Originally posted in বণিকবার্তা on 21 September 2023
রফতানি খাতে বড় উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
রফতানির ক্ষেত্রে আমাদের বড় উদ্যোক্তারা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। তৈরি পোশাক শিল্প তো আছেই, সেই সঙ্গে পাট ও পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত খাদ্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, হোম টেক্সটাইলসহ অন্যান্য পণ্যও রফতানি হচ্ছে। ছোট উদ্যোক্তাদেরও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। কিন্তু বড় রফতানিকারকরা উৎপাদনের সঙ্গেও জড়িত। তাই তারা রফতানি আয়ের পাশাপাশি কর্মসংস্থানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। রিজার্ভ ও মুদ্রামান স্থিতিশীল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানোর মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখছেন। বর্তমানে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি ব্যতিক্রম। আমাদের রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশই শিল্পপণ্য। অন্যান্য দেশ বেশির ভাগ কাঁচামাল, ফুয়েল, তেল, মিনারেল রিসোর্সেস ইত্যাদি রফতানি করে। কিন্তু বাংলাদেশে যেহেতু শিল্পপণ্যের রফতানি বেশি, সেক্ষেত্রে শিল্পায়নেও বড় উদ্যোক্তাদের ভূমিকা আছে। বাংলাদেশ যে ৮০-৯০ দশকের বৈদেশিক সহায়তানির্ভর একটি দেশ থেকে বাণিজ্যনির্ভর একটি দেশে রূপান্তরিত হয়েছে, তার পেছনে তাদের ইতিবাচক ভূমিকা আছে।
রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে বড় উদ্যোক্তাদের ভূমিকা কী?
আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে তারা রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে আরো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন। বিভিন্ন দেশের রফতানিকারকদের দেখা যায়, তারা একই পণ্য বিভিন্ন রেঞ্জে রফতানি করেন। এতে তারা বাজার সম্পর্কে জানেন। বায়ারদের সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক তৈরি হয়। তখন তারা অন্যান্য পণ্যও রফতানি করার সুযোগ পেয়ে থাকেন। এতে তাদের লাভ আরো বেশি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেখছি, অনেক বড় উদ্যোক্তা দীর্ঘ সময় ধরে একই পণ্য রফতানি করছেন। এমনকি অন্তঃতৈরি পোশাক বৈচিত্র্যকরণেও তারা তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু তৈরি পোশাকের মধ্যেও তো আরো বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। আরো বেশি ভ্যালু অ্যাডিশন করা যায়। ডিজাইন ও ফ্যাশনে বৈচিত্র্য আনা যায়। আমাদের দেশে সম্প্রতি বড় উদ্যোক্তাদের মধ্যে রফতানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণের কিছু প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, পণ্য বৈচিত্র্যকরণের ব্যাপারে আমি বলব যে তৈরি পোশাকের ভেতরেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাকের বাইরেও সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্য খুঁজতে হবে। তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের তিন-চতুর্থাংশই কটন বেজড। কিন্তু গ্লোবাল মার্কেটে তিন-চতুর্থাংশই হলো মেন মেড ফাইবার। আমি আশা করি, আমাদের উদ্যোক্তারা আরো বেশি হারে মেন মেড ফাইবারের দিকে ঝুঁকবেন। এক্ষেত্রে সরকারের প্রণোদনা কাঠামোয় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে রফতানি পণ্য বৈচিত্র্যকরণকে উৎসাহিত করতে হবে। তৈরি পোশাকের বাইরে আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালস, প্লাস্টিক ও চামড়া খাতেও বড় ধরনের সুযোগ আছে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে। আমরা যেহেতু তুলা উৎপাদন করি না, সেহেতু তৈরি পোশাক খাতে আমাদের নিট ভ্যালু অ্যাডিশন কিন্তু তুলনামূলক কম। কিন্তু পাট ও পাটজাত দ্রব্য, ফার্মাসিউটিক্যালস, চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় মূল্য সংযোজন অনেক বেশি। শতকরা ৮০-৯০ ভাগ। ১০০ ডলার যদি আমি বিক্রি করি ৮০-৯০ ডলার আমার দেশে থাকে। যেখানে তৈরি পোশাকে থাকে মাত্র ৫৫-৬০ ডলার। তো নিট রফতানি তৈরি পোশাক ছাড়া অন্যান্য খাতে কিন্তু অনেক বেশি। আমি আশা করি, এসব জায়গায় উদ্যোক্তারা আরো সামনের দিকে এগিয়ে আসবেন। দেশের স্থানীয় মূল্য সংযোজন বেশি হলে কর্মসংস্থানও বেশি হয়। রফতানির ক্ষেত্রে সেবা খাতের উদ্যোক্তা তৈরিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে এখনো সেবা খাতের রফতানি অনেক কম। ভারত ১৫ হাজার কোটি ডলারের আইসিটি-নির্ভর সেবা রফতানি করে। অথচ আমরা ২০২৫ সালের মধ্যে মাত্র ৫০০ কোটি ডলারের আইসিটিনির্ভর সেবা রফতানি করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। গত বছর আমরা মাত্র ২০০ কোটি ডলারের মতো আইটি অ্যানাবলড সেবা রফতানি করেছি। সেবা খাতে উদ্যোক্তাদের আরো ভালোভাবে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। ভারতের পরে আমাদের দেশেই ফ্রিল্যান্সার সবচেয়ে বেশি। সে তুলনায় কিন্তু আমাদের রফতানি এখনো অনেক কম। আবার টাকার অবমূল্যায়নের কারণে উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও বেড়েছে। সেক্ষেত্রে তাদের একটি বাড়তি সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের রফতানির মাত্র ১২ শতাংশ যায় দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয়। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর রফতানি আয়ের একটি বড় অংশই তো এশিয়া থেকে আসার কথা। এটিকে বলা হয় এশিয়ান সেঞ্চুরি। সেসব দেশের বাজারে কিন্তু আমরা এখনো উল্লেখযোগ্যভাবে প্রবেশ করতে পারিনি। এসব বাজার থেকে আমরা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমদানি করি। কিন্তু রফতানি মাত্র ১২ শতাংশ। এ জায়গাগুলোয় আমাদের কাজ করার সুযোগ আছে। এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক উন্নত। এসব দেশের বাজারে রফতানি বাড়াতে হলে আমাদের যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ—তিনটি বিষয়কে সমন্বয় করে সুযোগগুলো সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বাড়ানোর মাধ্যমে আমরা নিট রফতানি আয় বাড়াতে পারি। একই সঙ্গে আমাদের ফরোয়ার্ড লিংকেজ তথা মার্কেটিং বাড়াতে হবে। ভারত ও ভিয়েতনাম এরই মধ্যে সেখানে শক্ত অবস্থানে আছে। আমরাও ফরোয়ার্ড লিংকেজ নিশ্চিত করতে পারলে আরো বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারব।
রফতানি খাত শ্রমিকদের জন্য কর্মসংস্থান ও অন্যান্য ক্ষেত্রে কতটুকু সহায়ক হয়েছে? তারা কতটা উপকৃত হচ্ছে?
বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শ্রমিকদের শ্রমের ওপর রফতানি খাত দাঁড়িয়ে আছে। তাদের জন্য শোভন কর্মপরিবেশ ও শোভন মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। প্রথম দিকে যখন এ শিল্প গড়ে ওঠে, তখন অনেক ধরনের সমস্যা ছিল। ২০১৩ সালে আমরা রানা প্লাজার মতো ট্র্যাজেডি দেখেছি। কিন্তু তারপর কারখানার কর্মপরিবেশ, ফ্যাক্টরির নিরাপত্তা, আগুন, বিদ্যুৎ, অবকাঠামো ইত্যাদি বিষয়ের উন্নতি হয়েছে। এটি অবশ্যই ইতিবাচক। কিন্তু অনেক জায়গায় ট্রেড ইউনিয়ন নেই। এটি কিন্তু শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার। তা কিন্তু কোনো কোনো জায়গায় স্বীকৃত নয়, আবার অনেক জায়গায় বাস্তবায়ন হয়নি। অনেক জায়গায় এটিকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করা হয়। এগুলো নেতিবাচক দিক। আর মজুরির ক্ষেত্রে বলতে হয়, শ্রমিকরা যে ন্যূনতম মজুরি পান, তা কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার খরচের তুলনায় অনেক কম। এটি একটি চ্যালেঞ্জ। কারণ রফতানিকারকদেরও মুনাফা করতে হবে, আবার শ্রমিকদের জন্যও শোভন মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ও রফতানিতে ভ্যালু অ্যাডিশন করে এগুলো সমাধান করতে হবে। শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকদের বেতন প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়বে। কিন্তু আমাদের তো এখন খাদ্য মূল্যস্ফীতিই সাড়ে ১২ শতাংশ। তার মানে তার ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে যাচ্ছে। এখন আবার নতুন মজুরি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তারা ডিসেম্বরের মধ্যে হয়তো একটি নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করবেন। এটি মাথায় রাখতে হবে যে শ্রমিকদেরও সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। কারণ তারা ভালো না থাকলে তো উৎপাদনও বাড়বে না। আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের বায়াররা কিন্তু শ্রমিকদের অধিকারের বিষয়ে খুবই সচেতন। এলডিসি গ্রুপ থেকে উত্তরণের পর এসব নজরদারি আরো শক্তিশালী হবে। এরই মধ্যে আইএলও আমাদের কর্মপরিবেশ নিয়ে বেশকিছু আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এসব বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। শ্রমিকদের প্রতি যেন কোনো অন্যায়-অবিচার না হয়। শ্রমিকদের ভালোভাবে রাখতে পারলে আমাদের রফতানিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।
রফতানি খাতে নতুন উদ্যোক্তাদের কী ধরনের সুযোগ দেয়া প্রয়োজন?
নতুন উদ্যোক্তারা যেন প্রতিযোগিতা সক্ষমভাবে করতে পারেন, সে পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সেটি সামষ্টিক অর্থনীতির ওপরও নির্ভর করে। যদি মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি হয়, তাহলে কিন্তু নতুন উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে অনুৎসাহী হবেন। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখন আমরা দেখছি যে উদ্যোক্তারা বেশি ঋণ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করছেন। কারণ তারা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন না। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে শ্রমিকরা অনেক বেশি মজুরি দাবি করছেন। ফলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তখন তাদের আর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা থাকে না। তাই সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে হবে। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি, ব্যবস্থাপনা, সুশাসন ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের প্রণোদনা কাঠামোকেও পুনর্বিন্যাস করা প্রয়োজন। মানসম্মত বিদ্যুৎ ও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। ওয়ানস্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট অনুযায়ী তরুণ উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন সেবা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আবার সেবা খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য একটি বড় সমস্যা আমাদের ইন্টারনেটের কম গতি এবং বেশি খরচ। সেক্ষেত্রে ইন্টারনেটের গতি ও গুণগত মান বাড়াতে হবে।