Originally posted in সমকাল on 12 October 2023
বায়ান্ন বছর আগে আমরা যখন স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম, তখন পুরুষদের তুলনায় নারীদের অবস্থান অনেক ক্ষেত্রেই ছিল পিছিয়ে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, রাজনীতি সবখানেই নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য ছিল চরমভাবে দৃশ্যমান। যেমন ৭০-এর দশকে নারীর গড় আয়ু ছিল ৪০, সেখানে পুরুষের ছিল ৪৪।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েরা ছিল ৩৬ শতাংশ, মাধ্যমিকে মাত্র ১০ শতাংশ। শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ছিল ৪ শতাংশের মতো। প্রশাসন, পররাষ্ট্র দপ্তরসহ অনেক চাকরিতে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় পাস করলেও নারীদের নেওয়া হতো না। শিক্ষকতা ও চিকিৎসা এই দুটি চাকরিতেই তখন নারীদের দেখা যেত। সেই যুগে বিচারিক আদালতে নারী আইনজীবী খুঁজে পাওয়া যেত না। মিডিয়াতে তেমন কোনো নারী সাংবাদিক ছিলেন না। ঘরের বাইরে রাস্তাঘাটে, বাজারে, খুবসংখ্যক নারীকে দেখা যেত।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে তাই আমাদের প্রধান প্রচেষ্টা ছিল নারীদের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে পুরুষদের সঙ্গে সমানভাবে যুক্ত করা। স্বাস্থ্যগত অবস্থার উন্নতি, শিক্ষার হার বাড়ানো, শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ বাড়ানো ইত্যাদি বিষয়ে আমরা সচেষ্ট ছিলাম। এসব ব্যাপারে গত পাঁচ দশকে আমাদের ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, নারীদের সার্বিকভাবে অনেক উন্নতিও হয়েছে। যেমন– এখন নারীদের গড় আয়ু ৭৬ যা পুরুষদের, যাদের গড় আয়ু ৭১, তার তুলনায় বেশি। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েদের সংখ্যা প্রায় সমান। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা বেশি। শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ৩৮ শতাংশ। গার্মেন্টকর্মীই শুধু নয়; এখন পুলিশ, সামরিক বাহিনী, প্রশাসন, সাংবাদিকতা, আইন পেশা– সব জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ ব্যাপক পরিমাণে বেড়েছে। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বহু নারীকে ঘরের বাইরে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত দেখা যায়।
তবে নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন পুরোপুরি সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়নি। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান– এসব ব্যাপারে নারীর অবস্থানের অনেক উন্নতি হয়েছে। কিছুটা ক্ষমতায়নও হয়েছে; কিন্তু উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন এই দুই ধারণা একেবারে এক রকম নয়। উন্নয়ন হলেই যে ক্ষমতায়ন হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে আমরা বুঝি তার নিজের জীবনের, পরিবারের, সমাজের এবং রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলোর ব্যাপরে তার স্বাধীনতা ও সক্ষমতা। এখনও পুরুষের নিয়ন্ত্রণে আছে? আমরা দেখছি, নারীরা আগের তুলনায় এখন বেশি শিক্ষিত হচ্ছে, অর্থ উপার্জন করছে। কিন্তু অনেক সময়ই শিক্ষিত নারীরাও নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে পুরুষনির্ভর। নিজের উপার্জনের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নারীরা রাখতে পারছে না। অনেক পরিবারের জন্য নারীদের আয় দরকার। তাই তাদের চাকরি করতে দিচ্ছে। কিন্তু নারীরা যে আয় করছে, সেটি তারা কতটা নিজের পছন্দমতো খরচ করছে? বহু শিক্ষিত ও অর্থ উপার্জনকারী নারীও ঘরে-বাইরে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বেশির ভাগ নারীই এসব অবিচার, অত্যাচার নীরবে মেনে নিয়ে দিনযাপন করছে।
বাংলাদেশে এবং সারা পৃথিবীতেই গত পঞ্চাশ-ষাট বছরে নারীর উন্নয়ন অনেক হয়েছে। কিন্তু তিনটি বিষয়ে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা অর্জন করা কঠিন হচ্ছে। প্রথমটি আয় এবং সম্পত্তি, দ্বিতীয়টি নেতৃত্ব এবং তৃতীয়টি সমাজের রীতিনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি। প্রথমত, আমরা দেখতে পাচ্ছি শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যাচ্ছে; কিন্তু আয় সেই তুলনায় বাড়ছে না। তার কারণ নারীরা এখনও নিম্নস্তরে কাজ করছে। আমাদের দেশে পোশাকশিল্পের নারী কর্মীরাই কর্মজীবী নারীদের বহুলাংশ। সম্পত্তির ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে আছে। কারণ নারীরা বাবা ও স্বামীর সম্পত্তিতে সমান উত্তরাধিকার পাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, নেতৃত্বের জায়গাটা; তা কর্ম জগতেই হোক বা রাজনীতিতেই হোক– নেতৃত্ব এখনও পুরুষদের দখলে। খুব সমসংখ্যক নারী সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে পারছে। রাজনীতিতে– দুই প্রধান দলে শীর্ষ নেতৃত্ব ব্যতীত সাধারণভাবে নারী নেতৃত্বের উপস্থিতি কম। উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ কিংবা সংসদে নারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করছে সংরক্ষিত মহিলা আসন। সরাসরি নির্বাচন করে খুব কমসংখ্যক নারীই নেতৃত্বের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারছে।
যে জায়গায় নারী-পুরুষের বৈষম্য থেকেই যাচ্ছে তা হলো সমাজের রীতিনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে। কোনটা পুরুষের কাজ, কোনটা নারীর, পুরুষ কেমন ব্যবহার করবে, নারী কেমন করবে– এসব সামাজিক রীতিনীতি এখনও খুব বেশি পাল্টায়নি। এই জায়গায় পরিবর্তন আনা কঠিন হচ্ছে। যেমন– পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশে নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থকরী উপার্জনের ক্ষেত্রে অনেক উন্নতি হয়েছে; কিন্তু এখনও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার এবং নারীর প্রতি সহিংসতার হার দক্ষিণ এশিয়া এবং পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় অনেক বেশি। বাল্যবিয়ে এবং নারীর প্রতি সহিংসতার হার এই দুটি পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, সমাজের রীতিনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনও তেমন বদলায়নি। কভিডের সময়ই আমরা দেখেছি, অনেক পরিবার মেয়েদের আর শিক্ষায় উৎসাহিত করছে না। তাদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেদের পড়াচ্ছে। করোনাকালে মেয়েদের বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়া এবং বাল্যবিয়ে দুটিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদের দেশে নারীর ক্ষমতায়নের অবস্থা কতটা ভঙ্গুর।
নারীর ক্ষমতায়নের পথে মূল প্রতিবন্ধকতা এখনও সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের কাজটা নারী-পুরুষ উভয়কেই করতে হবে। বিশেষ করে রাষ্ট্রকে এর দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের দেশে রাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করে; কিন্তু সেসব নীতি অনেক সময় বাস্তবে প্রয়োগ হয় না, কিংবা নীতি অমান্যকারীরা তেমন শাস্তির মুখোমুখি হয় না। পৃথিবীর যেসব দেশে গত পঞ্চাশ বছরে নারীর অবস্থান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে, যেমন নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক এসব দেশে নারীবান্ধব সরকারি/বেসরকারি নীতির প্রয়োগ এবং নারীদের অবস্থানের ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে কিনা, সেই লক্ষ্যের উপার্জনের ওপর গভীর দৃষ্টি রাখা হয়েছিল। যেমন– সুইডেনে নিয়ম আছে, সংসদে নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নারীদের ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ মনোনয়ন দিতে বাধ্য থাকতে হবে। এই নিয়মটা সে দেশে মানা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে রাজনৈতিক দলগুলো এই ধরনের বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে চায় না। আমরা যদি সর্বস্তরে নারী নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, তাহলে আমাদের সব প্রতিষ্ঠানকেই একটা পরিকল্পনা করতে হবে কীভাবে আগামী ১০-১৫ বছরে আমরা নারীদের ৩০-৪০ শতাংশ নেতৃত্বের স্থানে উন্নীত করতে পারব। অবশ্য শুধু সংখ্যার টার্গেট দিয়েই নারী নেতৃত্ব বাড়ানো যাবে না। তার জন্য অন্যান্য নারীবান্ধব নীতি, কাজকর্ম ও পরিবেশ প্রয়োজন। নারীর প্রয়োজন সময়ের। এখনও ঘরের বেশির ভাগ কাজ নারীদেরই করতে হয়। ঘরের কাজ, অর্থকরী কাজ করার পর নারীদের হাতে খুব কম সময় থাকে অন্য কাজে অংশগ্রহণ করার। যেমন– সমাজসেবা, রাজনীতি বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অনেক ক্ষেত্রে কাজের পরিবেশ নারীবান্ধব নয়। যেমন– আমাদের রাজনীতির জগতের প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রচুর অর্থ এবং পেশিশক্তি। বহু নারীর জন্য এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। রাজনীতির জগতের পরিবেশ নারীবান্ধব হতে হবে। অনেক কর্মস্থলে নারীরা যৌন হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হচ্ছে। কর্মস্থলে নারীর প্রতি হয়রানি বা সহিংসতার ব্যাপারে জিরো টলারেন্স পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
নারীর প্রতি সহিংসতা এবং এ সহিংসতার হাত থেকে মুক্তির উপায়– এই দুটি বিষয়ই আমাদের সমাজের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির আর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। নারীশিক্ষা, নারীর অর্থ উপার্জনের অনেক উন্নতি হলেও ঘরে-বাইরে নারীর প্রতি সহিংসতার হার কমছে না। এই সহিংসতার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার পন্থা একজন নারীকে বা তার পরিবারকেই নিতে হচ্ছে। পুরুষ সমাজ যারা সাধারণত সমাজে কর্তৃত্ব করছে, তারা নারীকে সহিংসতার হাত থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে তেমন ভূমিকা রাখছে না। নারী মুক্তির আন্দোলন নিশ্চয়ই নারীরাই করবে; কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা করছে সাধারণত পুরুষরা। তাই এই সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, এই সহিংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দায়িত্ব যেসব পুরুষ এসব সহিংসতায় লিপ্ত নয় তাদেরই নিতে হবে। এ দায়িত্বটা শুধু নারী, তার পরিবার বা নারী সংঘটনের ওপর ফেলে রাখা চলবে না।
লেখক: সম্মাননীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)