Published in বণিক বার্তা on Wednesday 3 May 2017
দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত অর্থ পাচার
দেশের প্রধান রফতানি খাত বস্ত্র ও পোশাক। সর্বশেষ অর্থবছরেও বাংলাদেশ থেকে বস্ত্র ও পোশাক রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের। আনুষ্ঠানিকভাবে এর পরই রফতানির বড় খাত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য ও মাছ। যদিও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পোশাক খাতের বাইরে অন্যান্য রফতানি পণ্যের সম্মিলিত যে আকার, তার চেয়ে বেশি অর্থ অবৈধভাবে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার-সংক্রান্ত প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশ করে আসছে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। ‘ইলিসিট ফিন্যান্সিয়াল ফ্লোজ ফ্রম ডেভেলপিং কান্ট্রিজ: ২০০৫-১৪’ শীর্ষক সর্বশেষ প্রতিবেদনটি তারা প্রকাশ করেছে ১ মে। জিএফআইয়ের প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ১ হাজার কোটি (১০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে। এর অধিকাংশই হচ্ছে আমদানি-রফতানি চালানে জালিয়াতির মাধ্যমে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বণিক বার্তাকে বলেন, অর্থ পাচার রোধে দেশে বিভিন্ন ধরনের আইন আছে। এখন সারা বিশ্বেই এ প্রবণতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। রফতানি আয়ে বাংলাদেশের যা অর্জন, তার সঙ্গে তুলনা করলে বেশ বড় পরিমাণ অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এখন অনেকে ইলেকট্রনিক পন্থা ব্যবহার করেও টাকা নিয়ে যায়। এগুলো আমরা শনাক্তের চেষ্টা করছি। যদিও দুষ্ট চক্র এ পন্থায় এরই মধ্যে আমাদের ক্ষতি করেছে। বেটার সিকিউরিটি সিস্টেম পরিচালনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি। এ বিষয়ে বিদেশীদের সাহায্যও নিচ্ছি আমরা। আর দেশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে অর্থ পাচার রোধের চেষ্টা আরো জোরালো করা হয়েছে।
জানা গেছে, আমদানিকারকদের একটি বড় সিন্ডিকেট কয়েক বছর ধরেই আমদানির নামে অর্থ পাচার করছে। অল্প কিছু জরিমানা দিয়ে পারও পেয়ে যাচ্ছে তারা। অর্থ পাচারে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে আমদানির ক্ষেত্রে পণ্যমূল্য বেশি দেখাচ্ছে, অন্যদিকে ঘোষণার সঙ্গে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণেও মিল থাকছে না। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হলেও চট্টগ্রাম, বেনাপোল ও মংলা শুল্ক গোয়েন্দার কায়িক পরীক্ষায় মিলেছে খালি কনটেইনার। কিছু কনটেইনারে কাঁচামাল আমদানির ঘোষণা দেয়া হলেও তার বদলে আনা হয়েছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের ব্লক।
গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের ‘ওয়ানটাচ বিজনেস সেন্টার কোম্পানি’ থেকে বিপি শিটের ৪৭৪ টনের দুটি চালান আমদানি করে ঢাকার সিএপি ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল। আগামপত্র অনুযায়ী, একটি চালানে ১৩ কনটেইনারে ২৮৪ টন ও অন্য চালানে নয় কনটেইনারে ১৯০ টন বিপি শিট থাকার কথা থাকলেও কায়িক পরীক্ষায় তা পাননি শুল্ক কর্মকর্তারা। এসব কনটেইনারে বিপি শিটের আদলে মাটির তৈরি ব্লক পাওয়া যায়।
গত বছরের আগস্টের শুরুতে সরিষাবীজ আমদানির নামে ৪৩টি খালি কনটেইনার আনে চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠান লাকি ট্রেড। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে একটি বেসরকারি ডিপোয় নেয়ার সময় ৪ নং গেটে স্ক্যানিং করে কনটেইনারগুলো খালি পান শুল্ক কর্মকর্তারা।
এভাবে দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। জিএফআইয়ের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুধু ২০১৩ সালেই অবৈধভাবে বাংলাদেশের বাইরে চলে গেছে ৯৬৬ কোটি ডলারের বেশি। আর ২০১৪ সালে পরিমাণটা ১ হাজার কোটি ডলার বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অস্বচ্ছ ব্যবসায়িক লেনদেন বা মিস ইনভয়েসিং ছাড়াও দুর্নীতি ও কর ফাঁকির মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে জিএফআই।
অর্থ পাচার রোধে কাজ করছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অর্থ পাচার রোধে এনবিআরের রয়েছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সেল। বহুজাতিকসহ কোম্পানির মূল্য ঘোষণার মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কাজ করছে সংস্থাটির ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল।
এনবিআর চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. নজিবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থ পাচার রোধে সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে। এনবিআরের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল সম্প্রতি অর্থ পাচার-সংক্রান্ত বেশ কয়েকটি মামলা দায়ের ও তদন্ত করছে। বহুজাতিকসহ কোম্পানির মূল্য ঘোষণার মাধ্যমে অর্থ পাচার প্রতিরোধে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল ইউনিট কাজ করছে।
জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ১ হাজার কোটি ডলার ছাড়ালেও ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয় ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার। এর আগের বছর পাচার হয় ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এছাড়া ২০০৮ ও ২০০৯ সালেও অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশের বাইরে চলে যায়। ওই দুই বছরে পাচার হয় যথাক্রমে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ও ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, জিএফআই অনুমাননির্ভর তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বলে আমার মনে হয়। তাই এ ব্যাপারে মন্তব্য করা সমীচীন হবে না। তবে অর্থ পাচার রোধে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করছে বিএফআইইউ।
এছাড়া অর্থ পাচার রোধে দুদক এখন অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে বলে জানান দুদকের সচিব আবু মো. মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক জোরালো ও কঠোর পদক্ষেপও নিয়েছে দুদক।
বাংলাদেশ থেকে বড় অংকের অর্থ পাচারের তথ্য উঠে এসেছে অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের গবেষণায়ও। জাতিসংঘের উন্নয়ন প্রকল্পের (ইউএনডিপি) তথ্যমতে, স্বাধীনতার পর চার দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ জিডিপির আকারের প্রায় ৩০ দশমিক ৪ শতাংশ।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ট্রেড মিস প্রাইসিংয়ের মাধ্যমেই অর্থ পাচারের ঘটনা বেশি ঘটছে। মোট পাচারের ৮০ শতাংশই হচ্ছে ট্রেড মিস প্রাইসিংয়ের মাধ্যমে। এছাড়া বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ট্রান্সফার মিস প্রাইসিংয়ের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হচ্ছে। এ বছরের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য বিষয়ের মধ্যে আছে বিভিন্ন দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ সে দেশের এফডিআই ও ওডিআইয়ের তুলনায়ও বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বিষয়টি একই।
পাচার বন্ধে করণীয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এনবিআরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এনবিআরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব সংস্থায় ডিজিটাইজেশন ও সুশাসন বাড়াতে হবে। বাড়াতে হবে আইনের প্রয়োগ ও এ সম্পর্কে সচেতনতা। এসব পদক্ষেপের শতভাগ কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে পারলে অর্থ পাচার রোধ সম্ভব।