Originally posted in বণিক বার্তা on 5 August 2024
চলমান গণ-আন্দোলন, যা ছাত্রদের কোটা সংস্কারের দাবি হিসেবে গত ১ জুলাই শুরু হয়েছিল, তা অনেক বড় সমস্যার বহিঃপ্রকাশ, যা নীতিনির্ধারকরা দীর্ঘদিন উপেক্ষা করে এসেছেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনের পেছনে রয়েছে চাপা ক্ষোভ ও বঞ্চনা বিভিন্ন আকারে যা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সমস্যার প্রকৃতি অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। কোটা সংস্কারের দাবির মাধ্যমে উন্মোচিত এ বৃহত্তর সমস্যার সমাধান ছাড়া চলমান সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না।
বর্তমান সরকার গত দেড় দশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করলেও দেশে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই। বেসরকারি বিনিয়োগ কম এবং স্থবির হওয়ার কারণে বেসরকারি খাত চাহিদা অনুযায়ী কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে না। সরকারি খাতই তরুণদের কর্মসংস্থানের একমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎস হয়ে উঠেছে। বেতন, সুযোগ-সুবিধা, চাকরির নিরাপত্তা এবং ক্ষমতা ইত্যাদির কারণে সরকারি চাকরি সবচেয়ে লোভনীয় চাকরি হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ ২০২২ অনুযায়ী গড় বেকারত্বের হার মাত্র ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ হলেও যুব বেকারত্ব ৮ শতাংশ। তদুপরি ১৫-২৪ বছর বয়সী যুবকদের যারা কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে নেই তাদের হার ৪০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। একটি সংকুচিত শ্রমবাজারে, উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। এ কারণে ৮৪ দশমিক ৯ শতাংশ চাকরি হচ্ছে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেখানে আয় ও চাকরির নিরাপত্তা কম। স্পষ্টতই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেনি। ১ শতাংশ জিডিপি বাড়লে কর্মসংস্থান সেই হারে বাড়ছে না, বরং এ বাড়ার হার কমছে।
কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব, ব্যাপক দুর্নীতি, ক্রোনিজম, বিশাল পরিমাণের ব্যাংক ঋণ খেলাপি এবং সুশাসনের অভাবের ফলে সমাজের সব স্তরের মধ্যে অর্থনৈতিক সুযোগ ও সম্পদের বণ্টন সমানভাবে হয়নি, ফলে বৈষম্য বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব অনুযায়ী ২০২২ সালে জনসংখ্যার ওপরের ৫ শতাংশের হাতে জাতীয় আয়ের ৩০ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ ছিল, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৭ দশমিক ৮২ শতাংশ। অন্যদিকে ২০২২ সালে নিচের ৫ শতাংশের হাতে ছিল জাতীয় আয়ের মাত্র দশমিক ৩৭ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে দশমিক ২৩ শতাংশ ছিল। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির চাপে মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ২০২৪ সালের জুনে বাংলাদেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। গত দুই বছরে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতার কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে।
এক দশক ধরে বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচন ছাড়াই বাংলাদেশ এখন একটি একদলীয় শাসন ব্যবস্থায় পরিণত হয়েছে। ফলে সরকারি পরিষেবার প্রতিটি ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব দেখা দিয়েছে। তাই বৈষম্য হ্রাস করা এবং জনগণের ক্ষমতায়ন, বিশেষ করে তরুণ এবং দরিদ্রদের ক্ষমতায়ন, উপযুক্ত বেতনের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করার বিষয়গুলো এখন শুধু মুখের কথার মধ্যেই কিংবা পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। বাংলাদেশ এখনো ‘পূর্ণ, উৎপাদনশীল এবং অবাধে নির্বাচিত কর্মসংস্থান’ অনুসরণ করার বিষয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কর্মসংস্থান নীতি কনভেনশন, ১৯৬৪ (নং ১২২) অনুমোদন করেনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ১৯৯৮ সালে এবং শ্রীলংকা ২০১৬ সালে অনুমোদন করেছে।
গত দেড় দশকে শাসন ব্যবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। তা হলো অত্যধিক আমলাতান্ত্রিকতা এবং অর্থনীতিতে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দক্ষতা হারানো। এ রকম একটি ব্যবস্থা জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং চাকরি দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্ন দুর্নীতি, এর মাধ্যমে বিপুল সম্পদ আহরণ এবং সরকারি সম্পদের অপব্যবহার বাড়িয়েছে। উপরন্তু, এটি ধনী ও সুবিধাভোগীদের পক্ষ নিয়েছে এবং সাধারণ মানুষ ও যুবকদের সুযোগগুলোকে শ্বাসরোধ করেছে।
যদিও কিছু সরকারি পদক্ষেপের ফলে প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো গড় সামাজিক সূচকগুলো কিছুটা উন্নত হয়েছে। তবে এ ধরনের অগ্রগতির গুণমান এবং বিতরণের সমস্যাগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে সবার সুযোগ সমান নয়। এছাড়া সামাজিক খাতে জনসম্পদ বরাদ্দ খুবই কম এবং স্থবির যদিও অর্থনীতির আকার এবং জাতীয় বাজেট উভয়ই প্রসারিত হয়েছে। চলতি ২০২৫ অর্থবছরে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ জিডিপির দশমিক ৭৪ শতাংশ এবং শিক্ষা খাতে জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। তেমনি ২০২৫ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির জন্য প্রকৃত সরকারি বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৩২ শতাংশ যা খুবই কম, যদিও সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির বরাদ্দের হিসাবের মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের জন্য পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ এবং কৃষি ভর্তুকির জন্য বরাদ্দ যোগ করে সরকার এটাকে বেশি দেখায়।
বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চলমান প্রবৃদ্ধির মডেল বিভিন্ন সময়ে আইনের শাসনকে উপেক্ষা করে সুবিধাভোগী শ্রেণীর লাভের জন্য কাজ করছে। তাদের মধ্যে সরকারি কন্ট্রাক্ট, লাইসেন্স এবং সুবিধা বণ্টনের সংস্কৃতি বেশ কয়েক বছর ধরেই বিদ্যমান। কিছু নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণীত এবং পরিবর্তিত হয়। এগুলো নীতিনির্ধারণের বিকৃতি, পৃষ্ঠপোষকতা এবং মক্কেলবাদের সুস্পষ্ট প্রতিফলন। ব্যাংক, বিদ্যুৎ ও তৈরি পোশাক খাত কয়েকটি উদাহরণ যেখানে জাতীয় স্বার্থ ও সাধারণ মানুষের স্বার্থ উপেক্ষা করে তাদের জন্য অনেক নীতি ও নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে।
সরকারি পরিষেবাগুলো পাওয়ার ক্ষেত্রে কম সুবিধাপ্রাপ্ত জনগণকে প্রায়ই কর্মকর্তাদের ঘুস ও ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় ক্যাডারদের সঙ্গে যোগাযোগ ও চাঁদা দেয়ার খবর প্রায়ই সামনে আসে। উদাহরণস্বরূপ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী কর্মসূচির সুবিধাভোগী তালিকা অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত দরিদ্র লোকদের বাদ দিয়ে এবং সাহায্য প্রয়োজন নয় এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, কারণ ক্ষমতাসীন দলের লোকরা দরিদ্রদের জন্য এ ধরনের কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে।
বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারায় ফাটল বেশ কিছুদিন ধরেই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অপর্যাপ্ত ও ভুল নীতি, অকার্যকর বাস্তবায়ন, শাসন ব্যবস্থার ঘাটতি এবং সংস্কার পদক্ষেপের অভাবের কারণে এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। এরই মধ্যে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ভেঙে গেছে। কারণ গত দুই বছরে অর্থনীতির সব মূল সূচকের অবনতি হয়েছে। নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত, ঋণের দায়দেনার পরিমাণ বৃদ্ধি, কম রফতানি ও রেমিট্যান্সের কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস, ভঙ্গুর আর্থিক খাত, নিম্ন বিনিয়োগ এবং জ্বালানি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমছে, চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে না।
দুঃখজনকভাবে নীতিনির্ধারকরা সুশাসন প্রতিষ্ঠানের জন্য উৎসাহ দেখায়নি, বরং প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রমাগতভাবে দুর্বল করা হয়েছে। অথচ এগুলো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পূর্বশর্ত। বছরের পর বছর ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতার কারণে অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত
এমন হয়ে উঠেছে, যেখানে রাজনৈতিক ধনিক গোষ্ঠী, আমলা এবং বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অল্পকিছু মানুষ দেশের বাকি জনসংখ্যাকে শোষণ করে। এগুলো কেবল একটি শিকারি রাষ্ট্রে দেখা যায়। বাংলাদেশের সরকার গত দেড় দশকে মানসম্পন্ন শিক্ষা, দক্ষতা ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে তরুণদের ক্ষমতায়ন ও অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে জনগণের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করেছে।
তাই শিক্ষার্থীরা এখন তাদের বিক্ষোভকে ন্যায়বিচারের আন্দোলন বলে অভিহিত করেছে। সারা দেশে শিক্ষার্থীদের দাবি বিভিন্ন পেশার লাখ লাখ মানুষকে ছুঁয়েছে। যে কারণে তারাও রাস্তায় নেমে এসেছে। সরকার যেভাবে ন্যায্য কারণের জন্য শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে রক্তস্নাত করেছে তাতে সরকারের নির্মম চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে। মানুষের জীবনের চেয়ে ভৌত অবকাঠামো ধ্বংসের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদর্শন বস্তুত নিহত ও আহত ছাত্র ও সাধারণ মানুষের প্রতি অসংবেদনশীলতার নিষ্ঠুর প্রকাশ। রাস্তাঘাট, স্থাপনা ইত্যাদি ভৌত অবকাঠামো তৈরি করা যায় এবং তা মানুষের করের টাকাতেই হবে। কিন্তু মানুষের জীবন কি ফিরে পাওয়া যাবে? জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র মানবতা থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়। তাই তারা সাফল্য দেখে শুধু বড় বড় স্থাপনার মাঝে। দুঃখজনকভাবে সে কারণেই বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গল্পে ন্যায়বিচার ও মানবতা নেই।
তাই ছাত্র আন্দোলন এখন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে যেখান থেকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিযোগিতাময় রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি টেকসই হতে পারে না এবং ন্যায় ও মানবিকও হতে পারে না।
– ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)