Published in সমকাল on Saturday, 3 February 2018
‘নিম্ন আয়ের’ মানুষের ফ্ল্যাট কিনে নিচ্ছেন বিত্তশালীরা
প্রকল্পগুলো আসলেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য নেওয়া হয়েছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে
অমিতোষ পাল
দরিদ্র বস্তিবাসী, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য রাজধানীতে একের পর এক ফ্ল্যাট তৈরি করছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ। তবে এসব ফ্ল্যাট কেনার সামর্থ্য নেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের। কারণ দাম আকাশচুম্বী- সর্বনিম্ন ৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকারও বেশি। দরিদ্র বস্তিবাসীর প্রকল্পেও ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট কিনতে লাগছে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ফলে বস্তিবাসী, নিম্ন ও মধ্য আয়ের কথা বলে প্রকল্পগুলো নেওয়া হলেও সবই চলে যাচ্ছে বিত্তশালীদের দখলে।
নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য নেওয়া রাজউকের উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পে প্রথমে প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয় তিন হাজার ৮০০ টাকা। সব মিলিয়ে এক হাজার ৬৫৪ বর্গফুট আয়তনের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়ছে ৭০ লাখ টাকা। দ্বিতীয় ধাপে একই ফ্ল্যাটের দাম ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট চার হাজার ৮০০ টাকা। এবার একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়বে প্রায় ৯০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডিতে দাম ধরা হয়েছে প্রতি বর্গফুট সাড়ে নয় হাজার টাকা; গুলশানে সাড়ে ১২ হাজার টাকা। ফলে প্রকল্পগুলো আসলেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য নেওয়া হয়েছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। তবে সরকার বাজারদরের চেয়ে কম দামে জায়গা বরাদ্দ দিলেও এসব ফ্ল্যাট তৈরিতে কোনো ভর্তুকি দেয় না।
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ধানমণ্ডিতে প্রতি বর্গফুটের বাজারমূল্য অন্তত ১২ হাজার টাকা; গুলশানে ১৬ থেকে ১৮ হাজার টাকা। রাজউক বা গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম মূল্য নির্ধারণ করেছে। এসব ফ্ল্যাটের লোকেশন অনেক ভালো। যথেষ্ট খোলামেলা জায়গা আছে। আলো-বাতাসের অভাব নেই। খেলাধুলার জায়গা আছে, যেটা বেসরকারি কোম্পানির ফ্ল্যাটে থাকে না। এ ছাড়া অর্ধেক টাকা দিয়ে বাকি টাকা ব্যাংকঋণের মাধ্যমে পরিশোধেরও সুযোগ আছে।
রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তারা জানান, মাসিক ৬০ হাজার টাকার বেশি আয়ের ব্যক্তিকে তারা উচ্চ আয়ের হিসেবে ধরেন। ২৫ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয়ের ব্যক্তি মধ্য আয়ের ও ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকা আয়ের ব্যক্তি নিম্ন আয়ের। ১০ হাজার টাকার কম আয়ের ব্যক্তিরা দরিদ্র বা বিত্তহীন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণ করা নেই। তবে বৈশ্বিক ধারণায় দৈনিক ২ থেকে ১০ মার্কিন ডলার যার আয়, তিনি নিম্ন আয়ের। ১০ থেকে ২০ ডলার আয়ের ব্যক্তি মধ্য আয়ের। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশে দুই ডলারের উপযোগিতা এক নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চের ২০১১ সালের জরিপেও একই রকম বলা হয়েছে। সেখানে দৈনিক দুই মার্কিন ডলারের চেয়ে কম আয়ের মানুষকে দরিদ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ২০ থেকে ৫০ ডলার আয়ের ব্যক্তিকে উচ্চ-মধ্যম আয় ও ৫০ ডলারের অধিক আয়ের ব্যক্তিকে উচ্চ আয়ের মানুষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান খন্দকার আক্তারুজ্জামান এসব প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের বোর্ড সদস্য (পরিকল্পনা) এস এ এম ফজলুল করিমের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। ফজলুল করিম বলেন, বাংলাদেশে সবকিছু হিসাব করে চলে না। বাংলাদেশে অনেকের বিপুল অপ্রদর্শিত আয় থাকে। সেটা দিয়ে তারা ফ্ল্যাটের দাম পরিশোধ করে। অনেকে পারিবারিক সম্পত্তি বিক্রি করেও ফ্ল্যাট কেনে। এ ছাড়া ব্যাংকঋণ তো আছেই।
ভুক্তভোগীরা জানান, ৭০ লাখ টাকার ফ্ল্যাটের অর্ধেক দাম ৩৫ লাখ টাকা পরিশোধ করে বাকি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে সেটা ২০ বছরে পরিশোধ করতে গেলে মাসে কিস্তি আসে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা। একজন মধ্য আয়ের মানুষের সর্বোচ্চ মাসিক আয় ৬০ হাজার টাকা। কিস্তির টাকা দেওয়ার পর হাতে থাকে ২৬ হাজার টাকা। সেই টাকা দিয়ে তার পরিবারই বা কীভাবে চলবে। নিম্ন আয়ের মানুষের কথা তো বলা বাহুল্য। তারা বলেন, নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের কথা বলার এই ভণ্ডামি রাজউক ও গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের পরিহার করা প্রয়োজন।
রাজউক চেয়ারম্যান আবদুর রহমান এসব ফ্ল্যাটে নাগরিক সুবিধার বিস্তারিত তুলে ধরে বলেন, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের সঙ্গে রাজউকের চুক্তি হয়েছে। সাড়ে ৮ শতাংশ সুদে তারা ঋণ দিচ্ছে। কাজেই নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য রাজউকের ফ্ল্যাট কেনা এখন কোনো সমস্যা নয়।
নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য যেসব ফ্ল্যাট :রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, মোহাম্মদপুরের রিং রোডের পাশে ‘এফ’ ব্লকে ১৫টি ১৪ তলার ভবন তৈরি হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য। সেখানে দুই ক্যাটাগরিতে এক হাজার ও এক হাজার ২৫০ বর্গফুটের ৯০০ ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে। সেখানে প্রতি বর্গফুটের দাম ধরা হয়েছে চার হাজার ৪০০ টাকা। সঙ্গে রয়েছে ইউটিলিটি ফি, রেজিস্ট্রি খরচ, পার্কিং ফি প্রভৃতি। সব মিলিয়ে এক হাজার ২৫০ বর্গফুটের একটা ফ্ল্যাটের দাম পড়বে প্রায় ৭০ লাখ টাকা।
মিরপুরের ৯ নম্বর সেকশনেও তৈরি হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য এক হাজার ৫৬০টি ফ্ল্যাট। দাম একই। মিরপুর ১৪ নম্বরে তৈরি হচ্ছে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারের জন্য এক হাজার ৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের দাম ৪৫ লাখ টাকা। সঙ্গে ইউটিলিটি, পার্কিং, রেজিস্ট্রি খরচ। এখানেও মোট দাম পড়ছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। এ ছাড়া গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য বাস্তবায়িত হচ্ছে মিরপুরের স্বপ্ননগর-১ ও স্বপ্ননগর-২ ফ্ল্যাট প্রকল্প।
মিরপুরে বাউনিয়া বাঁধের পাশে বস্তিবাসী ও নিম্ন আয়ের জন্য হচ্ছে ফ্ল্যাট প্রকল্প। এ প্রকল্পে ৫৫০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের দাম পড়বে প্রায় ৩০ লাখ টাকা। এ ছাড়া ধানমণ্ডির ২, ৬/এ, ১২/এ নম্বর সড়কে ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। ধানমণ্ডিতে দাম ধরা হয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা। মোহাম্মদপুরের ইকবাল রোড, আসাদ এভিনিউ, হুমায়ুন রোড, এলিফ্যান্ট রোডে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের জন্য ফ্ল্যাট। এগুলোর প্রতি বর্গফুটের দাম পাঁচ হাজার ২০০ টাকা। ফ্ল্যাটের আয়তন এক হাজার ৪০০ থেকে এক হাজার ৬০০ বর্গফুট।
গুলশানের ১১৫ নম্বর সড়কের ৩২ নম্বর হোল্ডিংয়ে রাজউক তৈরি করেছে দুই হাজার ১২, দুই হাজার ৩২৪ ও দুই হাজার ১৬৫ বর্গফুটের ২৭টি ফ্ল্যাট। এগুলোর দাম ধরা হয়েছে সাড়ে ১২ হাজার টাকা প্রতি বর্গফুট। কাজেই এগুলোর দাম পড়বে পৌনে তিন কোটি টাকা।