Published in শেয়ার বিজ on Friday, 27 April 2018
বর্ধিত ব্যয়ের সিংহভাগই যাচ্ছে কর্মচারীদের পেনশনে
চলতি অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা
মাসুম বিল্লাহ
চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ রয়েছে প্রায় ৫৪ হাজার কোটি টাকা। এটি দেশের মোট জিডিপির দুই দশমিক চার শতাংশ। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ বরাদ্দ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা বেশি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষায় বরাদ্দ ছিল ৪৩ হাজার কোটি টাকার মতো, যা ওই সময়ের মোট জিডিপির দুই দশমিক এক শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে এ খাতে বরাদ্দ বড় আকারে বাড়লেও তার সিংহভাগই যাচ্ছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেছনে।
প্রতিবছরই সামাজিক সুরক্ষা খাতে রাষ্ট্রের ব্যয় জিডিপির অনুপাতে শতাংশীয় হিসাবে প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। কিন্তু পেনশনবহির্ভূত খাতে প্রতিবছরই ধারাবাহিকভাবে আনুপাতিক হারে কমছে ব্যয়। এর বিপরীতে পেনশন খাতে প্রতিবছরই বাড়ছে। পেনশনের অর্থ পান মূলত অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীরা। এর বাইরে সমাজের বিপুলসংখ্যক দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া, বয়স্ক ও নিম্ন আয়ের মানুষদের যে হারে সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল, তারা তা পাচ্ছে না।
গত ৯ বছরের উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে সে সময়ের জিডিপির দুই দশমিক দুই শতাংশ ছিল এ খাতের ব্যয়। এর মধ্যে পেনশনবহির্ভূত খাতেই গেছে এক দশমিক ৯ শতাংশ। বাকি মাত্র দশমিক তিন শতাংশ ছিল সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ব্যয় মেটানোর জন্য। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জিডিপির অনুপাতে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় বেড়ে দুই দশমিক চার শতাংশে উন্নীত হলেও পেনশনবহির্ভূত খাতে তার অনুপাত বাড়েনি। ওই অর্থবছরেও পেনশনবহির্ভূত খাতে ব্যয় ছিল এক দশমিক ৯ শতাংশ।
আনুপাতিক হারে সামাজিক নিরাপত্তায় সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ ছিল ২০১০-১১ অর্থবছরে। ওই সময়ে এ খাতে বরাদ্দ ছিল মোট জিডিপির দুই দশমিক ছয় শতাংশ। অর্থবছরটিতে পেনশনবহির্ভূত খাতে আনুপাতিক হারে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় দুই দশমিক এক শতাংশ। এর পরের বছর থেকে প্রতিবছরই আনুপাতিক হারে কমেছে পেনশনবহির্ভূত খাতে সামাজিক নিরাপত্তার ব্যয়। ২০১১-১২ অর্থবছরে সে সময়ের জিডিপির দুই দশমিক চার শতাংশ ব্যয় হয়েছিল সামাজিক নিরাপত্তা খাতে। ওই বছরও যথারীতি এক দশমিক ৯ শতাংশ ছিল পেনশনবহির্ভূত খাতে। এর পরের অর্থবছর দুই দশমিক দুই শতাংশ ব্যয়ের মধ্যে পেনশনবহির্ভূত খাতে ছিল এক দশমিক সাত শতাংশ। পরের অর্থবছর মোট ব্যয় বেড়ে জিডিপির দুই দশমিক তিন শতাংশ হলেও পেনশনবহির্ভূত খাতে ব্যয় ছিল এক দশমিক সাত শতাংশই। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্যয় কমে দাঁড়ায় দুই শতাংশে। ওই সময় পেনশনবহির্ভূত খাতে ব্যয় হয়েছিল এক দশমিক পাঁচ শতাংশ। এর পরের দুই অর্থবছরে যথাক্রমে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যয় ছিল জিডিপির দুই দশমিক এক শতাংশ। বছর দুটিতে পেনশনবহির্ভূত খাতে ব্যয় হয়েছিল এক দশমিক চার শতাংশ হারে। আর চলতি অর্থবছর মোট অনুপাত বেড়ে দুই দশমিক চার শতাংশ হলেও পেনশনবহির্ভূত খাতে আগের অর্থবছরের মতো এক দশমিক চার শতাংশই রয়েছে, অর্থাৎ মোট ব্যয় যে হারে বেড়েছে, সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়ের মাত্রা সে অনুপাতে বাড়েনি।
সামাজিক সুরক্ষা খাতে সরকার দেশের হতদরিদ্র ও সাধারণ মানুষের জন্য কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে, তার প্রকৃত চিত্র পাওয়ার জন্য পেনশনের হিসাব সামাজিক সুরক্ষার মোট হিসাব থেকে আলাদা করার পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।
জানতে চাইলে সংগঠনটির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম শেয়ার বিজকে বলেন, ‘পেনশন আর পেনশনবহির্ভূত খাতের ব্যয় একত্রিত করে হিসাব করা হলে সমাজের দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকৃতপক্ষে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, তা বোঝা যায় না। তাই আমরা দুটিকে আলাদাভাবে দেখানোর সুপারিশ করেছি। এছাড়া আমরা বেসরকারি খাতের জন্য একটি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করার প্রস্তাব করেছি।’ সরকারি কর্মচারীদের সরকারের সঙ্গে দরকষাকষির সুযোগ রয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এভাবে দরকষাকষি করার মতো কোনো পক্ষ নেই। যে কারণে পেনশনে বরাদ্দ যে হারে বাড়ছে, পেনশনবহির্ভূত খাতে সে হারে বাড়ছে না বলে মনে করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।
সিপিডির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, চলতি অর্থবছর সামাজিক সুরক্ষা খাতে যে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে তার ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশই যাবে পেনশনে। এ বছর পেনশনে বরাদ্দ বেড়েছে প্রায় ৭৭ শতাংশ। অন্যদিকে পেনশনবহির্ভূত খাতে বেড়েছে মাত্র ১৩ শতাংশের মতো। পেনশনারদের জন্য মাথাপিছু ব্যয় হবে ৩৫ হাজার ৭৭০ টাকা। আর পেনশনবহির্ভূত যেসব সাধারণ মানুষ এ সুবিধা পান, তাদের জন্য মাথাপিছু বরাদ্দ মাত্র ৫১৫ টাকা।
সামাজিক সুরক্ষার সুবিধা আরও দক্ষতার সঙ্গে বিতরণের লক্ষ্যে সামাজিক সুরক্ষা কৌশল প্রণয়ন করেছে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জিইডির সদস্য (জ্যেষ্ঠ সচিব) ড. শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, বেসরকারি খাতে সর্বজনীন (ইউনিভার্সাল) পেনশন চালু করা, সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধা বিতরণের লিকেজ দূর করাসহ এ খাতে সারের ব্যয় আরও বাড়ানোর জন্য যে সক্ষমতা দরকার, তা তৈরি হতে সময় লাগবে। তবে ধীরে ধীরে বিষয়গুলো এগোচ্ছে।