Published in প্রথম আলো on Monday 1 May 2017
সুপরিকল্পিত নগর বাসস্থানের অধিকার
যাঁরা অংশ নিলেন
ড. কামাল হোসেন : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও সভাপতি, ব্লাস্ট
আনিসুল হক : মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
নজরুল ইসলাম : চেয়ারম্যান, নগর গবেষণাকেন্দ্র
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য : বিশেষ ফেলো, সিপিডি
মোহাম্মদ আবু সাদেক : পরিচালক, হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট
ফেরদৌস জাহান : অধ্যাপক, জনপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ইকবাল হাবিব : স্থপতি, যুগ্ম সম্পাদক, বাপা
আশেকুর রহমান : নগর কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ, ইউএনডিপি
মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন : সমন্বয়ক, আরবান বাংলাদেশ
সালমা এ শফি : স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজ
সারা হোসেন : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
আবুল কাশেম : যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, নগর দরিদ্র বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থা
সঞ্চালক
আব্দুল কাইয়ুম : সহযোগী সম্পাদক, প্রথম আলো
আলোচনায় সুপারিশ
* ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ বস্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। তাই আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বয়কারী হিসেবে ভূমিকা নিতে পারে
* এনজিওগুলো দরিদ্রদের জন্য কাজ করছে। কিন্তু তাদের আবাসন নিয়ে ভাবছে না। এখন তাদের এ খাতে বিনিয়োগ করতে হবে
* ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে দ্রুতগতির ট্রেন যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে
* শহরের আবাসন কোম্পানিগুলো শুধু ধনীদের জন্য আবাসন করছে। এখন বস্তিবাসীসহ দরিদ্রদের জন্যও আবাসনের দায়িত্ব নিতে হবে
* শিল্পমালিকদেরও তাঁদের শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে
আলোচনা
আব্দুল কাইয়ুম: সবার জন্য বাসস্থানের সুব্যবস্থা থাকতে হবে। এ জন্য পরিকল্পনা দরকার। এর সঙ্গে পরিবেশ সুরক্ষাসহ অনেক বিষয় জড়িত। এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি কী? কীভাবে সবার বাসস্থান হবে? এমন অনেক প্রশ্ন আছে। একটি শহর গড়ে ওঠে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক বৃদ্ধির ভিত্তিতে।কিন্তু আমাদের নগরগুলো সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠেনি। ঢাকা মহানগরেই রয়েছে অনেক অব্যবস্থাপনা। নগরের বিশাল একটা জনগোষ্ঠী দরিদ্র।
নগরের বস্তিতে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের অনেক সমস্যা রয়েছে। আজকের আলোচনায় এসব আসবে। এখন আলোচনা করবেন ড. কামাল হোসেন।
ড. কামাল হোসেন: প্রায় ২৫ বছর যাবৎ বস্তিবাসীদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ ও তাদের বাসস্থানের অধিকার নিয়ে আদালতে বিভিন্ন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করছি। মেয়র আনিসুল হক বস্তিবাসীদের সমস্যা নিয়ে ভাবেন। পুড়ে যাওয়া কড়াইল বস্তিতে সবুজ টিনের ঘরের ব্যবস্থা করেছেন। ১৯৮৯ সালে প্রথম বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ শুরু হয়। তখন এই গরিব মানুষদের পক্ষে আদালতে কিছু করার চেষ্টা করি।
স্বাধীনতার পর থেকে মানুষের চাপে রাজধানী অনেক বড় হয়েছে। কিন্তু প্রায় পরিকল্পনাহীনভাবে এই নগরের আয়তন বেড়ে যাচ্ছে। ২০৫০ সালে যদি মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়, তাহলে কী অবস্থা হবে, সেটা চিন্তাই করা যায় না।
আমাদের মাঝে মেয়র আনিসুল হক আছেন। ইতিমধ্যে তিনি ভালো কাজ করে অনেক মানুষের আস্থাভাজন হয়েছেন।
আশা করি তিনি নগরের দরিদ্র জনগণ, বিশেষ করে বস্তিবাসীদের আবাসনের বিষয় নিয়ে গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন।
ফেরদৌস জাহান: আবাসন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এখন পৃথিবীর ৫৪ ভাগ মানুষ শহরে বাস করে। প্রতিবছর শহরে অতিরিক্ত মানুষ বসবাস শুরু করছে। কিন্তু শহর কি এই বাড়তি মানুষকে গ্রহণ করার জন্য তৈরি? সেভাবে কি আমাদের শহরগুলো প্রস্তুত করা হচ্ছে? হচ্ছে না। তাহলে ২০৫০ সালে দেশের শহরগুলোর অবস্থা কী হবে? কখনো কখনো বস্তিবাসীদের বসবাসের বিষয় সামনে এসেছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুব বেশি কাজ হয়নি।
বস্তিবাসীদের আবাসনের জন্য ভাষানটেক হতে পারত একটা সুন্দর উদাহরণ। অথচ কিছু আবাসন কোম্পানি এটা এক অর্থে ছিনতাই করে নিল।
এখানে মুম্বাইয়ের উদাহরণ দেওয়া যায়। মুম্বাই আরবান ট্রান্সপোর্টের আওতায় ৫০ হাজারের বেশি মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ মুম্বাইয়ে রিয়েল এস্টেট ঢাকা থেকে বেশি দামি।
ফেডারেল সরকার, মহারাষ্ট্র সরকার, রিয়েল এস্টেট ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি, মুম্বাই আরবান ট্রান্সপোর্ট ও এনজিও—সবাই মিলে কাজ করেছে।
এখানে বস্তিবাসীদের আবাসনের জন্য নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি দেওয়া হয়েছিল। আমরাও ইচ্ছা করলে বস্তিবাসীদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে পারি। এটা খুব বড় সমস্যা নয়।
আবুল কাশেম: নদীভাঙন, জমিজমা না থাকা, গ্রামে আয়ের সুযোগ না থাকা, দারিদ্র্য—বিভিন্ন কারণে শহরে আসি। উপায়হীন হয়ে শহরে আসি। গ্রামে আমাদের জমিজমা থাকলে, কাজ করার সুযোগ থাকলে শহরে অাসতাম না। আমরা শহরের মানুষের জন্য বোঝা নই। বিভিন্নভাবে শহরে অবদান রাখি। আমরা কাজ না করলে অনেক ক্ষেত্রে শহরের স্বাভাবিক পরিবেশ ঠিক থাকবে না। তাই আমাদেরও এই শহরে প্রয়োজন আছে।
বছরের পর বছর এই শহরে বাস করি। সন্তানসন্ততি এখানেই বড় হয়। তারাও এই শহরে কাজ করে। কিন্তু আমাদের কখনো আবাসন হয় না। আমাদের আবাসনের িবষয়টি সবার ভাবা প্রয়োজন।
ঢাকা শহরের আশপাশে অনেক খাসজমি আছে। এসব জমিতে আমাদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করছি। বিনা মূল্যে এ সুবিধা চাই না। কিস্তিতে মূল্য পরিশোধ করব। তবে আবাসনের মূল্য যেন কম হয়।
মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন: মিরপুরে ছয় কাঠা জমির ওপর দরিদ্রদের জন্য আবাসন তৈরি করেছি। আমরা এটা প্রমাণ করতে পেরেছি যে ভালো ব্যবস্থাপনা থাকলে দরিদ্রদের জন্য আবাসন তৈরি করা যায়। এখানে এরা গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি পাচ্ছে। দরিদ্র মানুষ এখানে ইজ্জত-সম্ভ্রম নিয়ে বাস করছে। বনশ্রীতে আমাদের এক বিঘা জমি আছে। তহবিলের অভাবে দরিদ্র মানুষের জন্য বাসস্থান করতে পারছি না। ব্যাংক থেকে বেশি সুদে ঋণ নিলে এটা সবার জন্য বোঝা হবে।
সহজ শর্তে তহবিল জোগাড় করতে পারলে বনশ্রীর এক বিঘা জমিতে বহুসংখ্যক দরিদ্র মানুষের জন্য আবাসন করতে পারতাম। আমরা দরিদ্র মানুষের স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রায় ১২৫টা এনজিও ঢাকা মহানগরে কাজ করে। জেলা প্রশাসক অফিসে এর তালিকা আছে। আমরা কে কী করি, প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের অফিসে এটা জানাতে হয়।
ঢাকা মহানগরসহ দেশে দরিদ্র মানুষের জন্য এনজিওগুলো অনেক কিছু করছে। কিন্তু এদের কেউ শহর এলাকায় দরিদ্র মানুষের আবাসনের কথা ভাবছে না।
এখন সময় এসেছে এনজিওগুলোর আবাসনের বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার। এসব মানুষের যদি থাকার জায়গা না থাকে, তাহলে অন্যভাবে সাহায্য করলে তারা কতটা লাভবান হবে, এনিজওগুলোর এটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
সারা হোসেন: আইনগত ও নীতিগতভাবে বস্তিবাসীদের জন্য সিটি করপোরেশনের করণীয় রয়েছে। গত ২৫ বছরে বস্তিবাসীদের জন্য অনেক নির্দেশনা আদালত থেকে দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকও তাঁর রায়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন ঢাকার একটি বস্তির সব বাসিন্দাকে দুই বছরের মধ্যে পুনর্বাসন করার জন্য। কিন্তু তা এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
এসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন কর্তৃপক্ষকে, যেমন পাবলিক ওয়ার্কস, রাজউক ইত্যাদি।
ঢাকা মহানগরের অধিকাংশ বস্তি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে। তাই এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সমন্বয়কারী হিসেবে ভূমিকা নিতে পারে।
২০১৭ সালের নতুন হাউজিং নীতিতে অনেক বিষয় এসেছে। এখানে দরিদ্রদের কীভাবে পুনর্বাসন করা হবে, ভূমি ব্যবহারের নীতি কী হবে ইত্যাদি বিষয় আছে।
কিন্তু এসব বিষয় সমন্বয় করে কোথা থেকে কাজ হবে, কীভাবে হবে, বিষয়টা পরিষ্কার নয়। এখানে কাউকে না কাউকে নেতৃত্ব দিতে হবে। হাউজিং পলিসি কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সেটা নিয়ে কাজ করা প্রয়োজন।
ভাষানটেকে আদালতের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও কেন এত সমস্যা দেখা দিল, সেটার ওপর গবেষণা হওয়া উচিত। সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগের মধ্যে কীভাবে সমন্বয় হবে, এ বিষয়গুলো সরকারের কর্মপরিকল্পনার মধ্যে আনতে হবে।
ইকবাল হাবিব: নগরের বাসিন্দা কারা? নগর কি শুধু ধনী, বড় ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ—তাঁদের জন্য, না সব শ্রেণি-পেশার মানুষের? টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরব্যবস্থার কথা বলা আছে।
সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই দরিদ্র মানুষের কথা ভাবছে। তাহলে কেন তাদের আবাসন হবে না? তবে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দরিদ্রদের জন্য স্থায়ীভাবে কিছু না করার একধরনের মত থাকলেও থাকতে পারে। রাষ্ট্র গরিবের জমি নিয়ে উত্তরা, ঝিলমিল ও পূর্বাচলে একাধিক প্রকল্প করে ধনীদের আরও সুবিধা দিচ্ছে।
এখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধা থাকছে। এসব প্লট আবার তারা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা জমা করছে। তাহলে বস্তিবাসীসহ অন্য দরিদ্রদের জন্য কি রাষ্ট্র আবাসনের ব্যবস্থা করবে না?
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান মাত্র ৩ দশমিক ৮ শতাংশ সুদে দরিদ্র মানুষকে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। সরকারের ইচ্ছা না থাকলে এটা হতে পারে না।
মাননীয় মেয়র আনিসুল হক বস্তিবাসীদের উন্নয়নে আমাদের সঙ্গে তখন কাজও করেছেন। এই নগরে ধনীদের চেয়ে প্রতি বর্গমিটারে অনেক বেশি ভাড়া দেয় দরিদ্ররা।
আমরা ১ দশমিক ৭২ একর জায়গায় একটি প্রকল্প শুরু করেছি মোহাম্মাদী গ্রুপের জন্য। ৬১৯ বর্গফুটের অনেক ইউনিট হবে। এর মধ্যে পরিবার ও মেস ভিত্তিতে থাকা যাবে।
এই প্রকল্প অনুমোদনের মধ্য দিয়ে আরও ২৬টি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। এই ২৬টি প্রকল্পে মোট ২৫ হাজার ইউনিট হবে। এ ক্ষেত্রে কারখানার মালিককে শুধু শ্রমিকদের আবাসন তৈরির জন্য এ ঋণ দেওয়া হবে।
তবে সরকারের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাজ করে। এগুলো দূর করার জন্য একটা শক্ত নেতৃত্ব প্রয়োজন। দুই মেয়রকে ঘিরে নগরবাসীর অনেক প্রত্যাশা। তাঁদের এই নেতৃত্ব দিতে হবে। তাঁরাই এ সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে নগরে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ বাস করবে। এসডিজিরও ১১ নম্বর লক্ষ্যে নগরের বিষয়টি এসেছে।
নগরের সঙ্গে কমিউনিটি, হিউম্যান সেটেলমেন্ট বিষয়গুলো যুক্ত করা হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে এসডিজির লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে অনেক উপাত্তের প্রয়োজন।
এসব তথ্য-উপাত্তের জন্য আবার গবেষণা করতে হবে। এ কাজগুলো না করলে আমরা ফলপ্রসূভাবে এগোতে পারব না।
নগরে বস্তিবাসীসহ দরিদ্রদের আবাসন করলে একটি প্রশ্ন সামনে আসে যে নগরে আরও দরিদ্র মানুষকে আহ্বান করছি কি না? নগর অভিভাবকের একার পক্ষে এসব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। কারণ, নগরের যে জনগোষ্ঠীকে নিয়ে আলোচনা, এদের দুই রকমের বৈশিষ্ট্য।
প্রথমত, এদের একটি অংশ অন্তর্বর্তীকালীন জনসংখ্যা। অর্থাৎ সমাজের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কাঠামোগত যে রূপান্তর হচ্ছে, সে জন্য অনেকে সাময়িক সময়ের জন্য এখানে অবস্থান করছে। অনেকে একটি পেশা থেকে অন্য একটি পেশায় যাওয়ার জন্য অবস্থান করছে।
দ্বিতীয়ত, এরা বিবর্তনশীল। বিশ্বের অনেক দেশের বস্তিবাসীদের টেলিভিশন, ফ্রিজ—সবই আছে। সব ক্ষেত্রে বস্তিবাসী মানুষ মানেই দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষ, এটাও ঠিক নয়।
দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারার ফল হলো বস্তি সমস্যা। একটি দেশে তিনটি মাত্র বড় শহর। জিডিপির ৭৫ শতাংশ এখান থেকে আসে।
এই অবস্থায় যতই বস্তিবাসীর আবাসন সমস্যা দূর করা হোক, এটা কখনো টেকসই হবে না। বিষয়টিকে অনেক ব্যাপক পরিসরে দেখতে হবে।
দেশের সার্বিক কর্মসংস্থান, অন্যান্য নগরের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান সবকিছুর ওপর নির্ভর করে। বস্তি সমস্যার বিষয়টিকে অর্থনীতির ধারণার মধ্যে আনতে হবে। অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রবণতা, পরিকল্পনা, নীতি—এসব বিষয়ের সঙ্গে সমন্বয় করতে না পারলে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
গ্রামীণ অর্থনীতি বেগবান, বিদেশে আরও বেশি জনশক্তি রপ্তানি, দেশে ব্যাপক বিনিয়োগ ও শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে যত বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যাবে, তত এ সমস্যার সমাধান হবে।
এখন বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের ১০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক খাতে, ৯০ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে। অনানুষ্ঠানিক খাতে যত বেশি কর্মসংস্থান হবে, তত বেশি বস্তিতে থাকতে হবে।
বস্তি গড়ে ওঠার বড় কারণ দুর্বিষহ যোগাযোগব্যবস্থা। ১০০ কিলোমিটার দূর থেকে অফিস করা মোটেই কোনো কঠিন কাজ নয়।
ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোর সঙ্গে দ্রুতগতির ট্রেন যোগাযোগব্যবস্থা থাকলে বস্তি সমস্যা অনেকটাই কমে যেতে পারে। এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে।
পৃথিবীতে বৈষম্য সৃষ্টির বড় কারণ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি। এর ওপর বড় ধরনের কর বসানো উচিত। ধনীদের এ শহরে নিরাপদে বসবাস করতে হলে দরিদ্র মানুষের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
আশেকুর রহমান: সরকার গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের গৃহায়ণের বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভাবছে। এ ক্ষেত্রে সরকার অনেক কাজও করছে। যেমন গুচ্ছগ্রাম, আদর্শ গ্রাম, ঘরে ফেরা কর্মসূচি, একটি বাড়ি একটি খামার, আশ্রয়ণ প্রকল্প ইত্যাদি।
সরকার প্রতিবছর বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় এসব প্রকল্পে অনেক বিনিয়োগ করে। এসব প্রকল্প গ্রামভিত্তিক। অথচ দেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ শহরে বাস করে।
সরকার যে বিশাল বিনিয়োগ গ্রামে করছে, সামান্য নীতি ও কৌশল পরিবর্তন করে এর এক-তৃতীয়াংশ বা কম-বেশি শহরে বিনিয়োগ করতে পারে।
ক্ষুদ্র ঋণদান প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশাল তহবিল রয়েছে। এরা দরিদ্র মানুষের আবাসন নিয়ে প্রায় কোনো কাজই করে না। দরিদ্র মানুষ সাধারণত ঋণের টাকা ফেরত দেয়, এমন অনেক উদাহরণ আছে।
মনে হয় এখন সময় এসেছে এনজিওগুলোর কজের ধরন পরিবর্তন করার।
শহরের আবাসন কোম্পানিগুলো শুধু ধনীদের জন্য আবাসন করছে। দরিদ্র মানুষের আবাসনের কথা তারা প্রায় ভাবছে না বললেই চলে।
অথচ দরিদ্ররা ধনীদের থেকে অনেক বেশি ভাড়া দিয়ে এই শহরে থাকে। এর অর্থ তাদেরও আবাসনের অর্থ ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য আছে।
শহরে বাসস্থান তৈরির জন্য জমির মূল্যসহ অন্যান্য ব্যয় অস্বাভাবিক বেশি। সরকার এ দুটো ক্ষেত্রে কিছু পরিমাণ অর্থ ভর্তুকি দিতে পারে।
এ ক্ষেত্রে সামাজিক উদ্যোগও কাজে লাগতে পারে। অর্থায়ন একটা বড় সমস্যা। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংক এগিয়ে আসতে পারে।
সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের সঙ্গে জনসম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি। তাঁদের কাছে নগরের মানুষের অনেক দাবি থাকে। কিন্তু আবাসনের ক্ষেত্রে তাঁদের আইনগত দায়িত্ব খুবই কম।
এ ক্ষেত্রে কিছু বিধিবিধান পরিবর্তন করে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোকে আবাসনের দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
নজরুল ইসলাম: একজন বস্তিবাসী সাধারণত দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া দেন। এরশাদ সরকার যখন বস্তি উচ্ছেদের উদ্যোগ নিল, সে সময় আমিই প্রথম বলেছিলাম, দরিদ্র মানুষ প্রতি বর্গফুটে ধনীদের থেকে বেশি ভাড়া দেয়।
দরিদ্র মানুষ প্রতি বর্গফুটে বেশি ভাড়া দেয়, এটা ঠিক আছে। কিন্তু সর্বোচ্চ কত ভাড়া দেয়—কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে এটাও বিবেচনার বিষয়।
বঙ্গবন্ধুর সময় ডেমরা, টঙ্গী ও মিরপুরে রাজউক, ওয়াসা এবং সরকারি জমিতে ৭৫ হাজার বাস্তুহারা মানুষকে পুনর্বাসন করা হয়। পরবর্তীকালে এরা এ জমির মালিক হয়।
এরশাদের সময় টঙ্গীতে বস্তিবাসীদের দুই রুমের ঘর করে দেওয়া হয়। নামকরণ করা হয় এরশাদ নগর। স্বাধীনতার পূর্ব ও পর থেকে নগরের অনেক পরিকল্পনা হয়েছে। এখনো হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, এগুলো কীভাবে হচ্ছে। কীভাবে বাস্তবায়িত হবে ইত্যাদি।
সারা দেশের নগর পরিকল্পনার সার্বিক বাস্তবায়ন হওয়া প্রয়োজন। বিশেষ শহরগুলো যেমন ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করতে হবে।
পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসব আছে। এসবের বাস্তবায়ন হলে নিয়মের মধ্যে আসতে পারব। আমরা নগরে বাসস্থানের কথা বলছি। সরকার ন্যাশনাল হাউজিং পলিসি পাস করেছে। এর মধ্যে আবাসনের সব সমস্যার সমাধান আছে। সরকার সে দায়িত্ব নিয়েছে।
ঢাকার জন্য ২০১৫ সালে তৈরি করা সরকারের মাস্টারপ্ল্যান আছে। এখানেও দরিদ্রসহ সবার আবাসন কীভাবে হবে, সেটার আলোচনা আছে।
সরকারের মাস্টারপ্ল্যানে শহরে বস্তিসহ দরিদ্রদের আবাসনের কথা যেভাবে আছে, সেটাই যদি সরকার বাস্তবায়ন করে, তাহলেই কিন্তু আবাসন সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির সাড়ে ৬০০ একর জমি। ১২ হাজার শিক্ষার্থী। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ একর জমি। ২২ হাজার শিক্ষার্থী।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার কাছে দশকের পর দশক অনেক জমি পড়ে আছে। ইচ্ছে করলে কিছু নিয়মনীতির সংশোধন করে মেয়র এখানে বস্তিবাসীর জন্য আবাসন প্রকল্প করতে পারেন।
সালমা এ শফি: আমার প্রশ্ন হলো, বড় মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলো কেন দরিদ্রদের আবাসনের সমস্যার বিষয়ে ভাবে না? এরা কেন আবাসন খাতে কাজ করে না? যারা এ ক্ষেত্রে কাজ করতে চায়, আমরা তাদের সহযোগিতা করি।
নগর দরিদ্র বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থার প্রকল্পে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছি। আমি শহরের এনজিওগুলোর সঙ্গে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্প করি।
নগর দরিদ্র বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থা থেকে একবার আমাকে বলা হলো যে মিরপুর সেক্টর ২-এ জমি কেনা হয়েছে। কিন্তু কাজ করতে পারছে না। আমি প্ল্যান করে দিলাম।
এটা রাজউক থেকে পাস হলো। ছয়তলা বাড়ি হলো। ৪০টি ফ্ল্যাট হলো। এ প্রকল্পে কাজ শেষ করে ফ্ল্যাট হস্তান্তর করা হয়েছে।
এ সংস্থা আবার বনশ্রীতে এক বিঘা জমি কিনেছে। এটার নকশা করে দিয়েছি।
মোহাম্মদ আবু সাদেক: হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু প্রতিষ্ঠা করেন। সবার জন্য আবাসন করা এর উদ্দেশ্য ছিল। কয়েক বছর এর কার্যক্রম বন্ধ ছিল।
বর্তমান সরকারের আমলে অনেক গবেষণার কাজ হয়েছে। আমরা ৩০ শতাংশ কম খরচে পরিবেশবান্ধব ভবন করতে পারছি। এটা আমাদের গবেষণার ফল। ভূমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের ফলে দেশের জমির ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
আমাদের প্রযুক্তিতে উপরিভাগের মাটির ব্যবহার নেই। ভবন নির্মাণ ব্যয় কম। ভবন যেন ভূমিকম্প–সহনীয় হয়, আমরা সে প্রযুক্তি বের করেছি। রড, সিমেন্ট, পাথরের ব্যবহার কীভাবে কমানো যায়, সে প্রযুক্তি বের করেছি।
আমরা একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, আমাদের জমিতে কোনোভাবে বস্তি থাকতে পারে না।
সরকারের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় বস্তি হবে? আমাদের অনেক জায়গার প্রয়োজন। কারণ, সব কটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো আমাদের করা হয়নি।
সরকার বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জে দরিদ্র মানুষের জন্য প্রকল্প নিয়েছে। ঢাকাতে এইচবিআরআই ও ন্যাশনাল হাউজিং মিলে মিরপুরে ১০০টা ফ্ল্যাট করবে। এর প্রতিটি ফ্ল্যাট হবে ৩৫০ থেকে ৪৫০ বর্গফুট। বস্তিবাসী এখানে প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা ভাড়ায় থাকতে পারবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কোনো ফ্ল্যাট বিক্রি হবে না। কারণ, এখানে যারা বাস করবে, একদিন তাদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে। তারা এখান থেকে আরও ভালো জায়গায় যাবে।
সরকার কিন্তু বস্তিবাসীসহ সবার জন্য কাজ করছে। সরকার যেমন সরকারি কর্মচারীদের থাকার আবাসন দেয়, তেমনি পোশাকশিল্পসহ সব শিল্পমালিককেও তাঁদের শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
সবাই একসঙ্গে কাজ করলে নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের সমস্যা থাকবে না।
আনিসুল হক: দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নগরের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি। রাস্তাঘাট, ড্রেন ও ফুটপাত ভালো করার চেষ্টা করছি। ভবনগুলো যেন রং করা থাকে, সে চেষ্টা করছি। রাস্তাগুলো বড় করার চেষ্টা করছি। পার্কগুলোর উন্নয়ন করছি। নগরকে বাসযোগ্য করা আমার দায়িত্ব।
আমাদের অধিকার থাকা সত্ত্বেও অনেক জায়গা থেকে অবকাঠামো সরাতে পারিনি। কারণ, পেছনে কিছু অপশক্তি কাজ করে।
সরকারি জায়গায় যেসব বস্তি, এরা ভাড়া কাকে দেয়? সরকারকে দেয় না। বিভিন্ন ধরনের অপশক্তি আছে, যারা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের ভাড়া দেয়। ফলে এদের যখন অর্ধেক ভাড়ায় আবাসন করার কথা বলা হয়, তখন তারা কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বস্তির জীবন সত্যিই মানবেতর। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
সিটি করপোরেশনে বস্তি উন্নয়ন কর্মসূচি আছে। আমরা তাদের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহের কাজ করেছি। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারিনি।
শহরে অবকাঠামো করা অনেক ব্যয়বহুল ও জটিল। কিন্তু ২০ মাইল দূরে করা অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও ভালো। আমরা সবাই দাবি তুলতে পারি, ঝিলমিল প্রকল্প ২ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য করা হোক।
কত মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা হবে, এর একটা সংখ্যা ঠিক করে পরিকল্পনা করতে হবে। তা না হলে এ প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হবে না। সবকিছু আলোচনার মধ্যে থেকে যাবে।
ড. কামাল হোসেন: স্বাধীনতার এত বছরেও বস্তিবাসীর জন্য কতটুকুই–বা করতে পেরেছি। তাই রাতারাতি কিছু হবে, সেটা আশা করছি না।
১৯৯৩ সালে একটা হাউজিং নীতি হয়েছে। প্রায় ২৫ বছর পর ২০১৭ সালে আরেকটা হাউজিং পলিসি এসেছে। দুটোকে যদি পাশাপাশি রেখে পড়া হয়, অনেকগুলো বিষয় একই। সেখানে বলা আছে, আরও গবেষণা করতে হবে। বিবেচনা করতে হবে ইত্যাদি।
সংবিধানে সবার অধিকারের কথা লেখা আছে। কিন্তু এখনো আমাদের সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
বাস্তুহারা মানুষগুলো বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে প্রিয় ছিল। তিনি সব সময় তাদের কথা ভাবতেন।
আমাদের গবেষণা আছে। জানা-বোঝার খুব বেশি বাকি আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু কাজ তেমন হচ্ছে না।
মেয়রদের দায়িত্ব অনেক। নগরের মানুষের প্রত্যাশা তাঁদের কাছে। তাঁদের কাজ করার পর্যাপ্ত ক্ষমতাও থাকতে হবে।
আদালতের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি। কিন্তু কাজ কে করবে, এটাই বড় সমস্যা। দুঃখের বিষয় হলো, দেশ স্বাধীনের এত বছর পরও সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রবণতা গড়ে ওঠেনি। কোনো কাজ নির্দিষ্ট সময়ের তুলনায় কয়েক গুণ বেশি সময় লাগে শুধু সমন্বয় না থাকার জন্য।
বঙ্গবন্ধু যেমন এসব মানুষের কথা ভাবতেন, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও সেভাবে ভাবেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। এই নগরের মেয়র হিসেবে আপনাকে দায়িত্ব নিতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: এই শহর আমাদের সবার। ভালোভাবে বাস করতে হলে সবার কথাই ভাবতে হবে। কাউকে পেছনে রেখে দেশের উন্নয়ন হবে না।
তাই বস্তিবাসীসহ নিম্ন আয়ের মানুষের আবাসনের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা প্রয়োজন। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সবাইকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।