প্রত্যাশা প্রাপ্তির হিসাব নিকাশ – ফাহমিদা খাতুন

দৈনিক সমকাল

আসছে সংসদ অধিবেশনে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হবে। গত বছর থেকে পূর্ণাঙ্গ জেন্ডার বাজেট তৈরি শুরু হয়েছে। নারীর উন্নয়নের ক্ষেত্রে যা খুবই ইতিবাচক দিক। তবে বাজেটের এই বরাদ্দ নারীর উন্নয়নে কতটা ব্যবহার হচ্ছে তা দেখাও জরুরি। প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির বিষয়ে বিশিষ্টজনরা কী ভাবছেন, তা জানার চেষ্টা করেছেন আ হ ম ফয়সল

ড. ফাহমিদা খাতুন
গবেষণা প্রধান, সিপিডি

গত ৪-৫ বছর ধরে জেন্ডার বাজেট হয়ে আসছে। এখন এটির মূল্যায়ন হওয়া উচিত। দেখা উচিত জেন্ডার বাজেট বাস্তবায়ন করার পর নারীদের মধ্যে কতটুকু পরিবর্তন এসেছে। কতটুকু আয় বেড়েছে, কতটুকু বেকারত্ব কমেছে ইত্যাদি। তবে জেন্ডার বাজেট বরাদ্দের বিষয়টি আরও স্পস্ট হওয়া প্রয়োজন। এক্সক্লুসিভলি এ খাতে নারীর জন্য কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো, তা উল্লেখ থাকা উচিত। আগামী বাজেটে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবীদের কথা চিন্তা করে তাদের হোস্টেল, শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র, পরিবহনের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। তা ছাড়া দেশে যে সব খাতে ভাতা বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার পরিধি ও পরিমাণ আরও বৃদ্ধি
হওয়া প্রয়োজন। তবে এ ক্ষেত্রে ভাতা গ্রহীতাদের হাতে কতটুকু পেঁৗছে তা নিশ্চিত করতে হবে। মধ্যস্বত্বভোগীর তৎপরতা বন্ধ করতে হবে। সত্যিকারের ব্যক্তিদের হাতে ভাতা পেঁৗছতে হবে। নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদের ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করার পাশাপাশি দক্ষতা উন্নয়ন ও বাজারজাতকরণে প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বাজেট বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন।

তাছাড়া পোশাকশিল্পে ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিক। তাদের আয় ছেলেদের তুলনায় কম। এ জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বাড়াতে হবে। সাভারে ভবন ধসে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পোশাক শ্রমিকদের আয়ের উৎস নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। তাদের জন্য এবারের বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। শ্রমবাজারে নারীর উপস্থিতিও বাড়ছে, প্রতিযোগিতামূলক ডিজিটাল যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নারীদের জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বাড়াতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও তৎপর হতে হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত থাকতে হবে।

ড. শামসুল আলম
সদস্য, পরিকল্পনা কমিশন

বাজেট প্রণয়নের আগে দুটি বিষয় দেখা হয়। প্রথমত, এটি দরিদ্রদের জন্য কতটা সহায়ক; দ্বিতীয়ত, জেন্ডার সুবিধা কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে। পুরো বাজেটের ৫২ শতাংশ জেন্ডার সংশ্লিষ্টতা থাকে। বিশেষ করে নারীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। দরিদ্র্য নারীর জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা একটি কার্যকরী ও অনন্য উদ্যোগ। এটির প্রতি আমরা বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এ ভাতা প্রদানের ফলে নারীর অনেকগুলো অধিকার সংরক্ষণের পাশাপাশি সরকারের অনেক লক্ষ্যও বাস্তবায়ন হচ্ছে। আসছে বাজেটে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ থাকছে। এখানেও নারীদের সুযোগ থাকছে। নীতিগতভাবে সরকার স্কুলগুলোতে নারী শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। এটি জেন্ডারসহায়ক। প্রাথমিকের মতো মাধ্যমিক স্কুলগুলোতেও নারী শিক্ষকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সচেতনভাবেই বাজেট প্রণয়নের আগে জেন্ডার বিষয়টি খেয়াল রাখা হয়। মন্ত্রণালয়ের রাজস্ব খাতের বরাদ্দ ঠিকই খরচ হয় কিন্তু কখনও কখনও দেখা গেছে, উন্নয়ন বাজেটের প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দগুলো বাস্তবায়ন হয় না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। সরকারের শেষ বছর হওয়ায় এবারের বাজেটকে অনেকে নির্বাচনের বাজেট বলছে, এটি ঠিক নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। নিয়ম মেনেই বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন হয়। বাজেট ঘোষণার পর এ সরকার ১৫-২০ ভাগ বাস্তবায়ন করার সময় পাচ্ছে। সর্বোপরি নারীর জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি করলেই চলবে না, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নারীদের আরও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সচিব পর্যায়ে নারীর সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।

ড. তৌফিক আহমদ চৌধুরী
সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

গত বছর থেকেই পূর্ণাঙ্গ জেন্ডার বাজেট তৈরি শুরু হয়েছে। বাজেট বরাদ্দ দিলেই চলবে না, বড় কথা হলো যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সেটার বাস্তবায়ন কতটুকু হচ্ছে_ সরকারকে সে দিকে নজর দিতে হবে। বরাদ্দ অর্থ সত্যিকারভাবে কাজে লাগছে কি-না তা দেখতে হবে। নারীর জন্য শুধু মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় না, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে সেক্টরভিত্তিক তাদের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয়। নারী উন্নয়নে সরকার বাজেটে যে বরাদ্দটুকু দেয়, সেটির এখন মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। বিভিন্ন সময়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের বাজেট নিয়ে মূল্যায়ন করে থাকে; কিন্তু সরকার নিজে মূল্যায়ন করে না। এ ক্ষেত্রে সরকারের নিজে থেকেই কাজের মূল্যায়ন করা উচিত। নারী নীতি করা হয়েছে কিন্তু এটি বাস্তবায়নে আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন। পাশাপাশি নারীর স্বাস্থ্য-শিক্ষার দিকেও সরকারকে নজর দিতে হবে। বিভিন্ন অফিস-আদালতে নারীর ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন করাও দরকার। নারীদের বড় একটি অংশ গার্মেন্ট শিল্পের সঙ্গে জড়িত। তাদের দেখশোনা করার কাজটিও সরকারকে করতে হবে। গার্মেন্ট শিল্পে নারী শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে, সাভার ট্রাজেডি থেকে শিক্ষা নিয়ে সরকারের তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করতে হবে। এ সব প্রতিষ্ঠানগুলোতে লোকবল সংকট রয়েছে। এ জন্য আসছে বাজেটে বরাদ্দ থাকা উচিত।

সঙ্গীতা আহমেদ
সভাপতি, বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাস্ট্রিজ

সমাজে বৈষম্য রয়েছে, এ জন্য গত কয়েক বছর ধরে জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে। যখন বৈষম্য থাকবে না তখন আর জেন্ডার বাজেটের প্রয়োজন হবে না। নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যের দিকে সরকারকে নজর দিতে হবে। বিশেষত নারীর নিরাপত্তার দিকেও সরকারের দৃষ্টি দেওয়া জরুরি। নিরাপত্তার অভাব অনেক কাজকে ব্যাহত করে। নারী নিরাপত্তা পেলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে তাতে দেশের উন্নয়ন ঘটবে। আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের বাজেটে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণলায়কে ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কোনো কোনো খাতে সেই বরাদ্দের টাকা খরচও হয়েছে। এখনও অনেকগুলো খাত বাস্তবায়ন বাকি রয়েছে। আগামী বাজেটে নতুন করে বরাদ্দ চাই না, আমরা আশা করছি নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতার উন্নয়নে বরাদ্দকৃত বাজেট বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতা থাকবে। তাছাড়া পোশাকশিল্পে কর্মরত নারীদের জন্য এবারের বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকতে হবে। কেননা, সাভারে ভবন ধসে যে সব নারী কর্মক্ষমতা হারিয়েছে, সে সব নারীর আগের দক্ষতাকে অনুসরণ করে প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি পোশাক কারখানাগুলোর গুণগত মান নির্ণয়ে সরকার একটি বিশেষ টিম গঠন করতে পারে। কারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিন বছরের একটি পরিকল্পনা সরকার এবারের বাজেটে নিতে পারে। এর বাইরে তৃণমূলের নারীর উন্নয়নে সামাজিক নিরাপত্তা খাতকেও গুরুত্ব দিতে হবে। পাশপাশি তাদের ক্ষুদ্রঋণের মধ্যে না রেখে মাঝারি উদ্যোক্তাতে উঠিয়ে আনতে হবে।