অশুল্ক বাধা ও দুর্বল যোগাযোগই বাংলাদেশ-নেপাল বাণিজ্যের প্রধান অন্তরায়: মোস্তাফিজুর রহমান

পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নেপাল-বাংলাদেশ সম্পর্ক

Originally posted in সময়ের আলো on 15 September 2025

খুঁজতে হবে বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের নতুন সুযোগ

বাংলাদেশ ও নেপাল দীর্ঘদিন ধরে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। ভৌগোলিক নৈকট্য ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের পাশাপাশি উভয় দেশের মধ্যে রয়েছে বহুমুখী সহযোগিতার সম্ভাবনা। বিশেষ করে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ সম্পর্ক আরও সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে অশুল্ক বাধা এখনও দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ভবিষ্যতে নেপালে নতুন রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন খাতে সহযোগিতা জোরদার হয়ে এ সম্পর্ক আরও গতিশীল রূপ নিতে পারে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

তরুণদের বিক্ষোভের মুখে গত মঙ্গলবার নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করার পর দেশটিতে রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়। সংকট কাটাতে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন দেশটির সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। তিনি গত শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। শপথগ্রহণের পরপরই আগামী মার্চের মধ্যে নেপালের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন সুশীলা।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিকে এরই মধ্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন। নেপালের জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতিফলন হিসেবে সুশীলা কার্কির দায়িত্ব গ্রহণকে বাংলাদেশ গুরুত্বসহকারে দেখছে বলে প্রধান উপদেষ্টা অভিনন্দন বার্তায় উল্লেখ করেন।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক এবং দুই পক্ষই ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী। দুই দেশের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বন্ধন দৃঢ়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি, জ্বালানি সহযোগিতা এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে।

বাণিজ্যের সুযোগ পূর্ণ ব্যবহার করার জন্য সব ধরনের শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। বাংলাদেশের মোংলা বন্দর ব্যবহারে নেপালের সুযোগ থাকলেও দুই দেশের বাণিজ্য বেশিরভাগ হয় বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে। সমুদ্রবন্দর কম ব্যবহারের কারণ হচ্ছে, দূরত্ব ও খরচ বেশি। নেপালে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করার সম্ভাবনা এবং বাংলাদেশের চাহিদার কারণে জলবিদ্যুৎ সহায়তা উভয় পক্ষের জন্য লাভজনক। ভারতের গ্রিডের মাধ্যমে নেপালের ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসছে। এটি দুই দেশের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনা। দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ-নেপাল অংশীদারত্ব আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। একক নির্ভরতা কমিয়ে বৈদেশিক সম্পর্ক বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টায় রয়েছে উভয় দেশ। নেপালের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশি টাকাকে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা হিসেবে বিনিময়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের পর্যটক ও নেপালের শিক্ষার্থীরা লাভবান হবেন। বাংলাদেশ ও নেপাল বহুপক্ষীয় ফোরামে একযোগে কাজ করছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, কানেক্টিভিটিতে সহযোগিতা বাড়ানোর আরও সুযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালে নেপালে বাংলাদেশ থেকে ৫০ হাজার পর্যটক বেড়াতে গেছে। নেপালের তিন হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশে পড়াশোনা করছেন, যাদের বেশিরভাগই মেডিকেল শিক্ষার্থী। নেপালের প্রতিটি হাসপাতালে বাংলাদেশের মেডিকেল গ্র্যাজুয়েট রয়েছেন, তারাই বাংলাদেশের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করছেন।

২০১৪ সালে কাঠমান্ডুতে সবশেষ সার্ক (দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর আর কোনো সামিট হয়নি। সেই সময় থেকে নেপাল সার্কের চেয়ারম্যান। সার্ক সবার সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজ করে। সে জন্য সবাই সম্মত না হলে শীর্ষ সম্মেলন, মন্ত্রিসভা বা অন্য কোনো ধরনের বৈঠক করা সম্ভব হয়নি। সার্ক পুনরুজ্জীবনের বিষয়ে নেপাল এবং বাংলাদেশ একই মনোভাব পোষণ করে। নেপালের আগের সরকার এবং বাংলাদেশ সার্ক পুনরুজ্জীবন ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার কথা বলেছিল। সামনে নেপালের রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ বিষয়ে নতুন করে আবার উভয় পক্ষ সিদ্ধান্ত নেবে।

নেপালের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কাঠমান্ডু ও ঢাকার মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারিত ও ক্রমবর্ধমান হচ্ছে এবং এটি সামনে আরও বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি ভারতের রাস্তাঘাট এবং অবকাঠামোর মাধ্যমে নেপাল ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং বিদ্যুৎ রফতানিও শুরু হয়েছে। শুষ্ক ও ঠান্ডা আবহাওয়ার কারণে বর্তমানে নিয়মিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। সামনে নেপালের রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং বিদ্যুৎ রফতানি ইস্যু গতি পাবে।

নেপালের বাণিজ্য ও রফতানি উন্নয়ন কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, নেপাল থেকে প্রধানত মসুর ডাল, বীজ, আমড়া, আদা, এলাচ, জুস এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বাংলাদেশে রফতানি করা হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে নেপালে রফতানি হওয়া প্রধান পণ্যের মধ্যে রয়েছে তৈরি পোশাক, ওষুধ, বৈদ্যুতিক পণ্য, পাটজাত পণ্য, আলুসহ অন্যান্য পণ্য। নেপালের কাস্টমস বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে নেপাল থেকে বাংলাদেশে প্রায় ৫৫ কোটি ৫০ লাখ নেপালি রুপির পণ্য রফতানি করা হয়, যেখানে বাংলাদেশ থেকে ৪২২ কোটি টাকার পণ্য আমদানি করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে অশুল্ক বাধা বাণিজ্য সম্প্রসারণের মূল অন্তরায়। পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে উন্নত ও সহজ যোগাযোগ মাধ্যমের ঘাটতি আছে। এগুলোর ক্ষেত্রে নজর দিতে হবে। নেপাল থেকে ইতিমধ্যেই ভারতীয় গ্রিড হয়ে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছে। সেই কারেণে ভারতের সহযোগিতা নিয়েই বিবিআইএনের (দক্ষিণ এশিয়ার চার দেশ- বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের মধ্যে পণ্য পরিবহনে যোগাযোগ জোট। এর মধ্যে ভুটান এই জোট থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে) আওতায় নেপালের সঙ্গে কানেক্টিভিটি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ-নেপাল বহুপক্ষীয় ফোরামে বাণিজ্য বাড়াতে একযোগে আরও কাজ করতে পারে। আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক সহযোগিতাও বাড়াতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক সময়ের আলোকে বলেন, দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সার্ক, বিমসটেক, বিবিআইএন ইত্যাদি একাধিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশ ও নেপাল একযোগে কাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। এসব সুযোগ অনুসন্ধানে কাজ করতে হবে।