Originally posted in সমকাল on 4 May 2024
দু’বছর আগে (৯ মে ২০২২) সিপিডিতে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলাম, ২০২৪ সাল আমাদের জন্য কঠিন বছর হবে; দায়দেনা পরিশোধের ব্যাপারে বড় ধাক্কা আসবে। ২০২৬ সালে তা আরও বাড়বে। আরও বলেছিলাম, দায়দেনার হিসাবে ফাঁকফোকর আছে; অনেক কিছুই বিবেচনায় রাখা হয়নি। বিষয়টি উল্লেখ করছি এ কারণে যে, অর্থনীতিবিদ বা গবেষকদের প্রাক্কলন সমীকরণ নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকরা যাতে শ্লেষাত্মক কথা বলার ক্ষেত্রে সংযত হন।
বাংলাদেশের দায়দেনা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে তিনটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, পরিস্থিতি আসলেই কেমন? আমরা প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে কতটা ধারণা রাখি এবং তা কীভাবে মূল্যায়ন করব? দ্বিতীয়ত, দেশের দায়দেনার আর্থসামাজিক ফলাফল কী? যে লক্ষ্য বা চিন্তাভাবনা থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছিল, সে ক্ষেত্রে অর্জন কতটুকু? তৃতীয়ত, দায়দেনা পরিস্থিতি কেন এমন গুরুতর হলো? এটি কি অবধারিত ছিল?
ক. দেশের মোট ঋণ কত?
আমাদের দেশে সরকারের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে যত আলোচনা হয়, ব্যক্তি খাতের বৈদেশিক ঋণ নিয়ে ততটা নয়। অথচ বৈদেশিক ঋণের ২০ শতাংশই ব্যক্তি খাতের। ব্যক্তি খাতের ঋণ সামগ্রিক পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করে। কেননা পরবর্তী সময়ে পরিশোধজনিত কারণে মুদ্রার বিনিময় হারে এটি প্রভাব ফেলে। ব্যক্তি খাতের ঋণ নিয়ে কিছু অভিযোগও রয়েছে। কেউ কেউ বিদেশ থেকে ঋণ নিয়ে দেশে ব্যাংকের টাকা শোধ করেছেন। কেউ কেউ বিদেশে পাচার করেছেন অথবা আদৌ বিদেশ থেকে দেশে আনেননি। সুতরাং ব্যক্তি খাতের ঋণের হিসাব কোনোভাবেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বর্তমান বাংলাদেশে এটি পরিসংখ্যান ও গুণগতভাবে তাৎপর্যপূর্ণ।
অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের পাশাপাশি সরকার অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেও ঋণ নিচ্ছে। বর্তমানে সরকারের ঋণের দুই-তৃতীয়াংশই অভ্যন্তরীণ ঋণ। সামগ্রিক দায়দেনা পরিস্থিতি বুঝতে হলে বৈদেশিক ঋণের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ ঋণের হিসাবও মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন। কেননা ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিবেচনা করতে হবে দুই উৎস মিলেই। দুটো মিলিয়ে, আমার হিসাবে, মাথাপিছু ঋণ এখন প্রায় দেড় লাখ টাকা; যা তিন বছর আগে ছিল এক লাখ টাকা। এক লাখ টাকা হতে ৫০ বছর লাগলেও মাত্র তিন বছরেই ৫০ হাজার বেড়েছে।
মাত্র তিন বছর আগেও ঋণ পরিশোধে বছরে রাজস্ব ব্যয়ের ২৬ শতাংশ খরচ হতো; বর্তমানে এটা ৩৪ শতাংশে পৌঁছেছে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ ঋণের জন্য এবং বাকি ৬ শতাংশ বৈদেশিক ঋণের জন্য। তার মানে, সরকারের ঋণ নেওয়ার প্রবণতা সাম্প্রতিক তিন-চার বছরে তীব্রতর হয়েছে।
কেউ কেউ কভিড, ইউক্রেন যুদ্ধ বা গাজার সহিংসতার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন, তাদের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত নই। ২০১৮-১৯ সালের পর থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতা সম্পূর্ণ ভিন্নতর কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতিতে আমাদের কি উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে? আমি মনে করি, পরিস্থিতি অবশ্যই অধিকতর উদ্বেগজনক।
বস্তুত ঋণ পরিশোধের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে যে, আমরা রাজস্ব বাজেট থেকে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে একটি টাকাও খরচ করতে পারছি না। উপরন্তু ঋণ করে ঋণ শোধ করছি। এর মানে বর্তমান সমস্যা আগামীর সম্ভাবনাকে ব্যবহার করতে দিচ্ছে না।
এক অর্থে বর্তমান পরিস্থিতি একটি ‘প্রতারণামূলক বাস্তবতা’। প্রতারণামূলক বাস্তবতা হলো সেই বাহ্যিক অবস্থা, যা অন্তর্নিহিত সত্যকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যা বুঝতে দেয় না বর্তমানের বিষয়গুলো কীভাবে ভবিষ্যতের আশঙ্কা আবৃত করে রাখছে। মনে রাখতে হবে আমরা এখন আর ‘গ্রিন জোন’ বা নিরাপদ অবস্থানে নেই। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, মুডিস, এসঅ্যান্ডপি– সবাই আমাদের রেটিং নামাচ্ছে। সেই বিবেচনায় আমরা ‘ব্রাউন জোন’ বা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে চলে গেছি।
খ. লাভ হলো কার
ঋণ নেওয়ার ফলাফলটা কী? একটা প্রকাশ তো আমরা সামষ্টিক অর্থনীতির দুর্বল হয়ে যাওয়াতে মূল্যস্ফীতিতে টাকার বিনিময় হারের অবনমনে দৃশ্যত দেখতে পাই। এ ক্ষেত্রে আমার মতে, মূল জায়গাটা হলো– ঋণ করে সরকার যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তার ফলে আমাদের বিনিয়োগ বেড়েছে কিনা; আমরা অভ্যন্তরীণ সম্পদ বা কর আহরণ বাড়াতে পারছি কিনা। তবে বিনিয়োগ বাড়লেই তো কর আহরণ বাড়বে। তাই প্রশ্ন হলো, বেসরকারি বিনিয়োগ কেন ১০ বছর ধরে জিডিপির ২৩ থেকে ২৪ শতাংশের মধ্যে আটকে আছে? দেড় দশকের সাফল্য কেন বিনিয়োগে প্রতিফলিত হলো না? বিদেশি বিনিয়োগও কেন বাড়ল না? কেন তা জিডিপির ১ শতাংশে আটকে থাকল? আর কর জিডিপির অনুপাত তো ১০ বছরে ১০ শতাংশ পার হলো না। এটাই বড় চিন্তার জায়গা।
আরেকটি বিষয় হলো, এই ঋণ দিয়ে সরকার মানুষের জীবনমানের উন্নতি করতে চায়। কিন্তু সেই আকাঙ্ক্ষিত উন্নতি কি হচ্ছে? সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস প্রকাশ করেছে। এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী গত দুই বছরের (২০২২-২৩) মধ্যে মানুষের গড় আয়ু কমে গেছে। শিশুমৃত্যুহার বেড়ে গেছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী বেকারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। শিক্ষায় অথবা প্রশিক্ষণে নেই এমন তরুণের সংখ্যা বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। আরেক জরিপে দেখা গেছে, খাদ্য নিরাপত্তাহীন পরিবারের সংখ্যা বেড়ে গেছে। ২৫ শতাংশের বেশি মানুষ এখন ঋণ করে চলে। তারা দৈনন্দিন আহার সংগ্রহ করতে পারে না।
এসবই সরকারি পরিসংখ্যান। তাহলে দেড় দশক ধরে যে গড় মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির কথা হলো, সেগুলো কোথায় গেল? উন্নয়নের জন্য ঋণ যদি জনমানুষের জীবনমানে ঠিকমতো প্রতিফলিত না হয়, তাহলে লাভটা হলো কার?
প্রকল্প চয়ন, প্রণয়ন, বাস্তবায়ন এবং মূল্যায়ন– চার ক্ষেত্রেই আমরা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সবচেয়ে বড় যেসব প্রকল্প চয়ন করা হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ভৌত অবকাঠামোর জন্য এবং অনেক ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়িত। প্রকল্প চয়নের ক্ষেত্রে খাতওয়ারি ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। এর ফলে গত ১৫ বছরে শিক্ষা খাতে জিডিপির ২ শতাংশের বেশি ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। একই রকমভাবে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির ১ শতাংশের বেশি ব্যয় হয়নি। যে বাড়তি ব্যয়টুকু হয়েছে, তাও মূলত ইমারত বানানোর জন্য। এর ফলাফলই বিবিএসের বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে। যে কোনো রাজনৈতিক সরকারের এটি নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কথা।
গ. এটা কি অবধারিত ছিল?
এ রকম কী হওয়ার কথা ছিল? অবশ্যই ছিল না। তাহলে কেন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় বাংলাদেশের পুঁজি সঞ্চয়ের ইতিহাসে। প্রাথমিকভাবে ব্যাংক থেকে তহবিল চুরি করে বেআইনিভাবে পুঁজি সংগ্রহ করা হয়েছে। পরে শেয়ারবাজারের অভ্যন্তরীণ অব্যস্থাপনায় এবং প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের টাকা লুটতরাজ হয়েছে। এরপর দেড় দশক ধরে মেগা প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন কৌশলে অর্থ তছরুপ করা হয়েছে। শুধু প্রকল্প অতিমূল্যায়িত হয়েছে তা নয়, প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। বিশেষ করে বিদ্যুৎ তথা জ্বালানি খাতে।
মেগা প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং প্রতিষ্ঠান বিশ্লেষণ করলে তাদের সঙ্গে টাকা পাচারের খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক পাওয়া যাবে বলে প্রতীয়মান হয়। জনগণের অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে যে ক্ষুদ্র ‘অলিগার্চ’ গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে, তারা বাংলাদেশের ভবিষ্যতে বিশ্বাস করে না। ফলে এসব প্রকল্প নিয়ে রাজনৈতিক নেতারা যে আর্থসামাজিক সুফল আশা করেছিলেন, শেষ পর্যন্ত তা তাদের সন্তুষ্ট করতে পারছে না।
নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের ১৯টি এলডিসির ওপর বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ১৫টি দেশে হয় কর্তৃত্ববাদী, নয় তা হাইব্রিড সরকারের অধীনে। তা না হলে বিকৃত গণতন্ত্রের মধ্যে আছে। এর বেশির ভাগ দেশই নিদারুণ ঋণপীড়িত অবস্থায়। মেগা প্রকল্প অতিমূল্যায়িত হওয়ার সঙ্গে গণতন্ত্রের একটি সহজাত সম্পর্ক পৃথিবীব্যাপী পরিলক্ষিত হয়।
দেখার বিষয় বাংলাদেশ সে পথে হাঁটছে কিনা। বাংলাদেশে আইন আছে, নীতিমালা আছে এবং নিয়মনীতির মধ্যে থেকে সুশাসন নিশ্চিত করার কিছু প্রচেষ্টাও আছে। কিন্তু অনেক জায়গায় তা বিফল বা অচল।
সংসদীয় স্থায়ী কমিটিগুলো নিয়মিত বৈঠক করে না। স্বচ্ছতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে তিন মাস পরপর সংসদে আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে যে বিবৃতি দেওয়ার কথা, অর্থমন্ত্রী তা দেন না। অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি কেনাকাটা নিয়েই কাজ করে বেশি। আগে পেশাদার আমলারা রাজনীতিবিদদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টায় থাকতেন। এখন আমলাদের মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদের চেয়ে অতিকথনের প্রবণতা দেখা যায়। ফলে অর্থনৈতিক সুশাসনের জন্য রক্ষাকবচগুলো অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর হয়ে গেছে।
শেষ করব এই বলে যে, বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার পর্যালোচনা বাদ দিয়ে জাতীয় ঋণ পরিস্থিতির আলোচনা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো