Originally posted in বণিকবার্তা on 9 October 2024
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যাকে কখনই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে পূর্বাভাসের ভিত্তিতে সঠিক পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় কবলিত হয়
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যাকে কখনই প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। তবে পূর্বাভাসের ভিত্তিতে সঠিক পরিকল্পনা ও পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যায় কবলিত হয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো। মানুষের ঘরবাড়ি, খেত-খামার, পুকুর, গুদাম, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে যায়। মানুষ পানিবন্দি হয়ে খাদ্য সংকটসহ নানা দুর্ভোগে পড়ে। এসব মানুষকে ত্রাণ সহায়তার জন্য সরকারের তহবিলে দেশের সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সাধারণ মানুষ অর্থসহায়তা দেয়। এছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগে বন্যাদুর্গত এলাকায় ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। কিন্তু শুরু থেকেই ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে। সমন্বয়হীনতার কারণে এ ত্রাণসহায়তা সঠিকভাবে বণ্টন করা হয়নি। কিছু এলাকায় বেশি ত্রাণ দেয়া হয়েছে এবং কোনো কোনো এলাকায় ত্রাণ পৌঁছেনি। ত্রাণসহায়তার কার্যক্রমটি সমন্বিত উদ্যোগে করা সম্ভব হলে মানুষের দুর্ভোগ ও দুর্দশা অনেকাংশেই কমিয়ে আনা সম্ভব।
সিপিডি বলছে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১৪ হাজার ৪২১ কোটি টাকা, যা দেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ২৬ শতাংশ। এ অঞ্চলের ১১ জেলার বন্যাদুর্গত এলাকায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। এ খাতে ক্ষতি ৫ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। এছাড়া অবকাঠামো খাতে ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৬৫৩ কোটি টাকার। এ ভয়াবহ বন্যায় এসব জেলার ঘরবাড়ি, সহায়-সম্পদ হারিয়ে অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ে। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ অসংখ্য অবকাঠামো নষ্ট হয়ে পড়ে। মাছচাষী, পোলট্রি উদ্যোক্তা, খামারি, কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫০৪টি ইউনিয়নের খেত, খামারসহ বিভিন্ন অবকাঠামো।
এসব জেলায় যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে কাটিয়ে ওঠা কঠিন ও দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার। তবে সমন্বিত উদ্যোগে বন্যার্তদের অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়া হলে এ বিপর্যয় সামলে ওঠা আরো কঠিন হয়ে পড়বে। বন্যার ক্ষত কাটিয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সরকারকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে প্রশাসন, এনজিও, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে উদ্যোগ নিতে হবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনর্বাসনে সরকার যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বন্যাকবলিত অঞ্চলে ত্রাণ পৌঁছার ক্ষেত্রেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা গেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান কেবল ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণেই বেশি ব্যস্ত ছিল। যদিও তাদের পর্যবেক্ষণে বন্যার ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসেনি। তবে বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ দেখা গেছে। দুর্গত এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন সংস্কারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতার উল্লেখযোগ্য কোনো নজির দেখা যাচ্ছে না।
বন্যার সময়ে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে স্বেচ্ছাসেবীরা বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়েছিলেন। তারা সেসব এলাকার রাস্তাঘাটের সঙ্গে অপরিচিত থাকায় এবং শহর ও গ্রাম পানির নিচে ডুবে থাকায় এবং কোনো যানবাহনের সুবিধা না থাকায় তারা অন্য কোথাও যেতে পারেননি। স্বেচ্ছাসেবীদের এক দলের সঙ্গে অন্য দলের সমন্বয় না থাকায় ঘুরেফিরে একই জায়গায় ত্রাণ বিতরণের ঘটনাও ঘটেছে। সমন্বহীনতার কারণে তারা ত্রাণ নিয়ে প্রত্যন্ত এলাকায় যেতে পারেননি। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ ত্রাণসহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের নজর বাড়ানো দরকার ছিল। কিন্তু সেটিও হয়নি। এক্ষেত্রে সরকারেরও সঠিক পদক্ষেপের ঘাটতি ছিল। এখন বন্যা উপদ্রুত এলাকার জনজীবন ও অবকাঠামোর দৃশ্যমান উন্নয়নে পদক্ষেপ জরুরি।
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে গতকালও ময়মনসিংহ, শেরপুর ও নেত্রকোনা জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার অবনতি ঘটেছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মানুষের ঘরবাড়ি, খেতখামার, পুকুর, হাটবাজার, রাস্তাঘাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকেই বন্যার পানিতে আটকে পড়েছে। এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় মানুষের সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে এসব জেলার মানুষের জনদুর্ভোগ সহজেই অনুমেয়। খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব তৈরি হয়েছে। আবার পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে আসতে পারছে না। এখন যা দরকার, তা হলো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ, যাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তদের কাছে অবিলম্বে সাহায্য পৌঁছানো যায়। এছাড়া পানিবন্দি মানুষকে দ্রুত উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করা। সবকিছু তলিয়ে যাওয়ায় সেখানে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার, ওষুধসহ বিভিন্ন মৌলিক জিনিসপত্রের তীব্র সংকট। হাজার হাজার মানুষ অপেক্ষায় আছে তাদের উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে আনাসহ প্রয়োজনীয় ত্রাণের জন্য। এ মুহূর্তে প্রধান করণীয় হলো বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া। এসব এলাকার মানুষের কাছে দ্রুত ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোর পাশাপাশি উদ্ধারকাজ অব্যাহত রাখতে হবে। যারা আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে, বাড়িতে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত। উদ্ধার কাজে সেনাবাহিনী ও দু-একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধারে কাজ করছে। প্রয়োজনে উদ্ধারকাজে প্রশাসনের পাশাপাশি সব ধরনের নিরাপত্তা বাহিনীকে পুরোপুরি সম্পৃক্ত করতে হবে।
অক্সফামের তথ্য অনুযায়ী, বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনী ও নোয়াখালী জেলা। এ দুই জেলার ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হয়েছে ৪৮ শতাংশ বাড়িঘর। এছাড়া দুই জেলার পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও সুপেয় পানির সুবিধা শতভাগ অচল হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাবে, শুধু ফেনী জেলায় অন্তত ২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। ফেনীর ছয় উপজেলায় ৩৮ হাজার হেক্টর জমির ফসল পুরোপুরি নষ্ট হওয়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার কৃষক পরিবারের ক্ষতি হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকার বেশি। এসব এলাকার কৃষিজমিতে তিন-চার ফুট বালি জমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে ফসল উৎপাদনে। কিন্তু বন্যায় নোয়াখালী জেলা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ত্রাণসহায়তা পেয়েছে অনেক কম। সিপিডির তথ্যানুযায়ী, নোয়াখালী জেলায় ১৬ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ জেলায় বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। সে হিসাবে প্রতিজন পেয়েছে ৯৩ টাকা। অন্যদিকে সিলেটে সাড়ে নয় হাজার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এ জেলায় ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি ৫০ লাখ। ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা। প্রতিজন ত্রাণ পেয়েছে ১৫ হাজার ৩২০ টাকা।
বন্যা-পরবর্তী ক্ষত কাটাতে যেসব অঞ্চল বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেসব এলাকায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে ওই এলাকায় কৃষিসহ সব ধরনের উৎপাদন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা হুমকিতে পড়বে।
সর্বোপরি প্রত্যেকের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে প্রয়োজন অনুসারে সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে, বিশেষ করে যাদের ঘরবাড়ি ও কৃষি, মৎস্য খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের ত্রাণ বিতরণসহ বিভিন্ন সেবা প্রদানে কোনো পক্ষপাতিত্ব করার সুযোগ নেই। যত দ্রুত সম্ভব মানুষকে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।