দৈনিক প্রথম আলো
প্রস্তাবিত পদ্মা বহুমুখী সেতু নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক যেন শেষ হতে চায় না। অতিসম্প্রতি তিনটি ঘটনা এ বিতর্কে নতুন আলো ও উত্তাপ উভয়ই ছড়াচ্ছে। প্রথমত, বাংলাদেশ ও কম্বোডিয়ায় দুর্নীতি করার জন্য বিশ্বব্যাংক তার কাজকর্ম থেকে কানাডীয় প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। দ্বিতীয়ত, কানাডায় পদ্মা সেতু-সম্পর্কিত দুর্নীতির মামলায় বিচারক লাভালিন কোম্পানির বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়েছেন। তৃতীয়ত, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরামর্শক লাভালিন তার আয়ের ১০ শতাংশের ওপর আরও ২ শতাংশ উৎকোচ হিসেবে কোনো অজ্ঞাত ব্যক্তিকে দেওয়ার জন্য বরাদ্দ করে বলে জানা যায়। আগামী মাসের শেষে মূল বিচারকাজ শুরু হলে সেই নামগুলো জানা যেতে পারে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লাভালিনের দুর্নীতির প্রলম্বিত কালো ছায়া থেকে পদ্মা সেতু প্রকল্প তথা বাংলাদেশ খুব সহজে মুক্তি পাচ্ছে না।
সরকারে তিন ধারা
২০১২ সালের ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক চুক্তি বাতিল করার পর পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে সরকারের ভেতর তিনটি ধারা লক্ষ করা যায়। প্রথম ধারাটি বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঋণচুক্তিটি পুনর্বহালের পক্ষে মত দেয়। দ্বিতীয় ধারাটি বিভিন্ন জাতীয় উৎস থেকে পুঁজি সংগ্রহ করে স্ব-অর্থায়নে প্রকল্পটি নির্মাণ করার ওপর জোর দেয়। তৃতীয় ধারাটি বিদেশি উৎস থেকে বাণিজ্যিক ঋণ সংগ্রহের মাধ্যমে প্রকল্পটি নির্মাণের পক্ষে উৎসাহ দেখায়। ২০১২ সালের পুরো শেষ ভাগজুড়ে ছিল এ তিন ধারার পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য-বিশ্লেষণের ছড়াছড়ি।
সরকারের প্রচেষ্টায় বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তিটি ২০১২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর পুনর্বহাল করার পর মনে হয়েছিল, উপরিউক্ত প্রথম ধারাটি জয়যুক্ত হয়েছে। কিন্তু ২০১৩ সালের ৬ জানুয়ারি দুদকের তৎপরতায় সন্তুষ্ট না হয়ে যখন বিশ্বব্যাংকের নিয়োজিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দল ভগ্ন মনোরথে ফিরে গেল, তখন মনে হলো, প্রথম ধারাটি অবশেষে পরাজিত হলো। ৩১ জানুয়ারি সরকার বিশ্বব্যাংকের কাছে ঋণের অনুরোধ প্রত্যাহার করে নিলে আবার মালয়েশিয়া ও পরবর্তী সময় চীনের প্রকল্প প্রস্তাব বিবেচিত হতে থাকে। তখন মনে হলো, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদেশি ঋণ নেওয়ায় আগ্রহী গোষ্ঠী সরকারের মধ্যে এখনো বলীয়ান। আগামী বাজেটের পরিপ্রেক্ষিতে স্ব-অর্থায়নে প্রকল্পটি নির্মাণে অর্থাৎ উপরিউক্ত দ্বিতীয় ধারায় সরকার এগোতে চাইছে বলে মনে হয়।
একটি স্বাধীন দেশ তার বিকাশমান অর্থনীতির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের জন্য নিজস্ব অর্থ ব্যবহার করবে—এ আকাঙ্ক্ষা বোধগম্য। কিন্তু মাথাপিছু জাতীয় আয়ের ও অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের নিম্ন হারের কারণে আমাদের মতো দুর্বল অর্থনীতির দেশের বিপুল উন্নয়ন চাহিদা শুধু দেশীয় বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। তাই ত্বরান্বিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে নিম্ন আয়ের দেশের জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান রেয়াতি সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে, বিশেষ করে ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো নির্মাণের জন্য। তাই স্বাভাবিকভাবেই পদ্মা সেতু প্রকল্প যখন প্রথম প্রণয়ন করা হয়, তখন সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত অর্থায়নের উৎস হিসেবে এসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাই ভবিষ্যতে আমরা যদি অন্য যেকোনো উৎস থেকে অর্থায়ন করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করি, আর্থিক বিচারে সেটি হবে ‘দ্বিতীয় চয়ন’—সর্বোত্তম পথ নয়। এ কারণে জাতিকে অবশ্যই একটা বাড়তি আর্থিক দায় ভবিষ্যতে বহন করতে হবে।
স্ব-অর্থায়নের তাৎপর্য
আগেই বলেছি, স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের অভিপ্রায় বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি বাতিল করার পর সামনে আসে। তবে আগামী অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে বর্ধিত বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে সরকার তার সংকল্পের বস্তুগত ভিত্তি দিতে চাইছে। কিন্তু এ বরাদ্দের বেশ কিছু ঘাত-প্রতিঘাত রয়েছে।
উল্লেখ্য, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো সরকারের আর্থিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয় ২০০৭-০৮ সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে, অর্থাৎ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা, যার ৬৮ শতাংশ আসার কথা ছিল বৈদেশিক প্রকল্প সাহায্য থেকে। ২০১১-১২ সালে এসে প্রকল্প ব্যয় দ্বিগুণ করে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। একই সঙ্গে বৈদেশিক সাহায্যের অংশ বেড়ে হয় ৭৯ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানগুলো বলে, প্রকল্প সংশোধনের সময় সেতুর বর্ধিত ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশীয় অর্থের জোগান দেওয়া সম্ভব হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে ছয় বছর ধরে (২০০৮-২০১৩)। এ সময়কালে বৈদেশিক সাহায্যের চুক্তিটি কার্যকর না হওয়ায় এখনো ব্যয়ভার পুরোটাই নির্বাহ হয় মূলত স্থানীয় অর্থে, যার পরিমাণ সংশোধিত প্রকল্পের ৭ শতাংশের কম। আগামী অর্থবছরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুকূলে ছয় হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা যায়।
লক্ষণীয়, সরকার আগামী অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির আয়তন বাড়াবে প্রায় ১০ হাজার ৬০০ কোটি টাকার মতো। এ বর্ধিত অঙ্কের ৫৭ শতাংশ চলে যাবে পদ্মা সেতুর বাড়তি বরাদ্দ হিসেবে। অর্থাৎ বাদবাকি সব নতুন-পুরোনো প্রকল্পের জন্য থাকবে মাত্র চার হাজার কোটি টাকার মতো। তুলনায় বলা যায়, চলমান অর্থবছরে পুরোনো ও নতুন প্রকল্পগুলো পেয়েছিল বাড়তি নয় হাজার কোটি টাকার ওপরে। এ ক্রমবর্ধমান চাহিদার মুখে বিভিন্ন খাত প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম বরাদ্দ পাবে আসন্ন বাজেটে। হয়তো শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী ইত্যাদি খাত বেশি চাপের মুখে পড়বে।
এ উদ্বেগের কারণ হলো, শিক্ষা খাতে বরাদ্দ টাকার অঙ্ক সামান্য বাড়লেও সাম্প্রতিক কালে মোট বাজেটের অংশ হিসেবে তা কমে গেছে। ২০১০-১১ সালে এটি ছিল ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০১১-১২ তে তা নেমে আসে ১২ দশমিক ১ শতাংশে ও ২০১২-১৩তে ১১ দশমিক ২ শতাংশে। একই রকমভাবে মোট বাজেটের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ ২০১০-১১ সালের ৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ২০১১-১২ সালে হয়েছে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০১২-১৩ সালে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। দেশজ আয়ের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ২০১২-১৩ সালে ১ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। আর সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী খাতে এ নেতিবাচক প্রবণতা আরও সুস্পষ্ট।
এর মূল কারণ হচ্ছে, সাম্প্রতিক কালে, বিশেষ করে গত বছর সরকারের ভর্তুকি বাবদ ব্যয় প্রচণ্ডভাবে বৃদ্ধি পায়। উপরন্তু এ বর্ধিত ব্যয় নির্বাহ করার লক্ষ্যে সরকার বড় পরিমাণ কর্জ নেয়। ফলে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধজনিত ব্যয় বেড়ে যায়। তাই বাজেটের বিভিন্ন কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মধ্যে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধানে সরকার সামাজিক খাতগুলোয় প্রান্তিক বরাদ্দ বৃদ্ধি কম করেছে।
সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্পে ২০১৪-১৫ সালে সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা ও ২০১৫-১৬ সালে পাঁচ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেবে বলে জানা যায়। সে ক্ষেত্রে আগামী বছরগুলোয় সামাজিক খাতে বরাদ্দ যথোপযুক্ত বৃদ্ধি না পাওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাবে। এর পরও প্রশ্ন উঠতে পারে, বছর বছর উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ দিয়ে নামী-দামি বিদেশি ঠিকাদার নির্মাতাদের আকর্ষণ করা যাবে কি না।
এ পরিস্থিতিতে বিনিয়োগযোগ্য সম্পদের অপ্রতুলতা নিরসন করতে হলে সরকারকে দেশীয় সম্পদ আহরণ বাড়াতে হবে এবং বিদেশি উৎস থেকে পুঁজি আনতে হবে। লক্ষণীয়, পদ্মা সেতুর স্ব-অর্থায়নের প্রস্তাবের পাশাপাশি এখনো নতুন উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের প্রস্তাব আসছে বলে জানা যায়নি। পদ্মা সেতুর অর্থায়নের জন্য স্থানীয় মুদ্রার বহুল ঘোষিত যে হিসাবটি খোলা হয়েছিল, সংবাদপত্র থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সেখানে দুই লাখ টাকার কম জমা পড়েছে। সরকার পদ্মা সেতুর জন্য এ বাজেটে কোনো লেভি আরোপ করবে—এমনটাও শোনা যাচ্ছে না। অন্যদিকে রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিভিন্ন কারণে কমে এসেছে। শোনা যায়, সরকার ‘লাভজনক’ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে চাইছে।
পুঁজিবাজার থেকে অর্থ উত্তোলনের প্রস্তাব বিভিন্ন সময়ে উপস্থাপিত হলেও একটি সুগ্রথিত ও স্বচ্ছ বিনিয়োগ প্রকল্প হিসেবে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার জন্য যে প্রক্রিয়া শুরু করা দরকার, তার লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে, অনাবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে সুনির্দিষ্টভাবে পদ্মা সেতুর জন্য বৈদেশিক মুদ্রায় বন্ড বা শেয়ার বিক্রির আলোচিত উদ্যোগেরও অগ্রগতি হয়েছে বলে লক্ষ করা যায় না। যে ক্ষেত্রে কিছুটা নড়াচড়া দেখা যায়, তা হলো রাষ্ট্রীয় বন্ড ছেড়ে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে ঋণ বা সভরেন বন্ডের মাধ্যমে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ কোটি ডলার আহরণের প্রস্তাব। বাংলাদেশের জন্য সভরেন বন্ড ছাড়ার এটাই সর্বোৎকৃষ্ট সময় কি না, তা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। এ মুহূর্তে সরকারের হাতে রয়েছে শুধু বিদেশি মুদ্রায় ভারত সরকার প্রদত্ত ২০ কোটি ডলার।
পদ্মা সেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় প্রকল্প এবং তার দ্রুততম বাস্তবায়ন সবাই চায়। কিন্তু স্ব-অর্থায়নে তা নির্মাণের জন্য আগামী বাজেটে বর্ধিত বরাদ্দ প্রদানের মাধ্যমে এক পা এগোলেও বাড়তি দেশি-বিদেশি সম্পদ সংগ্রহের উদ্যোগে সরকারের দুই পা পিছিয়ে আছে। তাই মনে হয়, পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা আগামী বছরের বাজেট বরাদ্দের মধ্য দিয়ে শেষ হচ্ছে না।