Originally posted in খবরের কাগজ on 13 March 2024
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতেও যে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল, তা থেকে বেশির ভাগ দেশ বেরিয়ে এলেও বাংলাদেশে এটি কমার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অর্থ পাচার এবং বাজার সিন্ডিকেট দমনে ব্যর্থতা। দেশে ডলার ও রিজার্ভসংকট থাকলেও সরকার নিজস্ব ব্যয় কমাতে পারেনি। উল্টো টাকা ছাপানোর মতো পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যস্ফীতি মহামারি এবং যুদ্ধের কারণে বছর দুয়েক আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছিল। যার মধ্যে বাংলাদেশও একটি। শুধু পাকিস্তান ছাড়া এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি কমে এলেও বাংলাদেশে কমেনি। বাংলাদেশ আর পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার বেশির ভাগ দেশই তাদের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে। সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হিসেবে এ ক্ষেত্রে তুলে ধরা যায় শ্রীলঙ্কার নাম। বছর দুয়েক আগে দেশটি দেউলিয়া হওয়ার মুখে পড়লেও সেখান থেকে উঠে এসেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের সংকটকালে দেশটির মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৪৯ শতাংশের বেশি। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে এই হার এসে দাঁড়ায় ৬.৩ শতাংশ। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৪ সাল থেকে ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে।
অর্থনীতিকে চাঙা করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে মুদ্রানীতি কঠোর করে ব্যাংকের সুদের হার বাড়িয়েছে, সরকার কৃচ্ছ্রসাধন করে বাজেট ঘাটতি কমিয়েছে, বার্ষিক ঘাটতি কমাতে ব্যয় কমিয়ে রাজস্ব আয় বাড়িয়েছে, ঋণ পুনর্গঠন করেছে। শিল্প ও কৃষি খাতে উৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। সংস্কার কর্মসূচির অংশ হিসেবে কোনো কোনো খাতে কর বাড়ানো আবার কোনো খাতে ভর্তুকি কমানোর মতো জনপ্রিয় পদক্ষেপও নিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যপণ্যের দাম কম রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২০২২ সালের অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ১১.১ শতাংশ। সেটি কমে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। দেশটির মুদ্রানীতি কঠোর করার কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে বলে জানানো হয়। নেপালের মূল্যস্ফীতির হার ২০২৪-এর জানুয়ারিতে হয়েছে ৫.৩ শতাংশ। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে এটি ৮.১৯ শতাংশ ছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভুটানের মূল্যস্ফীতি ৪.২ শতাংশ হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরেও এটি ৫.০৭ শতাংশ ছিল। পাকিস্তানের মূল্যস্ফীতি জানুয়ারিতে ছিল ২৮.৩ শতাংশ। এটি ২০২৩ সালের মে মাসে রেকর্ড ৩৮ শতাংশ ছিল। কোভিড মহামারির শেষের দিকে এবং ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী হওয়ার আশঙ্কা করেছিল এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। ২০২২ সালের এপ্রিলেই মুদ্রানীতি কঠোর করার ঘোষণা দিয়েছিল দেশ দুটি। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদের হারও বাড়িয়েছিল তারা। উৎপাদন কমে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও মূল্যস্ফীতির লাগাম টানাই ছিল এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য। সে সময় এশিয়ার চতুর্থ বৃহৎ অর্থনীতির দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায় আটা ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। এর পরই আসে এ ধরনের পদক্ষেপ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স বা ভোক্তা মূল্যসূচক, সহজে বলতে গেলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারিতে এটি কমে ৯.৬৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে এটি এখনো সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বেশি। আইএমএফের ঋণের শর্তের একটি হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো। তার অংশ হিসেবে চলতি অর্থবছরের শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
মূল্যস্ফীতি কমাতে জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মুদ্রানীতিতে কঠোরতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসেবে বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে নীতি-সুদ হার বাড়িয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে আরও বেশি সুদ দিতে হবে সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে। এ ছাড়া ডলারের দাম নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি ব্যবহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এতে করে ডলারের দাম অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখে ওঠানামা করবে। একই সঙ্গে খেলাপি ঋণ আদায়ে বেসরকারি উদ্যোগে ‘সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানি’ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে সুদের হারের নির্ধারিত মাত্রার বিষয়টি তুলে নেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে সুদের হার ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ শতাংশ করা হয়েছে।
নিত্যব্যবহার্য অনেক পণ্য আমদানিনির্ভর হওয়ার কারণে কিছু পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে এত সব ব্যবস্থা নেওয়ার পরও মূল্যস্ফীতি খুব একটা কমতে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি না কমার পেছনে দুই ধরনের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যার মধ্যে কিছু বাজারভিত্তিক। আর কিছু রয়েছে বাজারবহির্ভূত। ডলারসংকটের কারণে এর বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখা যাচ্ছে না। যে পরিমাণ ডলার আয় হচ্ছে তার চেয়ে বেশি দেশ থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
বরং অসাধু উপায়ে ডলার পাচারের কারণে এমনটা হচ্ছে। আর এটা অব্যাহত থাকলে মূল্যস্ফীতি কমানো যাবে না। উৎপাদক ও ভোক্তার দামের মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। এর কারণ হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয়ভাবে কয়েক হাতবদল এবং নানা ধরনের চাঁদাবাজি। অতিরিক্ত ব্যয় যুক্ত হওয়ার কারণে চূড়ান্ত দাম বেড়ে যাচ্ছে। অল্প কিছু প্রতিষ্ঠানের হাতে পণ্য সরবরাহের সুযোগ কুক্ষিগত থাকায় তারাই পণ্যের দাম নির্ধারণ করছে। ফলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও তা কাজ করছে না। সিন্ডিকেটগুলো আমাদের সরকারের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়ায় তা দমন করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। এ ধরনের সিন্ডিকেটের কারণে বাজার ও দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। উল্টোভাবে দেখতে গেলে শ্রীলঙ্কা খারাপ অবস্থানে থাকার পরও সেখানে এ ধরনের অনুঘটক না থাকায় অবস্থার উন্নতি হয়েছে। যারা অর্থ পাচার করছে, যারা সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা না গেলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না।
বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে যাদের রিজার্ভ কম, তাদের জ্বালানি আমদানিতে উচ্চমূল্য দিতে হয়। তাই ডলারের ঘাটতি হয় এবং এর জন্য আমদানি ব্যয় বাড়ে। আমদানিজনিত মূল্যস্ফীতি বাংলাদেশে রয়েছে। এটা পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাতেও রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, এসব দেশ কতটা কৃচ্ছ্রসাধন করতে পারে।
দুর্ভাগ্যবশত আমাদের এখানে ওই ধরনের কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার মতো রাজনৈতিক পরিস্থিতি আগেও ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। সব সময়ই এখানে একটা লুপহোল ছিল। যার কারণে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে যে আমরা আমদানি ব্যয় কমিয়ে আনব এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হারকে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ধরে রাখব, সেটা করতে সক্ষম হইনি। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের আমদানি কমিয়ে আনতে আরও কঠোর হওয়ার দরকার থাকলেও সেটি নেওয়া হয়নি।
সরকারি ব্যয়ের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতি রয়েছে। সরকারি ব্যয় যেভাবে কঠোর হাতে কমানোর দরকার ছিল, সেটিও হয়নি। উল্টো নতুন নোট ছাপিয়ে সরকারকে দেওয়া হয়েছে। বেসরকারি উৎস থেকে ঋণ করা হয়েছে। এর ফলে বাজারে নগদ অর্থের আধিক্য থাকায় মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। আমদানি এবং সরকারি ব্যয় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কঠোরতা দেখিয়ে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতি কমাতে সক্ষম হলেও এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ফলে শ্রীলঙ্কার মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশের কমেনি। এই একই কারণে আইএমএফের ঋণেরও সর্বোচ্চ সুবিধাজনক ব্যবহার করতে পেরেছে শ্রীলঙ্কা। বাজারে পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে গুটিকতক কোম্পানির আধিক্য থাকায় প্রতিযোগিতার পরিবেশ নেই বলে পণ্যের দাম যথেচ্ছভাবে বেড়েছে। সরকার কিছু পণ্যে আমদানি শুল্ক কমালেও সেটি আসলে শেষমেশ গিয়ে কোনো সুফল বয়ে আনে না। কারণ আমদানি করেন গুটিকয়েক ব্যবসায়ী।
ডিউটি কমানোর সুবিধাটা আমদানিকারকরা নিয়েছেন, ভোক্তারা সেটার সুবিধা পাননি। ওদিকে আবার সরকার তার রাজস্ব হারিয়েছে। একই সঙ্গে দেশ থেকে ডলার পাচার হওয়া, ডলারের সরবরাহের সংকট ইত্যাদিও বাজারবহির্ভূত কারণ হিসেবে কাজ করেছে। ভর্তুকির ক্ষেত্রে সরকার রপ্তানি, জ্বালানি ও কৃষিক্ষেত্রে বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি দিয়ে থাকে। কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকির প্রয়োজন থাকলেও রপ্তানি ও জ্বালানির ক্ষেত্রে ভর্তুকি ব্যাপকভাবে কমিয়ে আনার সময় হয়েছে। বিশেষ করে জ্বালানি ক্ষেত্রে ভর্তুকি কমাতে হবে। তবে তার বদলে ভোক্তার ওপর মূল্য বাড়ানো যাবে না। বরং ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয়, তা পুনর্মূল্যায়ণের মাধ্যমে এটি কমিয়ে আনতে হবে। এতে সরকারের ব্যয় অনেকাংশে কমানো সম্ভব। একই সঙ্গে সরকারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রক্ষেপণ কমিয়ে আনতে হবে। যাতে করে খরচ কমিয়ে অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় আনা যায়, সেদিকটা বিবেচনায় রাখতে হবে।
লেখক: গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)