Published in সকালের খবর on Sunday, 8 January 2017
পোশাক রফতানিতে ৪ হাজার কোটি টাকার আয় কমেছে
এসএম আলমগীর
রফতানি বাণিজ্যের ৮০ শতাংশের ওপর আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। এ খাতের রফতানি কোনো কারণে বাধাগ্রস্ত হলে পুরো রফতানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যার প্রতিফলন দেখা গেছে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) রফতানি আয়ে। এ সময় নিটওয়্যার ও ওভেন খাত মিলে পোশাক শিল্পে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে মোট রফতানি আয় কমেছে ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। তবে শুধু ওভেন খাতেই আয় কমেছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
তৈরি পোশাক শিল্পে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রফতানি আয় কমার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা। আর অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়ার কারণেই পোশাক খাতে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গত মাসে আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ। এই কারণে আশুলিয়াসহ সাভার ও পুরো গাজীপুর এলাকার পোশাক রফতানি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। উদ্যোক্তারা সময়মতো পোশাক রফতানি করতে পারেননি। এ ছাড়া পুরো পোশাক শিল্পেই চরম গ্যাস সঙ্কট চলছে। এ কারণে উত্পাদন অনেক কমেছে। এরও প্রভাব পড়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে ক্রেতারা পোশাক কেনা কিছুটা কমিয়েছেন। এর বাইরেও ইউরো ও ব্রিটিশ পাউন্ডের অবমূল্যায়নও আয় কমার পেছনে ভূমিকা রেখেছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো সম্প্রতি প্রকাশিত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথমার্ধের রফতানির যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এই ৬ মাসে ওভেন ও নিটওয়্যার খাত মিলে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ হাজার ৪২৫ কোটি ৮০ লাখ ডলার বা ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৪ কোটি টাকার (১ ডলার = ৮০ টাকার হিসাবে)। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ১ হাজার ৩৭০ কোটি ৯৭ লাখ ডলারের বা ১ লাখ ৯ হাজার ৬৭৭ কোটি ৬০ লাখ টাকার। অর্থাত্ পোশাক খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৪ হাজার ৩৯৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার।
এদিকে পোশাক শিল্পের নিটওয়্যারে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলেও মূলত ওভেনে আয় কমার কারণেই এই ঘাটতি। ওভেনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। ছয় মাসে ওভেনে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৬০ কোটি ৮৬ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৬০ হাজার ৮৬৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এ বিপরীতে আয় হয়েছে ৬৮৯ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার ডলার বা ৫৫ হাজার ১৬৮ কোটি ৯৬ লাখ টাকা।
ইপিবির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে নিটওয়্যার পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৩৩৫ কোটি ৫৪ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওই বছরের ছয় মাসে আয় হয়েছিল ৬৪৩ কোটি ২০ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার।
চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে নিটওয়্যার পণ্যে রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ৬৬৫ কোটি ৬ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। আলোচ্য সময়ের মধ্যে এই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে ৬৮১ কোটি ৩৫ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় আলোচ্য খাতের রফতানি আয় ৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়েছে।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়েছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ওভেন গার্মেন্টস পণ্য রফতানিতে আয় হয়েছিল ১ হাজার ৪৭৩ কোটি ৮৭ লাখ ৪০ হাজার মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ওই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে আয় হয়েছিল ৬৭০ কোটি ৩৫ লাখ ৩০ হাজার মার্কিন ডলার।
পোশাক শিল্পের আয় কমার বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে পোশাক রফতানিতে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও একই সময় আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি পূরণ হয়নি। এ অর্থবছরের শুরু থেকেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এটা পোশাক শিল্পের জন্য ভালো ইঙ্গিত নয়। পোশাকে রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকলেও আমি মনে করি প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত সক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এ জন্য প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, ভারত ও পাকিস্তান যেখানে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় করছে এবং ওইসব দেশের প্রবৃদ্ধি যেখানে ১০-এর ওপরে, সেখানে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা তো পূরণ করতেই পারছে না, উল্টো প্রবৃদ্ধি আগের অর্থবছরের চেয়ে আরও কমছে। বিষয়গুলো নিয়ে উদ্যোক্তা ও সরকারকে ভাবতে হবে।
আর বিজিএমইএ নেতা ফারুক হাসান এ বিষয়ে আরও বলেন, প্রতিযোগী দেশগুলোর সরকার উদ্যোক্তাদের নানাভাবে সহায়তা দিচ্ছে। ওইসব দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কট নেই। সে দেশের সরকার উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দিচ্ছে। আমাদের দেশে নতুন বাজারে ছাড়া প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না। নতুন বাজারে প্রণোদনা দেওয়ায় প্রথম কয়েক বছর নতুন বাজারে পোশাক রফতানিতে ভালো গ্রোথ হলেও এখন সেটিও ঝিমিয়ে গেছে। আমরা চাই সরকার যেন প্রণোদনা বাড়ায়। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম কমানো দরকার, বন্দরের বিভিন্ন চার্জ কমানো দরকার এবং নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ দিতে হবে, তাহলে পোশাক রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে।