বাংলাদেশ-ভুটান বৃহৎ পরিসরের পথেঃ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম

Published in সমকাল  on 13 December 2020

গত ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ভুটানের সঙ্গে প্রথম অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। ৬ ডিসেম্বর তারিখটি উভয় দেশের জন্য ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য। কারণ ১৯৭১ সালের এই দিনে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভুটান। আগামীদিনের বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে বিভিন্ন চুক্তির কাঠামোতে যাওয়ার যে উদ্যোগ, সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভুটানের সঙ্গে এই চুক্তি একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ বিভিন্ন সম্ভাবনাময় দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়টি বিবেচনা করছে। কিছু দেশের সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে এ সংক্রান্ত কিছু প্রাথমিক আলোচনাও শুরু হয়েছিল। কিছু কিছু দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে চুক্তি করার আগ্রহও প্রকাশ করেছিল। কিন্তু সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার কারণে চুক্তি সম্পাদনে কিছুটা বিলম্ব হলো। কিছুটা বিলম্বে হলেও ভুটানের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করল।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভুটানের অর্থনীতি তুলনা করলে আমরা দেখি, যেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতি ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার সমমানের জিডিপি, সেখানে ভুটানের অর্থনীতি মাত্র দুই বিলিয়ন ডলার। আকারগত দিক থেকে ভুটানের অর্থনীতি বেশ ছোট। তবে ভুটানের মাথাপিছু আয় ৩০৫০ ডলার, যেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০৬৪ ডলার। অর্থাৎ ভুটানের অর্থনীতির আকার ছোট হলেও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় দেশটির অর্থনীতি সম্ভাবনাময় বলা যায়। ছোট আকারের অর্থনীতি হলেও সেখানে ভোক্তাশ্রেণি রয়েছে, যারা বিভিন্ন আমদানিকৃত বিভিন্ন পণ্য ব্যবহার করে থাকে। ভুটান-বাংলাদেশের বাণিজ্য এখনও প্রায় সীমিত পর্যায়ে। সামগ্রিকভাবে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্যে বাংলাদেশ রপ্তানি করে মাত্র ৪২ মিলিয়ন ডলার, আর ভুটান থেকে আমদানি করা হয় প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলার। আকারগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, আমদানি-রপ্তানিও বেশ সীমিত পর্যায়ে, বিশেষত বাংলাদেশ থেকে রপ্তানির পরিমাণ একেবারেই কম। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আসবে। চুক্তির আওতায় ভুটান বাংলাদেশকে ১০০টি পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা দিতে চেয়েছে, আর বাংলাদেশ ভুটানকে ৩৪টি পণ্যে একই সুবিধা দিতে চেয়েছে। আশা করা যায়, পণ্যে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধার জন্য আগামী দিনে উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

উভয় দেশ যেসব পণ্য শুল্ক্কমুক্তের তালিকায় রেখেছে তা বিবেচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের যে পণ্যগুলো তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলো প্রচলিত ও অপ্রচলিত রপ্তানি পণ্যের মধ্যে অন্যতম। তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, কেমিক্যাল, সিরামিক, সিমেন্ট, কৃষিপণ্য, ওষুধসহ এ ধরনের পণ্যে ভুটানের দিক থেকে সুবিধা দেওয়া হয়েছে, যা ভুটানের বাজারে এসব পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। এই চুক্তির মাধ্যমে ভুটানে বাংলাদেশি বিনিয়োগের একটি ক্ষেত্রও তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ভুটানে যেহেতু কৃষিজাত পণ্য এবং প্রচুর ফলমূল রয়েছে; সুতরাং বাংলাদেশের এগ্রো-প্রসেস ইন্ডাস্ট্রিজের বড় বিনিয়োগকারীরা হয়তো সেখানে প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপন বা সেখান থেকে সেমি প্রসেস পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশে প্রসেস করে বাজারজাতকরণে বিনিয়োগ করতে পারে। যদিও সাফটার অধীনে বাংলাদেশে আগে থেকেই কিছু পণ্যে এ ধরনের সুবিধা পেয়ে আসছে- এই চুক্তির মাধ্যমে সেই তালিকা আরও সম্প্রসারিত হয়েছে। আমরা মনে করি, নতুন এ চুক্তির সুবিধা উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে এখন থেকে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ থাকা। ভুটান-বাংলাদেশের মধ্যে যদি শক্তিশালী চেম্বার না থাকে তাহলে উভয় দেশের ব্যবসায়ীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী চেম্বার গঠন করে বাণিজ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো জোরদার করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে পারে।

যেহেতু বাংলাদেশ-ভুটানের এই বাণিজ্য করার ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে ভারত রয়েছে এবং স্থলবন্দর দিয়ে মূল পণ্য পরিবহন হবে, সুতরাং ভারতের মধ্য দিয়ে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের অশুল্ক্ক বাধা না থাকে এবং বাংলাদেশ ও ভুটান যাতে নিরবচ্ছিন্নভাবে পণ্য আমদানি-রপ্তানি করতে পারে সে বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের লেনদেনের বিষয়গুলো স্বাভাবিক হয়ে এলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভুটান-ইন্ডিয়া-নেপাল মিলে যে চার দেশীয় সড়ক পরিবহন চুক্তি স্বাক্ষর করার কথা ছিল (এতে অবশ্য ভুটানের আপত্তি রয়েছে), সেটিও বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। চুক্তি অনুষ্ঠানের আলোচনায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে বন্দর ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন। ভুটানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে পণ্য চলাচল স্বাভাবিক হওয়ার ক্ষেত্রে যে প্রেক্ষাপট তৈরি হবে তার মাধ্যমে ভুটান তার অন্য বাণিজ্যিক রাষ্ট্র থেকে আমদানি বা রপ্তানি করার ক্ষেত্রে যদি বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করে, তাহলে সময় কম লাগবে এবং বাংলাদেশও বন্দর থেকে অধিক রাজস্ব আয় করতে পারবে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে চুক্তিটি ছোট আকারে হলেও আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে এর বহুমাত্রিকতা রয়েছে। এই চুক্তি যদি ইতিবাচকভাবে কাজ করে, উভয় দেশের অভিজ্ঞতার আলোকে তাহলে এটিকে দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চলে রূপান্তরেরও সুযোগ থাকবে। তবে এই চুক্তিকে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রস্তুতি এফটিএ সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা বা দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে প্রাক-প্রস্তুতি বা ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জায়গা থেকে বিবেচনা করা উচিত। এই চুক্তির ফলে ব্যবসায়ীরা কীভাবে উপকৃত হচ্ছেন, ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে কোনো জটিলতা তৈরি হচ্ছে কিনা, পণ্য পরিবহন বা চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুই দেশের ভেতরে কোনো দ্বিপক্ষীয় বিষয় উঠে আসছে কিনা- যেগুলোতে নজর রাখা দরকার, চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে লাভ কেমন হচ্ছে, গুণগতভাবে উভয় দেশ উপকৃত হচ্ছে কিনা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে কিনা অথবা কোনো কোনো খাতে চুক্তির কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কিনা- এ ধরনের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ আগামীতে এই চুক্তি থেকে লাভ করতে সক্ষম হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ উইংয়ের কাজ হবে বাংলাদেশ-ভুটান বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়নে মনোনিবেশ করা এবং নিয়মিত ভিত্তিতে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ চুক্তির ইতিবাচক দিক ও চ্যালেঞ্জগুলো সম্পর্কে অবগত হওয়া। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে অন্য যে দেশগুলোর সঙ্গে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্যিক চুক্তি করার চিন্তা করছে বা মুক্ত বাণিজ্যিক অঞ্চলের জন্য প্রস্তাব রয়েছে, সেগুলোর জন্য এ অভিজ্ঞতাগুলো কাজে দেবে। এর মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তার কারিগরি দিকগুলোতে উন্নতি করবে, যাতে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উইন উইন চুক্তি সম্পন্ন করতে পারে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে। সুতরাং এ বিষয়টি মাথায় রেখে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেশ যারা এই মুহূর্তে সরকারের বিবেচনায় রয়েছে, সে ক্ষেত্রে যেন কারিগরি দিক বিবেচনা ও সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার এগিয়ে যায়। একই সঙ্গে নতুন চুক্তির ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া না করে প্রতিটি চুক্তিকে আলাদা আলাদাভাবে তার গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং চুক্তির স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাতগুলোকে মাথায় নিয়ে কৌশলগতভাবে বাণিজ্য আলোচনাগুলো করা উচিত। এ ক্ষেত্রে কারিগরি প্রস্তুতির অংশ হিসেবে সরকারের বাইরেও যেসব গবেষণা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, এমনকি ব্যক্তি পর্যায়েও যারা গবেষণা করে থাকেন বা যারা বাণিজ্য আলোচনায় অভিজ্ঞ তাদের দক্ষতা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সরকার যেন যথাযথ সময়ে ব্যবহার করে।

 

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ