দৈনিক প্রথম আলো
শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাতিল করে দিল। আমাদের সবচেয়ে খারাপ আশঙ্কাটি সত্য হয়ে গেল। যা হলো, তা খুবই দুঃজনক। যে কথিত কারণে তা হলো, সেটি আরও বিব্রতকর।
বাংলাদেশের দ্রুততর ও ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়নের জন্য পদ্মা বহুমুখী সেতু একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় স্থাপনা। এই সেতু দেশের অনুন্নত দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে, বাংলাদেশের প্রায় তিন কোটি মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে, উন্নয়ন বেগবান হবে দেশের এক-তৃতীয়াংশ স্থলভাগে। এই সেতু দিয়ে শুধু পরিবহন নয়; যাবে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও ফাইবার অপটিকস। ফলে দেশজ আয় বাড়বে কয়েক শতাংশ। বাংলাদেশ আঞ্চলিক সহযোগিতার যে নতুন প্রয়াস নিয়েছে, সেখানেও এই সেতুর ভূমিকা অপরিসীম। প্রকল্পটি সম্পন্ন করা ছিল বর্তমান সরকারের একটি আকর্ষণীয় নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। তাহলে কেন হলো তার এ রকম পরিণতি?
লক্ষণীয়, বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর সরকারের মূল প্রবণতাটা ছিল সম্পূর্ণ অস্বীকারের মনোভাব। উচ্চপর্যায়ের মন্ত্রী-কর্মকর্তা বদল, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সংযুক্ত করা, ওয়াশিংটনে দেনদরবার ইত্যাদি করা হলেও উন্নয়ন সহযোগীরা এসব পদক্ষেপের আন্তরিকতা সম্বন্ধে হয়তো নিশ্চিত হতে পারেনি, যার ফলে আস্থার সম্পর্কে ফাটল বন্ধ করা যায়নি। বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ প্রস্তাবগুলো নিয়ে সরকার কোনো গঠনমূলক আলোচনা করল কি না, তাও স্পষ্ট নয়।
কানাডা সরকার যখন প্রকল্প পরামর্শক কোম্পানির বিরুদ্ধে তল্লাশি, গ্রেপ্তার, ব্যবসা বন্ধ ইত্যাদি ব্যবস্থা নিল, তখনো আমরা হয়তো মনে করেছি এর প্রতিফল আমাদের ছুঁতে পারবে না। আমাদের মূল যুক্তি ছিল বাংলাদেশ এখনো যেখানে কোনো বৈদেশিক অর্থ পায়নি, তাহলে তা তছরুপ করবে কীভাবে? আমরা বুঝতে চাইনি পরিবর্তিত বৈশ্বিক আর্থরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বৈদেশিক সহযোগিতা সম্পর্কিত দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরও অনেক উচ্চ মানদণ্ডে খুঁটিয়ে দেখা হচ্ছে। তাই ‘সম্পাদিত দুর্নীতি’ আর ‘দুর্নীতির অভিপ্রায়’কে সমভাবেই গর্হিত মনে করা হয়।
সরকার হয়তো মনে করেছে যে শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক সর্বোচ্চ কঠিন সিদ্ধান্তে যাবে না, কিন্তু খেয়াল করেনি মাত্র দুই বছর আগে কম্বোডিয়ায় একটি প্রকল্প বাস্তবায়নকালে উচ্ছেদকৃত মানুষকে পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সরকারের নিজস্ব ভূমিনীতির বরখেলাপ হওয়ায় সে দেশের সব সাহায্য স্থগিত করে দেওয়া হয়। হয়তো মনে করা হয়েছিল, বিশ্বব্যাংকের নতুন প্রেসিডেন্ট এলে বিষয়টি সুরাহার নতুন সুযোগ হবে—তবে অভিজ্ঞ লোকেরা সর্বদা বলেছে, এটা প্রাতিষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সময়সীমা হলো জুলাই মাসের শেষ।
চুক্তি বাতিল করার ঘোষণায় বিশ্বব্যাংক বলেছে, তাদের কাছে ‘দুর্নীতির চক্রান্তে উচ্চপর্যায়ের সংশ্লিষ্টতার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ আছে। দুর্ভাগ্যজনক হলো, বিশ্বব্যাংক ও সরকারের মধ্যে উল্লিখিত প্রমাণাদি নিয়ে ছায়াযুদ্ধ হলো, কিন্তু নাগরিকেরা বিস্তারিতভাবে কিছুই জানতে পারল না। বিশ্বব্যাংকও তাদের কথিত ‘বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ উন্মোচন করল না। ফলে তথ্যের জায়গায় গুজব স্থান করে নিল, বিভ্রান্তি বাড়ল। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্যমূলক পদক্ষেপ নিল কি না, সে সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারলাম না।
বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উন্নয়ন সহযোগী। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। পদ্মা সেতু নিয়ে বিতর্ক সত্ত্বেও বিদায়ী অর্থবছরে আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে পেয়েছি প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলার, যা আমাদের এ বছরে পাওয়া মোট বৈদেশিক সাহায্যের এক-চতুর্থাংশের মতো। বিশ্বব্যাংক আগামী বছরগুলোতে প্রতিবছর ১০০ কোটি মার্কিন ডলার করে বাড়ানোর কথা বলেছিল। এই প্রতিশ্রুত সাহায্যপ্রবাহের ওপর পদ্মা প্রকল্পের অপ্রত্যাশিত পরিণতি কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, সে উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংক বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতিসহ অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের প্রায় ১৫০ কোটি মার্কিন ডলারের সাহায্য বাতিল করেছে। তবে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য কার্যক্রম আপাতত অব্যাহত থাকছে বলে মনে হয়। কিন্তু পদ্মা সেতু সমস্যার নিরসন না হওয়ায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে সরকারের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগীদের বার্ষিক বৈঠক আর আয়োজন করা সম্ভব হয়নি।
এটা অবশ্য নিশ্চিত, বিশ্বে তার দুর্ভাগ্যজনক ভাবমূর্তি পরিবর্তনে বাংলাদেশ সম্প্রতি যেসব ইতিবাচক ইঙ্গিত দিচ্ছিল, তা একটা বড় ধাক্কা খাবে। এটা সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা দেবে। আমাদের আন্তর্জাতিক সুহূদদের হতোদ্যম করবে। মনে রাখতে হবে, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে বিভিন্ন বিষয়ে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অধ্যাপক ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক ত্যাগ করতে বাধ্য করা, অব্যাহত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যক্তিবিশেষের নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, শিল্পশ্রমিকদের মজুরি নিয়ে অসন্তোষ ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতিজনিত অভিযোগে পদ্মা সেতু চুক্তি বাতিল হওয়া নতুন মাত্রা যোগ করবে। যারা আমাদের বিদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্ক দেখভাল করার দায়িত্বে আছেন, তারা এই উদ্বেগজনক প্রবণতাটি বিবেচনায় নিয়েছেন কি না, তা বলা কঠিন।
বাংলাদেশকে এখন দ্রুততার সঙ্গে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার লক্ষ্যে অন্তর্দর্শী হতে হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে যত দেরি হবে, তত প্রকল্প-ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সে ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অর্থায়নের ক্ষেত্রে তার কাছে মোটা দাগে তিনটি বিকল্প আছে। প্রথমত, সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থে এটা নির্মাণ করার কথা চিন্তা করা যেতে পারে। বলা বাহুল্য, সরকারের আয়-ব্যয়ের পরিস্থিতি বর্তমানে যা, তাতে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থে প্রকল্প-ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব নয়। এ দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় বা পুঁজিবাজারে তারল্য পরিস্থিতি যা, তাতে এ বিপুল পরিমাণ সম্পদ সমাবেশ সহজসাধ্য নয়। সর্বোপরি মনে রাখতে হবে, আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ এমন নয় যে প্রকল্পের সমস্ত আমদানি-ব্যয় আমরা দেশীয় মুদ্রায় মেটাতে পারব। এ ছাড়া অন্যান্য কারিগরি বিষয় তো রয়েছেই।
দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে, বিদেশ থেকে বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ করে সরকার ব্যক্তি খাতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সেতুটি নির্মাণ করতে পারে। কিন্তু তাতে প্রকল্প ব্যয় এবং সেই ব্যয় পরিশোধজনিত দায় যা হবে, তাতে সেতু ব্যবহারকারীদের মাশুল হবে অত্যন্ত বেশি। এর ফলে সেটি আর্থসামাজিকভাবে যৌক্তিক ও টেকসই হবে না। এ ক্ষেত্রে সুদের হার হবে ৩ থেকে ৫ শতাংশের মতো, যেখানে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সুদের হার ১ শতাংশেরও কম। পরিশোধের সময়সূচিও প্রথম ক্ষেত্রে অনেক সংকীর্ণ এবং অন্যান্য শর্তও অত্যন্ত অসুবিধাজনক।
তৃতীয় পন্থাটি হতে পারে বাতিল করা চুক্তিটি পুনর্বহাল করার লক্ষ্যে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে আলোচনার সূত্রপাত করা। বাতিল করা চুক্তি পুনর্বহালের উদাহরণ বিশ্বে অবশ্যই আছে। তবে সে ক্ষেত্রে আমাদের এমন কিছু পদক্ষেপে যেতে হবে, যা বিদেশি সাহায্যের সঠিক ও সুষ্ঠু ব্যবহারের কিছু বাড়তি রক্ষাকবচ সৃষ্টি করবে এবং রাষ্ট্র হিসেবেও যেন আমরা একটি সম্মানজনক অবস্থানে থাকি।
আশা থাকবে, পদ্মা সেতু প্রকল্প নিয়ে আমাদের এই দুর্ভাগ্যজনক ও বিব্রতকর অভিজ্ঞতা থেকে খোলা মন নিয়ে আমরা প্রয়োজনীয় শিক্ষা নেব।