Originally posted in বণিকবার্তা on 17 June 2023
গত ১৫ বছরে দেশের বাজেট প্রক্রিয়ার অবনমন হয়েছে। অর্থনীতির আকারের তুলনায় কমেছে রাজস্ব সংগ্রহ। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে রাজস্ব সংগ্রহের হার ছিল ৯৩ শতাংশ, সেখানে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সেই হার নেমে দাঁড়িয়েছে ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং ২০১৮ সালের পর এ অবস্থার আরো অবনমন হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহের হার ছিল ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০ সালের পর এ অবস্থার কিছুটা অগ্রগতি হলেও অর্থনীতির আকারের তুলনায় আশাব্যঞ্জক নয়।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের ‘বাংলাদেশের জাতীয় বাজেট: কল্পকথন ও বাস্তবতা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে এ তথ্য উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, বাজেট প্রস্তুতের জন্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা দরকার।
ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপের ওপেন বাজেট সার্ভে (ওবিএস) ২০২১-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাজেট প্রক্রিয়ার মূল্যায়নে ২০০৬ সালে ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৩৮তম। ২০২১ সালে সেই অবস্থার অবনমন হয়ে ১২০টি দেশের মধ্যে অবস্থান দাঁড়িয়েছে ৯৫তম।
এছাড়া বাজেট কখন দেয়া হয়, সময় মতো দেয়া হয় কিনা, দলিল প্রকাশ করা হয় কিনা, মানুষের অংশগ্রহণ আছে কিনা, বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকার কতটা দক্ষ; এসবের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয় স্কোর।
ওবিএস সার্ভের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের বাজেট প্রক্রিয়া বাংলাদেশের তুলনায় বেশি স্বচ্ছ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থনীতির আকার অনুপাতে যে অর্থনীতি যত বড় হবে বাজেট তত বড় হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতি যত বড় হয়েছে বাজেট তত বড় হয়নি।
সিপিডির তথ্য মতে, বিশ্বে জিডিপির তুলনায় সরকারি ব্যয় মূল্যায়নে ১৪৩টি দেশের মধ্যে ১৩৭তম অবস্থানে বাংলাদেশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ যথেষ্ট পরিমাণ সরকারি ব্যয় করে না। মধ্যম অবস্থানে (মিডিয়ান ভ্যালু) থাকা দেশগুলোও ৩২ শতাংশ ব্যয় করে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকারি ব্যয় জিডিপির অনুপাতে ধরা হয়েছিল ১৫ দশমিক ২০ শতাংশ, কিন্তু প্রকৃত ব্যয় হয়েছে ১৩ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরেও এ ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ২২ শতাংশ। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারি ব্যয় ৪০ শতাংশ বাড়ানো না গেলে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন হবে না।
বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মোট রাজস্ব, সরকারি বিনিয়োগ ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বিবেচনায় নিলে দেখা যায়, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির গড় ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৮০ শতাংশের বেশি বাস্তবায়ন হয়নি। একমাত্র ২০০৯ সালে ৯০ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে। আরেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য হলো, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত রাজস্ব আহরণের যে গতি ছিল, ২০১৪ সালের পর সেই গতি নেই। ২০১৮ সালের পরও রাজস্ব সংগ্রহ কমে গেছে। তবে গত দুই বছরে বিগত সাত বছরের তুলনায় কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে।
বিগত বছরের রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ও রাজস্ব সংগ্রহের চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত বাজেটে রাজস্ব সংগ্রহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তার ৯০ শতাংশ থেকে শতভাগ রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে রাজস্ব আহরণ কমে গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার ৮৩ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭৯ দশমিক ৮, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৮৩, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮২ দশমিক ৯, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৫ দশমিক ২, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭৪ দশমিক ২ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে সবচেয়ে কম ৭০ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে কিছুটা অগ্রগতি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৮৬ দশমিক ৯ শতাংশ, আবার ২০২১-২২ অর্থবছরে কিছুটা কমে ৮৬ শতাংশে এসেছে।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বাজেট প্রস্তুতের জন্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততা দরকার। সংসদ সদস্য, স্থায়ী কমিটির সদস্য, স্থানীয় সরকারে যুক্ত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গেও আলাপ-আলোচনা করা দরকার। বাজেট এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় না। ফলে এটাকে নিজস্ব বলে মনে করবে—সেই চেতনা বাস্তবায়নকারীদের মাঝে আসে না। সেজন্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সামগ্রিক আগ্রহ থাকে না। বাজেট প্রস্তুত ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা দরকার। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা সৃষ্টি হয়নি। যার ফলে নাগরিকদের পক্ষ থেকে এটি দেখভাল করা যাদের দায়িত্ব তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না। সেজন্য এটি ক্রমান্বয়ে আমলাতান্ত্রিক একটি অবস্থায় গেছে। বাস্তবতা থেকে দূরে সরে গেছে। বাস্তবায়নের জন্য যে আকাঙ্ক্ষা সেটি জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে নেই।’
বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের হার কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘সংশোধিত বাজেট সঠিকভাবে সংশোধন করা হয় না। দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে যে সংস্কার কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতির ওপর ব্যয় নির্ভরশীল। ফলে রাজস্ব আদায় যখন যথাযথ না হয় তখন ব্যয়ের ক্ষেত্রেও সরকার নিয়ন্ত্রণ রাখার চেষ্টা করে, যেন বাজেট ঘাটতি অনেক বেশি না হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এমএম আকাশ বলেন, ‘বাজেট পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন উভয় ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত যত প্ল্যানিং ও বাস্তবায়নকারী এজেন্সি আছে, সবার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। সুবিধাভোগীকে আগে থেকে জানিয়ে দিতে হবে যে এ প্রকল্প থেকে সে কী সুবিধা পাবে এবং সচেতনভাবে যেন এটি মনিটরিংও করে। জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জবাবদিহিতা না থাকলে তার প্রভাব বাজেটের ওপরও পড়ে।’