Published in যায়যায়দিন on Monday, 3 April 2017
সঞ্চয়পত্রে বহুমুখী চাপে সরকার
আবু সাইম
সঞ্চয়পত্র নিয়ে নানামুখী চাপে রয়েছে সরকার। দিন দিন সে চাপের মাত্রা বাড়ছে। মাত্রাতিরিক্ত বিক্রির কারণে বাড়তি ঋণ ও উচ্চ সুদের চাপ, সুদ হার ব্যবধানের কারণে ব্যাংকিং খাত এবং বেশি ব্যয়ের কারণে বাজেটের ওপর চাপ বাড়ছে। এর সঙ্গে সর্বশেষ যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপ। সংস্থাটি সরকারকে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমানোর পরামর্শ দিয়েছে।
তবে এত চাপের মধ্যেও সরকার এ নিয়ে অনেকটাই দোটানায় রয়েছে। কেননা, যদিও সুদের হার কমালে সরকারের ঋণের চাপ কমবে। তবে এতে সঞ্চয়পত্রের প্রধান বিনিয়োগ শ্রেণি মধ্যবিত্তের মাঝে বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও রয়েছে আবার অবসর ভোগীরাও বিপাকে পড়বেন। কিন্তু আইএমএফ বলছে, সঞ্চয়পত্রের বেশি সুদ দেশের আর্থিক খাতের আধুনিকায়ন বিঘি্নত করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির সর্বশেষ এ পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নতুন ভাবনা সৃষ্টি করেছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়ছে, এর বিপরীতে বিপুল পরিমাণ সুদ গুণতে হচ্ছে যার চাপ পড়ছে বাজেটের ওপর। সঞ্চয়পত্রের উচ্চসুদ বাজেট ঘাটতি পূরণের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
জানতে চাইলে অর্থনীতি বিশ্লেষক ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষক জায়েদ বখত যায়যায়দিনকে বলেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র ছাড়া কিছুতে ভরসা করতে পারছে না। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে চলেছে। যেহেতু ব্যাংকের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদের পরিমাণ দ্বিগুণ। তাই সরকারকে না চাইলেও বেশি সুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। এতে একদিকে সরকারের দায় বাড়ছে অন্যদিকে বাড়ছে বেশি সুদ পরিশোধের চাপ যা বাজেট ব্যবস্থাপনা ও রাজস্বের আয়ব্যয়ের হিসেবে ভারসামহীনতা তৈরি করছে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য মতে, বাজেট ঘটতি মেটাতে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ নেয়ার কথা ছিল ইতোমধ্যেই অতিক্রম করেছে। এখন যা বিক্রি হচ্ছে তা সরকারের হিসেবের বাইরে। অর্থাৎ না চাইলেও বাধ্য হয়েই সরকারকে এই ঋণ নিতে হচ্ছে। সরকারের দায়ও বাড়ছে। গুণতে হচ্ছে চড়া সুদ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ নিয়েছে ২৮ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। অথচ আগের বছরের সাত মাসে বিক্রি ছিল ১৬ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ সময়ে সরকারের ঋণগ্রহণ বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। আর বাজেটে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪৫ শতাংশ বেশি। চলতি (২০১৬-১৭) অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ‘ধার’ করার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের।
তবে ইতোমধ্যেই লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করলেও বিক্রি বন্ধ রাখার কোন পথ খোলা নেই। এতে আগামী ৫ মাসে সরকার না চাইলেও সঞ্চয়পত্র বিক্রির ঋণ নিতে বাধ্য হবে। এতে সরকারের ঋণের দায় বাড়িয়েই দেবে না বরং তা পরিশোধের চাপও বাড়িয়ে দেবে।
গত জানুয়ারিতেও রেকর্ড পরিমাণ বিনিয়োগ এসেছে সঞ্চয়পত্র থেকে। ওই মাসে সব মিলিয়ে পাঁচ হাজার ৪২০ কোটি ৫৯ লাখ টাকার নিট বিনিয়োগ এসেছে এ খাত থেকে। এ হিসেবে দিনে গড়ে ১৮০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হচ্ছে। আগের মাস ডিসেম্বরে বিক্রির পরিমাণ ছিল তিন হাজার ১৫৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি বেড়েছে দুই হাজার ২৬৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বা ৭২ শতাংশ।
এ অবস্থায় চলতি মাসের (মার্চের) প্রথম দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমাতে সরকারকে পরামর্শ দেয় আইএমএফ। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির এশিয়া-প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান ব্রায়ান এইটকেন বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্রের মতো উচ্চমূল্যের বিনিয়োগের ওপর সরকারের নির্ভরতা দেশের আর্থিক খাতের আধুনিকায়নে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির কারণে সরকারের ব্যয় বাড়ে যা লাভের বিপরীতে ব্যয় উস্কে দিচ্ছে। এই হাতিয়ারটি (সঞ্চয়পত্র) সরকারের ট্রেজারি বন্ড বা অন্যান্য সিকিউরিটিজের বাজার উন্নয়নেও বাধার সৃষ্টি করছে। এর থেকে ভালো কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ এবং তুলনামূলক কম খরচের বিকল্প যা আর্থিক বাজারকে ধ্বংস না করেও সামাজিক নীতি লক্ষ্য অর্জন করে এমন বিনিয়োগ গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছে আইএমএফ।
বিকল্প হিসেবে ব্রায়ান এটকেন বলেন, সঞ্চয়পত্র থেকে নির্ভরতা কমিয়ে বন্ড মার্কেট উন্নত করা যেতে পারে। কেননা, বন্ড মার্কেট উন্নত হলে দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগ আসবে। আবার পুঁজিবাজার উন্নত হলেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আসবে। যা বাড়তি অর্থনেতিক প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারবে।
জানতে চাইলে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজটে ঘাটতি পূরণে সরকার সঞ্চয়পত্র ছাড়াও অন্য যে বিকল্পগুলো ছিল তা ব্যবহার করতে পারত, বিশেষ করে কম ব্যয়ের ব্যাংক ঋণ। কিন্তু তা করে বেশি ব্যয়ের সঞ্চয় পত্রের নির্ভর থেকেছে। এতে সরকারের চাপ বেড়েছে। তবে এর সমাধান শুধু সুদের হার কমানো মাধ্যমেই নেই। কেননা, বর্তমানের অনেক বিত্তবানও এতে বিনিয়োগ করছে। এতে সঞ্চয়পত্রের প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। উল্টো সরকারের দায় বাড়ছে। বরং যাদের জন্য সরকার সঞ্চয়পত্র সুবিধা দেয় সেই শ্রেণির জন্য এটা নির্দিষ্ট করা গেলে বিক্রি কমবে, সরকারের ব্যয়ও কমবে। এক্ষেত্রে বিনিয়োগরে ক্ষেত্রে সঠিক ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে বিনিয়োগকারীর আয়-ব্যয়ের ও ব্যাংক লেনদেনের হিসাবসহ যাবতীয় তথ্য সঠিকভাবে যাচাই করা উচিত। তাতে সুদের হার না কমিয়েও সরকারের ব্যয়ের চাপ কমানো যায়।
জানা গেছে, বর্তমানে ১১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায় সঞ্চয়পত্রে। অথচ ব্যাংকিং খাতে গড় আমানতের সুদহার ৫ দশমিক ১৩ শতাংশের মতো। যা সঞ্চয়পত্রের সুদের অর্ধেকেরও কম। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরের সরকার মূল বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার কথা ছিল। সুদের হার কমার পরও বিক্রি না কমায় সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। তবু বছর শেষে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ধার বা ঋণ নিতে বাধ্য হয়, যা বছর শুরুর ঋণ লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুনের বেশি।
এদিকে সরকারের সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণগ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে না বরং আগের ঋণ ফেরত দিচ্ছে। এতে এক দিকে কম বেশি সুদের ঋণ নিয়ে সরকার কম সুদের ঋণ পরিশোধ করছে। অপরদিকে সরকার ঋণ না নেয়ায় ব্যাংকের অলস তারল্য বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, বাজেট ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকিং খাত থেকে চলতি অর্থবছরের ৪৩ হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সরকার ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ না নিয়ে বরং আগের ঋণ ফেরত দিয়েছে ২২ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে ৪ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে ১৭ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে। এক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র থেকে নেয়া প্রায় ১২ শতাংশ সুদের ঋণ নিয়ে সরকার ৪-৫ শতাংশ সুদের ব্যাংক ঋণ পরিশোধ করছে।
আবার, বর্তমানে ব্যাংকগুলোর প্রায় ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকার অলস তারল্য রয়েছে। বাজেট লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে প্রতি মাসে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা হিসেবে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৮ হাজার কোটি টাকা নিতে পারত সরকার। অথচ গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ সরকার কোনো ঋণই নেয়নি। বরং পূর্বের ঋণ ফেরতসহ প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বাড়তি তারল্যের চাপে রয়েছে ব্যাংক খাত। কিন্তু সরকার চাহিদা মাফিক ঋণ নিলে এই তারল্যের চাপ কিছুটা হলেও লাঘব হতো। তাছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিতে পারলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেও কিছু টাকা রাখতে পারতো ব্যাংকগুলো।
২০১৫-১৬ অর্থবছরেও বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ব্যাংক থেকে ৩৮ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। পুরো অর্থবছরের সরকারের নিট ব্যাংকঋণ দাঁড়ায় মাত্র ৪ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা।
এদিকে ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারের বাজেট ঘাটতির অর্থের জোগান দিয়ে কিছু আয় করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও সরকারকে ঋণ দিয়ে নিজেদের আয়ের সংস্থান এবং ব্যাংক খাতে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র থেকে বাড়তি অর্থ আসায় ঘাটতি মেটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে না। এতে অলস তারল্যের পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর আয়ও কমছে।
সূত্র জানায় ,সঞ্চয়পত্রের সর্বনিম্ন সুদের হার সরকারের ট্রেজারি বিল-বন্ডের সর্বোচ্চ সুদের হারের চেয়েও প্রায় ৩ শতাংশ বেশি। ফলে কেউ যখন সঞ্চয়পত্র কেনে, তা তখন সরকারের ঋণ হিসেবে সরকারের তহবিলে জমা হচ্ছে। ফলে সরকারের ট্রেজারিতে উদ্বৃত্ত তারল্যের সৃষ্টি হচ্ছে। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের ভাবিয়ে তুলছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা, সঞ্চয়পত্র বিক্রির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে তা ৫০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। শুধুমাত্র সঞ্চয়পত্র থেকে মাসে সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা সরকারের ঋণ হিসেবে ট্রেজারিতে জমা হচ্ছে।
তবে অত্যধিক বিক্রিতে লাগাম টানতে সঞ্চয়পত্র থেকে যাতে নির্দিষ্ট কাঙ্ক্ষিত শ্রেণিই সুবিধা পায় তার জন্য সঞ্চয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। সম্প্রতি অধিদপ্তরের এক কর্মশালায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. নজিবুর রহমান বলেন, অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণের অনেকগুলো মাধ্যম রয়েছে- এর মধ্যে সঞ্চয়পত্র অন্যতম। অসচ্ছল ব্যক্তিদের বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে সঞ্চয়পত্র চালু করা হয়। এসব ব্যক্তিরা সরাসরি সঞ্চয়পত্রের সুবিধাভোগী। তাই কোনো একক গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠান যেন একাধিক সঞ্চয়পত্র ক্রয়ের মাধ্যমে এর সুবিধা না নিতে পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিবার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৫২ শতাংশ, পেনশনার সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ৭৬ শতাংশ, বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ, তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে ১১ দশমিক ০৪ শতাংশ, ডাকঘর সঞ্চয়পত্রের ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যায়।