Originally posted in বণিকবার্তা on 20 September 2021
বাংলাদেশের পাট শিল্প নিয়ে আলোচনার শুরুটা হওয়া উচিত পাটপণ্যের বৈশ্বিক শিল্প উপযোগিতা এবং এর চাহিদার পরিবর্তন নিয়ে। বিশেষত পাটের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার প্যাকেজিং পণ্য হিসেবে। সত্তর দশকের পর থেকে পাটের বিকল্প পণ্য হিসেবে সিনথেটিক পণ্যের বিস্তার এর বাজারকে সংকুচিত করে। ফলে আমরা দেখতে পাই বৈশ্বিকভাবে পাটপণ্যের রফতানি বাজার ব্যাপকভাবে প্রবৃদ্ধি লাভ করেনি। অন্যান্য শিল্পপণ্য যে ধরনের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম হয়, পাট পণ্যের ক্ষেত্রে তা খুবই স্বল্প মাত্রায় এগিয়েছে। এ কারণে রফতানিকারক দেশগুলোও বৈশ্বিকভাবে পণ্যটির চাহিদা শ্লথগতি হওয়ার কারণে বিশেষ সুবিধা নিতে সক্ষম হয়নি। বিগত দশকজুড়ে অন্যান্য শিল্পপণ্যের চাহিদা যেভাবে বেড়েছে, পাটপণ্যের ক্ষেত্রে বিশেষত মোড়কপণ্য হিসেবে পাটের ব্যবহার বাড়েনি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম পাটের সুতা ও বহুমুখী পাটপণ্য। এ জায়গাগুলোতে কিছুটা প্রবৃদ্ধি আমরা দেখি। তবে পাটের অন্যান্য পণ্যের তুলনায় এর বাজার শেয়ার কম।
বাংলাদেশের পাটশিল্পের প্রবৃদ্ধি ও পাটের ওপর নির্ভরশীল কারখানাগুলোর লাভ-ক্ষতির ক্ষেত্রে বিগত সব দশকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পাটের ওপর নির্ভরশীল সবচেয়ে বড় দেশ বাংলাদেশ ও ভারত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় পাটের বাজার ভারত। এক্ষেত্রে ভারত একটি সংরক্ষণমূলক অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিত করেছে; যাতে বৈশ্বিক যেকোনো পরিস্থিতিতেও পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা অক্ষুণ্ন থাকে এবং পাটের ওপর নির্ভরশীল অভ্যন্তরীণ পাট কারখানাগুলো একটি নির্দিষ্ট মাত্রার প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে। ভারতে এ ধারণা ১৯৮৭ সাল থেকে শুরু হলেও বাংলাদেশে শুরু হয় ২০১৩ সালের পর। অর্থাৎ পাটপণ্য মোড়ক আইন করার পর।
পাটপণ্যের বাজারটি কখনই মসৃণ ছিল না। একে সবসময় স্বল্পমূল্যের প্লাস্টিকের মোড়কজাতীয় পণ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়েছে। উত্তরোত্তর সিনথেটিক, প্লাস্টিকের মোড়ক প্রাপ্তির সুবিধার কারণে পাটপণ্য প্রতিযোগিতায় ক্রমেই দুর্বলতর হয়েছে। যে জায়গাটিতে পাটপণ্যের ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত ছিল, তা হলো প্রাকৃতিক তন্তু হিসেবে বৈশ্বিক পর্যায়ের তৈরি হওয়া চাহিদা যেমন গ্রিন গ্রোথ, গ্রিন ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। বৈশ্বিক পর্যায়ে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে পাটপণ্যের যে বিস্তৃতি তা সবসময় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এর মধ্য দিয়েই শিল্প খাতটির বেড়ে ওঠার সম্ভাবনা নিশ্চিত করার বিষয় রয়েছে।
বেসরকারীকরণ: বাংলাদেশের পাট খাতকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ষাটের দশকে পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়নের লক্ষ্যে এর বিস্তার শুরু হয়। তখন পাকিস্তানি উদ্যোক্তারা আদমজী জুট মিল, বাওয়ানী জুট মিলের মতো উদ্যোগ শুরু করেন। বাংলাদেশী উদ্যোক্তারাও সেখানে যুক্ত হন। যেমন এ কে খান জুট মিল স্বাধীনতার পূর্বকালে শিল্প খাতে তাদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। ১৯৭০ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মোট রফতানীকৃত পণ্যে ৭০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। সুতরাং স্বাধীনতাকালে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রফতানি পণ্যটি ছিল পাট। তবে স্বাধীনতা-উত্তর সরকারের সামগ্রিক রাজনৈতিক দর্শন পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে বেসরকারি পাটকলগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয় ১৯৭২ সালে। তার ভিত্তিতে প্রায় ৭৫টির মতো পাটকল সরকারের অধীনে আসে। সরকারি খাতে এগুলো পরিচালনার জন্য যে দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজনীয় ছিল তার অভাব, প্রয়োজনীয় তদারকির অভাব এবং আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে এগুলো পরিচালনার যে উদ্যোগ, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা সফলতার মুখ দেখেনি। ফলে স্বাধীনতা-উত্তরকালে সরকারি খাতে আমরা পাটকলগুলো চলতে দেখেছি ঠিকই, কিন্তু তা সেই অর্থে লাভের মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের ইতিহাসে পাট খাত সম্ভবত দুই থেকে তিন বছর লাভের ঘরে অবস্থান করেছে, বাকি সবটা সময় নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
এমন পরিপ্রেক্ষিতে আশির দশকে সরকার পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সত্তর দশকের পরিচালনাগত দুর্বলতা, বৈশ্বিক বাজারে পাটপণ্যের চাহিদার পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে পাটকলগুলো বড় রকমের দেনার মধ্যে পড়ে। আশির দশক থেকে অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ শুরু হলেও বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে যে দুর্বলতার তথ্য তুলে ধরা হয়, তা হচ্ছে অতীতের দেনার বোঝা তাদের ওপর চাপানোর বিষয়টি। পাটকলগুলোকে দেনাসহ হস্তান্তর করা হয়েছিল। যদিও সরকারে পরিচালন অদক্ষতার দায় তাদের ওপর বর্তায় না। তবে সে দায়-দেনার রেশগুলো তাদের পরবর্তী সময় পর্যন্ত বহন করতে হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বেসরকারীকরণের প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা। দেখা গেছে, যাদের কাছে পাটকলগুলো হস্তান্তর করা হয়েছে তাদের অনেকেই খাতটির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। রাজনৈতিক পরিচিতির অংশ হিসেবে তাদের কাছে এগুলো হস্তান্তর করা হয়। তাই অনেক কম মূল্যে পাটকলগুলো বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করা হলেও অনেক পাটকলই লাভজনক পর্যায়ে যেতে পারেনি।
তবে আশির দশকের পরবর্তী সময়ে আমরা দেখতে পাই, সরকারি খাতের পাটকলগুলো বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনে এবং বেসরকারি খাতের পাটকলগুলো বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমএ), বাংলাদেশ জুট স্পিনার অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএসএ) এবং বাংলাদেশ জুট গুডস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেজিএ) অধীনে পরিচালিত হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে পরিচালিত হওয়ার ফলে এ সময়কালে একধরনের অসম প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণে সরকারি পাটকলগুলো তুলনামূলক ব্যয়বহুল উপায়ে পাটপণ্য উৎপাদন হওয়ার পরও দেখা যায় তারা কম মূল্যে সেসব পণ্য রফতানি সুবিধা নিচ্ছে। তাই বেসরকারি পাটকলগুলো অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি পাটকলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে ওঠেনি। বেসরকারি খাতের মিলগুলোকে অনেক সময় সরকারি খাতের মূল্য নির্ধারণের ওপর নির্ভরশীল হয়ে কাজ করতে হয়েছে, যা পাট খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার পরিবেশকেও অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত করেছে।
২০০৮ সালে সিপিডির গবেষণায় উঠে আসে যে সরকারের হাতে সর্বশেষ যে ২৫টি মিল ছিল বেসরকারি খাতের তুলনায় এগুলোর উৎপাদন ব্যয় ছিল প্রায় দেড় গুণ বেশি। তার পরও সরকারি মিলগুলো লোকসানে চলছিল এবং তাদের সম্পূর্ণ সক্ষমতাকে কাজে লাগাতে সমর্থ হচ্ছিল না। তাছাড়া তাদের পূর্ণ নির্ভরশীলতা ছিল সরকারের ভর্তুকি বা ঋণের ওপর। বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার পরও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, অতিরিক্ত লোকবল, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে লোক নিয়োগ, শ্রমিকের বাহুল্য, দুর্নীতি, অপচয়সহ বিভিন্ন কারণে নব্বই দশকের পরবর্তীকালে সরকারি মিলগুলো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপ: সরকারি খাতের মিলগুলোর অপ্রতিযোগিতামূলক পরিচালনা বেসরকারি খাতের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এছাড়া বেসরকারীকরণ প্রক্রিয়ার দুর্বলতা রয়েছে, যা আগেই উল্লেখ করেছি। তবে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয়টি হচ্ছে পাটশিল্পের কাঁচামাল অর্থাৎ পাট উৎপাদনের পূর্ণ সুবিধা থাকার পরও আমরা পাটপণ্যের অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা ধরে রাখতে পারিনি। বরং পাটপণ্যের ক্ষেত্রে বিজেএমসির বিভিন্ন উদ্যোগ আমাদের রফতানি বাজারকে নানা সময়ে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। যেমন ২০০৫ পরবর্তী সময়কালে ব্রাজিলের বাজারে আমাদের পাটপণ্যের ওপর অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপ করা হয়। যার একটি বড় কারণ ছিল উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে কম মূল্যে আমরা সেখানে পণ্য রফতানি করছিলাম বলে তাদের বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ ক্ষুণ্ন হচ্ছিল। ওই বাজারটি ছোট ছিল বলে আমরা তা কখনো খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করিনি। কিন্তু কম মূল্যে রফতানি প্রবণতার কারণে বেসরকারি খাতও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এ প্রক্রিয়ারই সর্বশেষ যে ক্ষতিটি বাংলাদেশকে পোহাতে হচ্ছে তাহলো উৎপাদনমূল্যের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রির অভিযোগে ভারতের বাজারেও অ্যান্টিডাম্পিং ডিউটি আরোপের মুখে পড়তে হয়েছে। প্রতি টনে ৯ থেকে ৩৫২ ডলার পর্যন্ত আমাদের পণ্যের ওপর শুল্কারোপ করেছে তারা। ফলে ভারতে আমাদের রফতানি বাজার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ থেকে বের হয়ে আসার অংশ হিসেবে উভয় দেশের সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক হলেও পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, বিষয়টি মূলত আদালতের এখতিয়ারভুক্ত হিসেবে থেকে গেছে। এখন তা থেকে সহসা উত্তরণের খুব বেশি সুযোগ নেই। উপরন্তু এরই মধ্যে পাঁচ বছর অতিক্রম হয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত থেকে বর্ধিতকরণের বিষয়টি বিবেচনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ যা করতে পারে তা হচ্ছে, আমরা নতুন করে ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছতে পারি এ দৃষ্টিকোণ থেকে যে বাংলাদেশ এখন বিজেএমসির মিলগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। তাই আগের মূল্যের কোনো পণ্য ভারতে যাওয়ার সুযোগ নেই। ফলে অ্যান্টিডাম্পিংয়েরও কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং এ যুক্তিতে এটি বাড়ানোরও কোনো সুযোগ নেই। এর পরও ভারত যদি এটা বাড়ানোর কথা ভাবে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের উচিত হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শরণাপন্ন হওয়া।
পাটশিল্পের বিকাশের অন্তরায়: সরকারি খাতে প্রতিযোগিতার অভাব সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাতের পাটশিল্পের বিকাশের অন্তরায়। তবে সরকারি খাতের মিলগুলোতে শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা-মজুরি তুলনামূলকভাবে বেশি। শ্রমিকের কম মজুরি ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের যুক্তিটি ছিল, তারা যে মুনাফা করতে পারেন তার ভিত্তিতে ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনা করেন। সরকারি খাতের কাঠামোগুলো কখনো তার আয়ের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। অতিরিক্ত ব্যয় মিটিয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে কীভাবে এটিকে লাভজনক করা যায়, সে ধরনের উদ্যোগ কখনই আমরা বিজেএমসিকে নিতে দেখি না।
সর্বশেষ সরকারের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত নিতে আমরা দেখি, তা হলো ২৫টি পাটকল বন্ধ করা হয়েছে। আমি মনে করি এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত। বিদ্যমান কাঠামোগত পরিস্থিতিতে সরকারি খাতের মাধ্যমে এগুলোা লাভজনক করা দুষ্কর। কেননা এখানে রাজনৈতিক প্রভাব, বিভিন্ন অনিয়ম এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের কারণে অলাভজনক এ প্রতিষ্ঠানগুলো দায় বা দেনা বছর বছর সরকারকে বহন করে যেতেই হতো।
সিপিডি থেকে আমরা গবেষণা করে দেখেছি, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিজেএমসিতে চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে সরকারের যে আমলারা এসেছেন, তারা কখনই এ প্রতিষ্ঠানে গড়ে বারো থেকে তেরো মাসের বেশি থাকেননি। বেসরকারি খাতে একজন ব্যবস্থাপক কিন্তু বছরের পর বছর একটি পাটকলে থাকছেন, যা প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করতে সহায়তা করে। সমস্যাপূর্ণ মিল হলে সেখানে চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে বেশি সময়ের জন্য দায়িত্ব নেয়ার বিষয়টি চালু থাকলেও বিজেএমসির মিলগুলোর ক্ষেত্রে আমরা বিপরীত চিত্রই দেখি। এখানে যারা দায়িত্ব পেয়েছেন, তারা দ্রুত চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। কেননা তারা বিষয়টিকে শাস্তি হিসেবে দেখেছেন। এ ধরনের কাঠামোতে সরকারি মিলগুলোকে লাভজনক করাটা দুরূহ। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে মিলগুলোকে বিএমআরই (ব্যালান্সিং, আধুনিকায়ন, বিস্তার ও প্রতিস্থাপন) করার দাবি থাকলেও আমাদের সরকারি প্রশাসকদের দুর্বলতার কারণে তা কার্যকর হতো বলে মনে হয় না। তবে দুঃখজনক হচ্ছে, মিল বন্ধ করার আগে শ্রমিকদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার সরকারি প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখনো অনেকের ক্ষেত্রে তা মেটানো হয়নি। শ্রমিকের সব ধরনের পাওনা, ব্যাংকের কাছে ধার-দেনা, কাঁচাপাট ক্রয়ের বকেয়া দ্রুত মেটাতে হবে।
সরকারি খাতের পাটকলগুলো বন্ধ করার ফলে যে বিপুল পরিমাণ অব্যবহূত অবকাঠামো তৈরি হয়েছে, তা কাজে লাগিয়ে বিকল্প শিল্পায়নের একটি বড় সুযোগ রয়েছে। মিলগুলো চট্টগ্রাম, ঢাকার নিকটবর্তী নরসিংদী ও দক্ষিণাঞ্চলের খুলনা ও যশোর—এ তিনটি অঞ্চলে অবস্থিত। অঞ্চলভেদে ভিন্ন তিনটি শিল্পায়ন কাঠামোতে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল বা ইপিজেড কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর ও এর মাধ্যমে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এখানে শুধু পাটপণ্যের পাশাপাশি অন্যান্য ধরনের যে পণ্যের রফতানি চাহিদা রয়েছে, তাতে বিনিয়োগ করতে হবে। যেমন চট্টগ্রাম অঞ্চলের মিলগুলোর রফতানিমুখী শিল্পের জন্য বেপজার কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে। তারা লিজ আকারে এগুলো বণ্টন করতে পারে। ঠিক একইভাবে ঢাকাকেন্দ্রিক মিলগুলোকে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। অথবা বিদেশী বিনিয়োগকারীও এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন। দক্ষিণাঞ্চলের মিলগুলোতে পাটজাত শিল্পপণ্যের জন্য নির্ধারিত করা যেতে পারে। যেখানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের বেসরকারি খাতের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ আসতে পারে। এগুলোর পাশাপাশি বিজেএমসিকে ধীরে ধীরে গুটিয়ে নিয়ে আসার অনুরোধ ছিল আমাদের। সংস্থাটির যেহেতু প্রায়োগিকতার সুযোগ কম, তাই মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি ইউনিটে পরিণত করার কথা আমরা বলেছি। কারণ অনিষ্পন্ন হিসাবাদি রয়েছে, সেগুলোকে নিষ্পন্ন করা। আন্তর্জাতিক অডিট ফার্মের মাধ্যমে অডিট করানো এবং সে রীতিতে মিলগুলোর দায়-দেনা মিটিয়ে ফেলা যাতে দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সুস্থভাবে বিনিয়োগ করতে পারে। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকার বিজেএমসির কাঠামোকে অক্ষুণ্ন রাখতে চাচ্ছে এবং পাট খাতের মিলের জন্যই আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করেছে। বেশকিছু মিলকে তারা তালিকাভুক্ত করেছে। এখানে তালিকাভুক্ত মিলগুলোর নাম, তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া, টেন্ডার ভ্যালুর তথ্য-উপাত্তগুলো উন্মুক্ত করা দরকার।
এর আগের বেসরকারীকরণের উদ্যোগগুলোতে আমরা দেখি, খাতটির সঙ্গে যারা জড়িত নয়, তাদের অনেকেই মিলের দায়িত্ব নিয়ে পরে তা পরিচালনা করতে সমর্থ হয়নি। তাই কারা মিলগুলোর দায়িত্ব নিচ্ছেন, কোন যুক্তিতে শর্তে নিচ্ছেন, কতদিনে বিনিয়োগে যাবেন, তা দেখা জরুরি। তবুও আমরা মনে করি বেপজা বা বেজা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যদি এগুলোকে পরিচালনা করা যেত তাহলে তা লাভজনক হতো। কারণ এখানে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ শিল্প পরিচালনার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিদ্যমান।
নতুন সম্ভাবনা ও করণীয়: অনেকেই শঙ্কায় ছিলেন সরকারি খাতের পাটকলগুলো বন্ধ হওয়ার ফলে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা। আমরা বরং বিপরীত চিত্র দেখতে পেয়েছি। দেশের পাট খাতে নতুন করে আশার সৃষ্টি হয়েছে। পাটপণ্যের উৎপাদন ও মূল্য বেড়েছে। যার সুবিধাগুলো কৃষকরা অনেক বেশি নিতে পারছেন। পাটপণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে স্থানীয় পর্যায়ে কিনতে গিয়ে উদ্যোক্তারা হিমশিম খাচ্ছেন। সুতরাং আমরা মনে করি বেসরকারি খাতের মাধ্যমেই পাটের নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে। সরকারের উচিত হবে দেশের অভ্যন্তরে পাটপণ্যের জন্য একটি প্রতিযোগিতামূলক বাজার নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে পণ্য মোড়ক আইনের আলোকে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠান পাটব্যাগ ব্যবহার করে, যেমন খাদ্য মন্ত্রণালয়, চিনি শিল্প করপোরেশন, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, এখানে পাটের ব্যাগের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে মোড়ক আইনের অধীনে অন্যান্য পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগের ব্যবহার হচ্ছে কিনা তা দেখা। যেমন ডাল, আলু, ছোলা ও অন্যান্য মসলা। এখানে পাটের ব্যবহার নিশ্চিতের জন্য পণ্য মোড়ক আইন বর্ধিত করা হয়েছে। প্রায় ১৭টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগের ব্যবহার বাধ্যতামূলকভাবে পরিপালিত হলে দেশের অভ্যন্তরেই পাটের বড় বাজার নিশ্চিত করা যাবে।
সিপিডি থেকে ২০০৮ সালে গবেষণা করে তখনই মোড়ক আইন প্রবর্তন ও বর্ধিতকরণের জন্য আমরা বলেছিলাম। গবেষণা থেকে আমরা আরো দেখতে পেয়েছি, শুধু যদি পণ্য মোড়ক আইন প্রবর্তন করা হয়, তাহলে রফতানিযোগ্য ৮০ শতাংশ পাটপণ্যেরই অভ্যন্তরীণ বাজার নিশ্চিত করা যায়। সুতরাং আমরা মনে করি, পাট খাতের বিকাশের জন্য অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি দেশী ও বিদেশী বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অপ্রচলিত পাটপণ্যের ক্ষেত্রে যে চাহিদা তৈরি হচ্ছে, সেটিকেও সরকারের উৎসাহ দেয়া দরকার। এ আলোকে দেশের ভেতরের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছেন, তাদের প্রণোদনা সহায়তা দেয়া এবং বিভিন্ন ধরনের কম্পোজিট জুট পণ্য যারা উৎপাদন করেন, এ ধরনের বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিনিয়োগের জন্য আকৃষ্ট করা যায়। এর আগে আমরা চীনা বিনিয়োগকারীদের কথা শুনেছিলাম যে তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী, সুতরাং তাদের এ খাতে বিনিয়োগের জন্য আকৃষ্ট করা যেতে পারে।
সরকারি পাটকল বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে বলা যায়, একধরনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ জায়গাতে বেসরকারি খাত যাতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিতের পাশাপাশি সরকারি পাটকলের বর্ধিত বা অব্যবহূত জায়গাগুলোতে পাটের বাইরেও অন্যান্য পণ্যের শিল্প-কারখানা ও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ তৈরির সুযোগ করে দিতে পারে সরকার। ভারতের পাট খাতকে উৎসাহিত করার পেছনে সবসময় সরকারের সমর্থন ছিল, পাশাপাশি তারা নীতিগত সমর্থনও পেয়েছে। তবে ভারতের সরকারি পাটকলগুলোর অবস্থা কিন্তু বাংলাদেশের তুলনায় খারাপ। কিন্তু ওদের বেসরকারি পাটকলগুলোর অবস্থা অনেক ভালো। সেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, ফলে উৎপাদন সক্ষমতা বেশি। পাশাপাশি ওরা উন্নত আঁশ ব্যবহার করে। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে সরকার প্লাস্টিক মার্কেট নিশ্চিত করছে। ভারতের পাট কমিশন অনেক শক্তিশালী। ওদের উৎপাদনশীলতা অনেক বেশি। ফলে ইউনিটপ্রতি খরচও কম। ফলে অনেক প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে দেশে ও বাইরের বাজারে তারা পণ্য দিতে সক্ষম হয়।
বাংলাদেশের পাট খাতের ভবিষ্যৎ: বাংলাদেশের পাট খাতের অবশ্যই ভবিষ্যৎ রয়েছে। তবে তা বেসরকারি খাতের হাতেই নিশ্চিত করা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি হচ্ছে, পাট খাত ঘিরে বিনিয়োগকারীদের কম আগ্রহ। কারণ তুলনামূলকভাবে পাট শিল্পে লাভ কম। পোশাক খাতে বিনিয়োগ করে যে পরিমাণ লাভ হয়, পাটের ক্ষেত্রে ওই পরিমাণ রিটার্ন পেতে আরো বেশি সময় চলে যায়। তছাড়া দেশীয় বাজারভিত্তিক অন্যান্য যে শিল্পপণ্য রয়েছে, সেগুলোতে বিনিয়োগ করে যে পরিমাণ লাভ হয় পাটপণ্যের ক্ষেত্রে অনেক সময় তা-ও হয় না। এজন্য বিনিয়োগকারীদের পাট শিল্পে বিনিয়োগের একধরনের কম আগ্রহ রয়েছে। এ জায়গা থেকে পাট খাতের কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ তৈরি করা জরুরি। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি ভালো করে, তাহলে তাদের উৎসাহ দেব, কিন্তু এককভাবে কোনো একটি বা দুটি বড় প্রতিষ্ঠানের হাতে অধিকাংশ বাজার শেয়ার চলে যাচ্ছে কিনা, তার দিকেও খেয়াল রাখা জরুরি। কিংবা একক প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করে বাড়তি সুবিধা না নিতে পারে তা দেখতে হবে।
বিনিয়োগের জন্য পাট খাত একটি উপযুক্ত জায়গা—এমন কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ যদি কোনো কোম্পানি নিয়ে আসতে পারে, তাহলে অন্যান্য কোম্পানিও আগামীতে এ খাতে আগ্রহ-উৎসাহ দেখাবে। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বাধাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে তারা যদি যৌথ বিনিয়োগে উৎসাহী থাকে, সেটিরও সুযোগ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে বিডা, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়কেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। পাট খাতটি দেশীয় কয়েকটি উদ্যোক্তানির্ভর যেন না হয়, অন্য উদ্যোক্তাদেরও এখানে সমানভাবে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
তবে উত্তরোত্তর পাট খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদার ওঠানামাটি অনেক বেশি। সে বিচারে বড় আকারে বিনিয়োগে যাওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। সেক্ষেত্রে পাট খাতের জন্য তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক বিনিয়োগ কাঠামোটি হলো ছোট বা মাঝারি আকারের পাটকল। আগামী দিনের জন্য আমরা যেটি মনে করি, বাংলাদেশে বৃহৎ আকারের পাটকলের চেয়ে ক্ষুদ্র বা মাঝারি আকারের পাটকলে উৎসাহিত করা। যাতে বিনিয়োগকারীরা কোনো ঝুঁকির মধ্যে না পড়েন এবং তারা যাতে তুলনামূলকভাবে ভালো লাভ অর্জন করতে পারেন ও বিনিয়োগ করতে পারেন, তেমন একটি কাঠামো তৈরি করতে হবে। বিনিয়োগের মাধ্যমে যে ঝুঁকি তৈরি হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি পাটকলগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে।
ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)