন্তু এ প্রবৃদ্ধি আমাদের কী দিল? আয়বৈষম্য তো বাড়ছেই। পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির সক্ষমতা কমে গেছে অর্থনীতির। বলা হচ্ছে, বেকারত্বের হার ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এ হিসাব কীভাবে করা হয়, তা তো আমরা জানি। সপ্তাহে ১ ঘণ্টা কাজ করলেও তা যুক্ত হচ্ছে। বাস্তবে বেকারত্বের হার ১০ দশমিক ৬ শতাংশ। কিছুদিন আগে একটি পত্রিকায় এসেছে, চাকরির জন্য এসএসসি পাস দরকার, অথচ আবেদন বেশি এসেছে মাস্টার্স পাস প্রার্থীদের কাছ থেকে। এর পরও যে চাকরিগুলো সৃষ্টি হচ্ছে সেগুলো অনানুষ্ঠানিক খাতে। যতটুকু প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তার বেশির ভাগই অনানুষ্ঠানিক খাত থেকে আসা। শিল্প খাতে ৯০ শতাংশের বেশি এবং সেবা খাতে ৬৭ শতাংশের বেশি অনানুষ্ঠানিক খাতের অবদান। অথচ অনানুষ্ঠানিক খাতের কর্মীদের আয় কম ও কাজের নিশ্চয়তা নেই। তবু বাজেটে শ্রমবাজার সংস্কারের কোনো লক্ষ্যমাত্রা নেই। আরেকটি সংস্কারের কথা না বললেই নয়—প্রশাসনিক সংস্কার। আগেও একবার বলেছি বড় বড় মেগা প্রকল্প সময়মতো শেষ হয় না। অথচ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে, ব্যয় হচ্ছে। এ খাতে জবাবদিহির সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সরকারি সেবা দেব, কিন্তু জবাবদিহির বাইরে থাকব, তা ঠিক নয়। নিজেরা জবাবদিহির বাইরে থাকলে অন্যদের কীভাবে এর মধ্যে আনবেন?
ক্ষমতাসীন ও দুর্নীতিবাজদের সুবিধা দেব, অন্যদেরও ছিটেফোঁটা এদিক-সেদিক দেব—এমন অনুমিতি ও দর্শনের ওপর ভিত্তি করেই বাজেট করা হয়েছে। অন্যরা তা গ্রহণ করলে করুক, চিৎকার করলে করুক, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই সরকারের। এসব পদক্ষেপের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি নেই। নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিকে অবজ্ঞা করে বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টির কাজ করা হচ্ছে।
বাজেট বক্তব্যের শুরুর দিকে ভালো ভালো কথা থাকে। তা কাজে লাগানো হয় না। বরং সুবিধাবাদীদের স্বার্থ রক্ষায় করের প্রস্তাব দেয়া হয়। এ ধরনের নৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তিহীন দর্শন যে বাজেটে থাকে, তাতে সংবিধানে উল্লেখিত বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার মূল উদ্দেশ্য ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আর প্রস্তাবিত বাজেটে আমরা এর ব্যতিক্রম দেখিনি।
– ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)