Originally posted in দৈনিক সমকাল on 18 July 2021
বাংলাদেশে উত্তরোত্তর শিল্প বিকাশের পাশাপাশি কারখানা পর্যায়ে দুর্ঘটনাও বাড়ছে। ইতোপূর্বে এসব দুর্ঘটনার কেন্দ্রে ছিল তৈরি পোশাক খাত। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর গার্মেন্ট খাতে বড় ধরনের সংস্কারকাজ হাতে নেওয়া হয়। এই সময়ে তৈরি পোশাকের বাইরে বাংলাদেশে অন্যান্য শিল্পায়নের বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু বিকাশমান এসব শিল্পকারখানার শ্রম পরিবেশ, শ্রমিকদের মজুরি, নিরাপত্তাসহ সংশ্নিষ্ট বিষয়ে যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সমানতালে গড়ে ওঠেনি।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর তৈরি পোশাক খাত সামনে রেখে কারখানা পর্যায়ে সংস্কারের লক্ষ্যে কিছু উদ্যোগ নেওয়া যায়। কারখানা পরিদপ্তর থেকে কারখানা অধিদপ্তরে উত্তরণ ঘটিয়ে জনবল বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তৈরি পোশাক খাতে নজরদারির পাশাপাশি অন্য কারখানাগুলোর দিকে যে ধরনের নজরদারি দরকার ছিল, সেটি হয়ে ওঠেনি। অন্যান্য খাতের কারখানাগুলোকে নজরদারির আওতায় আনার বিষয়টি অনেক আগে থেকেই আলোচনা হয়ে আসছিল। শ্রম অধিদপ্তর, কলকারখানা অধিদপ্তর, আইএলও যৌথভাবে এ আলোচনা করছিল। কিন্তু কভিডের বিস্তার ঘটার কারণে এ আলোচনা সীমিত হয়ে পড়ে। কভিডকালীন কারখানা নজরদারির চেয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক বিষয় কিংবা শ্রমিকের স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার তথ্যমতে, কলকারখানায় উত্তরোত্তর দুর্ঘটনা বাড়ছে। এসব দুর্ঘটনা মূলত দুই ধরনের- অগ্নিকাণ্ড ও ভবন ধস। তবে অগ্নিকাণ্ডই বেশি। অগ্নিকাণ্ডের প্রকৃতি ও মাত্রা দুটোরই পরিবর্তন এবং ব্যাপকতর হচ্ছে। সেই প্রেক্ষাপটে কারখানাগুলোকে নজরদারির আওতায় আনা খুবই প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক।
শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ খাত অথবা অধিক সংখ্যক মানুষ যেখানে কাজ করে সেসব জায়গার নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রাধিকার দেওয়া দরকার। কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, প্রসেসিং ফ্যাক্টরি, বহুতল ভবন, হাসপাতাল, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়সহ এ ধরনের কলকারখানা ও স্থাপনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ কাজ করে। জননিরাপত্তার দৃষ্টিতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ‘কমপ্লায়েন্স’ থাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে প্রাধিকার দিতে চায় তাহলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে বিবেচনায় রাখতে পারে। সেই আলোকে একটি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা দরকার।
তৈরি পোশাক খাত সংস্কারের বিষয়টি বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত। এই সংস্কার মডেল অন্যান্য খাতেও ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে অন্যান্য খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি নজরে আনা যেতে পারে। আমরা জানি, গার্মেন্ট কারখানার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তাঝুঁকি ছিল শর্টসার্কিটের ও কারখানার ভবন নির্মাণে দুর্বলতাকেন্দ্রিক। এর মধ্যে দাহ্য পদার্থ ও বয়লারকেন্দ্রিক ঝুঁকি কম ছিল। কিন্তু পোশাক খাতের বাইরের কলকারখানায় এ প্রবণতা বেশি লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং গার্মেন্ট সংস্কারের মডেলকে মৌল হিসেবে ধরলে এর সঙ্গে অন্যান্য উপাদানও এ পর্যবেক্ষণে আনতে হবে। সেদিক থেকে দেশীয় আইনের অধীনে যেসব বিষয় পর্যবেক্ষণে নেওয়া দরকার, সেগুলো এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কারখানাগুলোকে উত্তরণে যদি কোনো আন্তর্জাতিক গাইডলাইন অনুসরণের দরকার হয়, সেটাকেও এই পর্যবেক্ষণের আওতায় আনার সুযোগ রয়েছে। যার আলোকে একটি কার্যকর ও টেকসই মডেল দাঁড় করানো যেতে পারে। একই সঙ্গে এও মনে রাখা দরকার, গার্মেন্ট খাতের সংস্কারকাজ শেষ হয়ে যায়নি। এখনও চলমান। কাজেই শিল্পপ্রতিষ্ঠান সংস্কারের কাজটি একবারে সম্পন্ন করার কোনো বিষয় নয়। এটা নিয়মিত তদারকি, নজরদারি ও সংস্কারের বিষয়।
তবে তৈরি পোশাক খাতের সংস্কারকাজ যেভাবে সবাই মিলে সময় ধরে করা গেছে, অন্যান্য খাতে তা করা দুরূহ হতে পারে। কারণ তৈরি পোশাক খাত আন্তর্জাতিক সাপ্লাই চেইনের অংশ হওয়ায় এবং এর রপ্তানির সঙ্গে অর্থনৈতিক মুদ্রা অর্জন, কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়নসহ বেশ কিছু বিষয় সরাসরি জড়িত থাকায় বাংলাদেশ রাজনৈতিকভাবে এদিকে গুরুত্ব দিয়েছে। বিদেশি ক্রেতারা সংস্কারে চাপ দিয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সেখানে এগিয়ে এসেছে। ফলে সবার অংশগ্রহণে গার্মেন্ট খাতের সংস্কার করা গেছে। কিন্তু অন্য খাতগুলো বিশেষত যেগুলো বাজারভিত্তিক খাত অথবা পণ্য রপ্তানি করা হলেও মূল রপ্তানিকারক দেশের নন ট্র্যাডিশনাল মার্কেটে এসব পণ্য যায়, সে ধরনের খাতের সংস্কারকাজ সহজ হবে না।
আমরা জানি, সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত সেজান জুস কারখানাটির উৎপাদনের রয়ালটি নেওয়া হয়েছে চীন ও পাকিস্তানের কারখানা থেকে। এ দেশগুলোর কমপ্লায়েন্স মানদণ্ড সঠিকভাবে না মানার দুর্বলতার প্রভাব আমাদের দেশের কারখানাগুলোর ওপর পড়েছে। সে ক্ষেত্রে উচিত হবে সরকারের পক্ষ থেকে কাঠামো দাঁড় করানো। সেই সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তা বাস্তবায়নে শ্রম মন্ত্রণালয়, শ্রম অধিদপ্তর, কারখানা অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস, রাজউকসহ সংশ্নিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের সমন্বিত উদ্যোগে ‘প্ল্যান অব অ্যাকশন’ তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
সম্প্রতি সিপিডি একটি কাঠামো প্রস্তাব করেছে। যেখানে বলা হয়েছে, শ্রম অধিদপ্তরের উচিত হবে দীর্ঘ মেয়াদে খাতভিত্তিক ভিন্ন ভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইউনিট করা। এ ইউনিটগুলো বিভিন্ন খাতের পরিদর্শনের বিষয়গুলো দেখভাল করবে। এটি দ্রুততর সময়ে করার জন্য বেসরকারি পর্যবেক্ষণ সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে যেসব সংস্থা কাজ করে, তাদেরও এ প্রক্রিয়ায় জড়িত করে অনাপত্তিপত্র দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা বাংলাদেশে কাজ করতে পারে। এই সংস্থাগুলো নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে শ্রম অধিদপ্তরকে রিপোর্ট করবে। নতুবা এই কাজ যদি শুধু শ্রম অধিদপ্তরকে করতে হয়, তাহলে সংস্থাটি নানাবিধ প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হতে পারে। একইভাবে ফায়ার সার্ভিসও তার জায়গা থেকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কারখানা পর্যবেক্ষণের কাজটি করতে পারে। রাজউকও একই কাজ করতে পারে।
কারখানার উৎপাদন, বৈদেশিক মুদ্রা আনয়ন এবং মুনাফা অর্জন যেমন গুরুত্বপূর্ণ; কারখানার কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোর কোনো একটিকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। বরং সেজান জুসের এ দুর্ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমরা নিজেরাই যেন দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে সে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া শুরু করি। এ ধরনের সংস্কারকাজ সব সময় এক ধরনের বাধার সম্মুখীন হয়। কারখানা মালিকরা সংস্কারকাজের গতি কমিয়ে দিতে কিংবা বন্ধ করে দিতে চায়। এ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। এ ক্ষেত্রে দরকার সরকারের দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার, যা বাস্তবায়নে শ্রম অধিদপ্তরকে যথাযথ নির্দেশনা দেবে শ্রম মন্ত্রণালয়। আর শ্রম অধিদপ্তর ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষ সেই নির্দেশনাগুলো বাস্তবায়ন করবে। এ রকম একটি সমন্বিত কার্যক্রম হাতে নিয়ে সময় ধরে সুনির্দিষ্ট কিছু সেক্টরের মধ্যে এসব কার্যক্রম শেষ করা দরকার।
মনে রাখতে হবে, দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যেমন উদ্যোক্তার অবহেলা পরিলক্ষিত হয়, একইভাবে যেসব কর্তৃপক্ষ কারখানা দেখাশোনা করে তাদেরও ব্যর্থতা দেখা যায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো প্রায়ই অভিযোগ করে থাকে, পর্যাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা না থাকায় তারা ব্যবস্থা নিতে পারে না। আবার যে পরিমাণ জরিমানার বিধান রয়েছে, তার মানও খুব কম। অনেক কারখানা মালিক জরিমানা দিয়ে হলেও এ ধরনের প্রবণতা জিইয়ে রাখতে চান। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দিষ্টভাবে উচ্চ পর্যায়ে হলেও ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়া দরকার। যাতে তারা সংশ্নিষ্ট আইন ও নীতিগুলো যথাযথভাবে পরিপালন করতে পারে। একই সঙ্গে জরিমানার পরিমাণও বাড়ানো দরকার, যাতে এটি আদায়ের মাধ্যমে কারখানাগুলোকে কঠোর বার্তা দেওয়া যায়।
দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, একটি দুর্ঘটনার পর কিছুদিন আমরা সরব থাকি। পরবর্তী দুর্ঘটনা এলে আগেরটি ভুলে যাই। সেজান জুস কারখানার দুর্ঘটনা যেন ভুলে না যাই। এর পেছনে যাদের দায় রয়েছে, তাদের যেন চিহ্নিত করা হয় এবং দীর্ঘ মেয়াদে কারখানাগুলো সংস্কারের যে উদ্যোগ, তা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া যেন শুরু করতে পারি।
গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)