Originally posted in যুগান্তর on 22 May 2021
দেশে করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। অর্থনীতিতে এর বহুমুখী নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মনে হচ্ছে, এই অতিমারি শিগ্গিরই দেশ থেকে যাচ্ছে না। এ কারণে পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি পূর্ণাঙ্গ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা জরুরি। আর এ পরিকল্পনার সঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) পথরেখাকে সমন্বয় করতে হবে। কিন্তু দেশের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এই পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করার ক্ষেত্রে অনীহা রয়েছে। তাই এবারের বাজেটে এ অস্বীকারের মনোভঙ্গির পরিবর্তন প্রত্যাশা করা হচ্ছে। যুগান্তরের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এসব কথা বলেন। তার মতে, করোনাজনিত মন্দা কাটাতে সরকারকে তার ব্যয় বাড়াতে হবে এবং অর্থনীতিতে তারল্য সৃষ্টি করতে হবে। ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও নিট রপ্তানি বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দরিদ্র মানুষের কাছে অধিকতর প্রত্যক্ষ আর্থিক সাহায্য পৌঁছাতে হবে। আয়ের ক্ষেত্রে নতুন কর আরোপ না করে বরং করের আওতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে আরও করদাতাবান্ধব করতে হবে। একটি সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সূচনা করতে হবে।
এ ছাড়া বাজেট ঘাটতির অর্থায়নসহ সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্ব অর্থনীতির প্রবণতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান এ অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মনির হোসেন
যুগান্তর: করোনার মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে। এবারের বাজেটে কী কী চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: দেশের ভেতরে অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। অতিমারির অভিঘাত মোকাবিলার জন্য গত বাজেটেও একটি মধ্যমেয়াদি পুনরুদ্ধার পরিকল্পনার অভাব ছিল। এবারও গতানুগতিক মনোভাব অব্যাহত থাকবে সে রকম একটি আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এবার প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো অতিমারি-উত্তর আর্থসামাজিক পুনরুদ্ধারের জন্য একটি তিন বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ। এর সঙ্গে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা এবং এসডিজি বাস্তবায়নের যে পথরেখা রয়েছে, তার সঙ্গে প্রস্তাবিত এ কাঠামোর সমন্বয় করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হলো- অতিমারির কারণে দেশের অর্থনীতির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। দেশে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এক ধরনের মন্দা চলছে। এর ফলে মানুষের কর্মসংস্থান কমেছে। যারা বেকার হননি তাদেরও আয় কমেছে। কেউ কেউ নতুন যে কাজে যোগ দিয়েছে, সেখানে উৎপাদনশীলতা ও আয় কম। আয় কমে যাওয়ায় পরিবার পর্যায়ে ভোগ কমে গেছে এবং পুষ্টিহীনতা বাড়ছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব পড়েছে। সেক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো, পরিবার পর্যায়ে ভোগ বাড়াতে হবে। এতে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বৃদ্ধি কিছুটা ঠোকানো যাবে। তাই দরিদ্র ও নিুআয়ের মানুষের কাছে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি আর্থিক সহায়তা পৌঁছানো হচ্ছে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। তৃতীয়ত, কর্মসংস্থানের কথা জোরদারভাবে চিন্তা করতে হবে। আমাদের জন্য বৈদেশিক বাজার গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশীয় বাজার। দেশীয় বাজারের চাহিদা বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগ একই সূত্রে গাঁথা। আন্তর্জাতিক বাজারের অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে দেশীয় বাজারকে কেন্দ্র করে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য বাজেটে উদ্ভাবনী পদক্ষেপ থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, নতুন ধরনের শিল্পপণ্য উৎপাদন, উচ্চমানের সেবাপণ্য সৃষ্টি এবং রপ্তানি পণ্যের নিট মূল্য বাড়াতে হবে। খাতশীলতা বাড়াতে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে বড় শহরের বাইরে বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি, উচ্চমানের সেবা খাত এবং রপ্তানি পণ্যের নিট মূল্য বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।
যুগান্তর: ব্যয়ের দিক থেকে কোন খাতে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
ড. দেবপ্রিয়: দেশের এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন্দা পরিস্থিতিতে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক ব্যবস্থায় যেতে হবে। তার মানে হলো, সরকারকে কোভিড সম্পৃক্ত রাজস্ব ব্যয় এবং বিশেষ কিছু উন্নয়ন ব্যয় বাড়াতে হবে। তবে ব্যয় বাড়ানোর জন্য আগে আয় করা দরকার। আর আয়ের ক্ষেত্রে সরকার খুবই দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে রাজস্ব আয় গত কয়েক বছরে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উল্টো সেটি কমে গেছে। আবার পরিকল্পনা অনুসারে ব্যয়ও হচ্ছে না। ফলে ব্যয় বৃদ্ধি সরকারের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে ভোগ, বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও নিট রপ্তানি বাড়ানোর জন্যও সরকারি ব্যয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ভেতরে কোনো কাঠামোগত সংস্কার না হওয়ায় সরকার ব্যয় বৃদ্ধির চেষ্টা করেও পারছে না। আর যে ব্যয় হচ্ছে, তার গুণগত মান নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ১০ টাকার পণ্য ১০ হাজার টাকায় কিনে প্রকল্পের মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। উপরন্তু, অভীষ্ট উপকারভোগীদের কাছে এ ব্যয়ের সুবিধা পৌঁছানো যাচ্ছে না।
আর ব্যয় বাড়ানোর কথা বললে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত চলে আসে সবার আগে। বছরে স্বাস্থ্য খাতে জিডিপির মাত্র ১ শতাংশ ব্যয় করা হয়। একটি নিুমধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে এটি অত্যন্ত লজ্জাস্কর। বাজেটে চেষ্টা থাকতে হবে প্রতিবছর অন্তত জিডিপির শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করে বাড়িয়ে এ অনুপাত জিডিপির ৫ থেকে ৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া। একইভাবে শিক্ষা খাতে বর্তমানে জিডিপির মাত্র ২ শতাংশ ব্যয় হয়। এটাও প্রতিবছর জিডিপির শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করে বাড়াতে হবে।
অন্যদিকে সব নাগরিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বলে কোনো কিছু নেই। এ সম্পর্কিত যতটুকু ব্যয় হয়, তা সরকারি কর্মচারীদের পেনশন ভাতার জন্য এবং দুস্থ মানুষের আর্থিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য। কোভিডকালে আমরা দেখলাম নিুবিত্ত, মধ্যবিত্তরাও কতখানি অসহায়। শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ও আরও বেশি বেকার। এ ছাড়া অতিমারির কারণে নিুআয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে চর, হাওর, উপকূল ও নদী ভাঙনের এলাকায় বসবাসকারী মানুষ, শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধীরা এবং তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। এ বাজেটের মাধ্যমে এদের সবাইকে একটি সর্বজনীন ও সামগ্রিক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থার অধীনে আনা উচিত। এসব কারণে আগামী বছর সরকারি ব্যয় করার সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়টি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যুগান্তর: কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন?
ড. দেবপ্রিয়: বর্তমানে দেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে যুব কর্মসংস্থান। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের গড় যুব বেকারত্বের হারের চেয়ে শিক্ষিত যুব বেকারত্বের হার বেশি। প্রতি তিনজনে একজন ২৫ বছরের নিচে শিক্ষিত মানুষ বেকার। সরকার এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন গতানুগতিক পরিকল্পনা নিলেও তা বিশেষ কোনো উপকারে আসছে না। সরকারের পক্ষ থেকে যুব কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে আর্থিক সমর্থন ও কর সুবিধা দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাজার সম্পৃক্ত ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে। বেকার যুবকদের জন্য ভাতা চালু করার বিষয়টিও বাজেটে থাকতে পারত।
যুগান্তর: করোনার কারণে সরকারের আয় কমছে। এ অবস্থায় আয় বাড়ানোর উপায় কী?
ড. দেবপ্রিয়: আমি মনে করি, নতুন অর্থবছরে সরকারের নতুন কর আরোপ এবং করের হার বাড়ানো উচিত হবে না। মূলত সরকারের আদায় কাঠামোর দক্ষতা বাড়িয়ে বাড়তি কর আহরণ করা উচিত। বিশেষ করে যারা করযোগ্য আয় করেন কিন্তু কর দেন না তাদের, অর্থাৎ যাদের বছরে মোট আয় তিন লাখ টাকার বেশি তাদের করের আওতায় আনতে হবে। এ ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করাসহ যেসব নৈতিকতাবিবর্জিত ও অর্থনৈতিক যুক্তিহীন সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তা অবশ্যই বন্ধ করা উচিত। এ ছাড়া যারা টাকা পাচার করেছে, তাদের চিহ্নিত করে কীভাবে করের আওতায় আনা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। অর্থাৎ করের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা ও জবাবদিহিতা আরও জোরদার করতে হবে।
যুগান্তর: করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায়?
ড. দেবপ্রিয়: আগেই বলেছি, করোনা মোকাবিলার জন্য একটি সমন্বিত তিন বছরের নীতি কাঠামো ও বরাদ্দের প্রাধিকার ঠিক করা উচিত। এর ভেতরে থাকতে হবে- যে শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে, যেসব পরিবারে পুষ্টিহীনতা দেখা দিয়েছে, যে নতুন শিশুরা এখনো টিকা পায়নি- ইত্যাদি বিষয়কে মোকাবিলা করার জন্য উদ্যোগ ও বরাদ্দ। প্রথাগত নিরাপত্তা ভাতা কর্মসূচির বাইরে পুরোনো ও নতুনভাবে অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য প্রত্যক্ষ সরকারি সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় জাতীয় অর্থায়নের অংশ হিসাবে একটি সংহতি তহবিল করার কথা বলেছিলাম। এ তহবিলে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি নাগরিকদেরও অর্থ দান করার সুযোগ থাকতে পারে এবং তা স্বচ্ছভাবে যৌথ ব্যবস্থায় পরিচালিত হতে পারে। অনেক দেশেই এ রকম উদ্যোগ সফলভাবে কার্যকর হয়েছে।
যুগান্তর: বাজেট ঘাটতির অর্থায়নে কোন বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
ড. দেবপ্রিয়: দেশে বাজেট ঘাটতি বর্তমানে জিডিপির ৬ শতাংশের কাছাকাছি। এটি বেড়ে ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ বেড়ে গেলেও তা নিয়ন্ত্রণসাধ্য। ফলে আমার মতে, ঘাটতি নিয়ে অত বেশি চিন্তা না করে ব্যয় বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়া উচিত। তবে চিন্তার বিষয় হলো, ঘাটতির অর্থায়নে সহজ শর্তে বৈদেশিক সহায়তা ব্যবহার না করে উচ্চ সুদে প্রভূত পরিমাণে ব্যাংক ঋণ নেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া উচ্চমূল্যের জাতীয় সঞ্চয়পত্র বিপুল পরিমাণে বিক্রি অব্যাহত আছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে সরকারের বর্তমানে সন্তোষজনক দায়দেনা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যুগান্তর: বিশ্ব অর্থনীতির মন্দা অবস্থা চলছে। বাংলাদেশে এর কী প্রভাব পড়তে পারে?
ড. দেবপ্রিয়: বর্তমানে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল ও অনিশ্চিত অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিদেশের সঙ্গে আমাদের চারটি খাতে গভীর সম্পর্ক রয়েছে- বৈদেশিক সাহায্য, বৈদেশিক বাণিজ্য, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ ও প্রবাসী রেমিট্যান্স আয়। এ চার খাতেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করা কঠিন। যেমন বর্তমানে আমাদের প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ভালো অবস্থায়। কিন্তু এটি যে অব্যাহত থাকবে, তা নিশ্চিত নয়। কারণ প্রচুর মানুষ ফিরে আসছে, নতুন কর্মসংস্থানও কম হচ্ছে। রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে পোশাক খাত কিছুটা বাজার পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু এর প্রবৃদ্ধি যে অব্যাহত থাকবে, তা বলা যাচ্ছে না। আগামী দিনে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া কষ্টকর হবে, বিশেষ করে অনুদান কিংবা রেয়াতি ইস্যুতে ঋণ পাওয়া কঠিন হবে। কারণ ইতোমধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। বড় আশার জায়গা ছিল প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ। কিন্তু সেটিও একেবারে সামান্য আসছে, করোনার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এটি আরও কমে গেছে। এসবের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদাকে গুরুত্ব দিয়ে দেশীয় শিল্প-কলকারখানা ও আধুনিক সেবা খাত গড়ে তুলতে হবে।
যুগান্তর: এলডিসি থেকে উত্তরণের পর অর্থনীতিতে যে প্রভাব পড়বে, তা মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
ড. দেবপ্রিয়: এলসিডি থেকে উত্তরণের পর আমরা দ্রুতই শুল্ক ও কোটামুক্ত বৈদেশিক বাজার সুবিধা হারাব। সেক্ষেত্রে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য বহুমুখী শিল্প-কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি, ছোট ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিককে নিয়মনীতির ভেতরে এনে সুরক্ষা দেওয়া জরুরি। এখনো আমরা রপ্তানি নিয়ে যতটা চিন্তিত, দেশীয় চাহিদা বিবেচনা করে অভ্যন্তরীণ শিল্পকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে ততখানি কার্যকর মনোযোগ দিচ্ছি না। প্রত্যাশা করি আগামী বাজেটে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী নতুন নতুন শিল্পের জন্য কর, শুল্ক ও ভর্তুকি সুবিধা থাকবে। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো যেমন- প্রকল্প মূল্যায়ন পদ্ধতি, ব্যাংক ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুঁজিবাজার, পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিকে আরও সক্ষম ও দক্ষ করতে হবে। বাজেটে এসব প্রসঙ্গের উল্লেখ থাকবে আশা করি। এ ছাড়া দেশে সঠিক ও হালনাগাদ তথ্য ও পরিসংখ্যানের বড় অভাব। এ পরিস্থিতি বিমোচনে বাজেটে কী বলা হয় তা দেখা যাক।
যুগান্তর: দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ড. দেবপ্রিয়: সার্বিকভাবে বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের ভারসাম্য বিরাজ করছে। কারণ মূল্যস্ফীতি এবং টাকার মূল্যমান স্থিতিশীল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভালো অবস্থায়। রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো থাকায় বৈদেশিক চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে। আমদানি কমে যাওয়ায় ব্যালেন্স অফ পেমেন্ট ইতিবাচক আছে। কিন্তু এসব সূচক ইতিবাচক থাকার একটা বড় কারণ হলো, দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে আছে। বিনিয়োগ না হওয়ায় এটি একটি নিচু পর্যায়ের স্থিতিশীলতা নির্দেশ করে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সঙ্গে যে ধরনের গতিশীল স্থিতিশীলতা দরকার, তার সঙ্গে এটি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অর্থাৎ সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা সমস্যা নয়। দেখার বিষয় হলো এই স্থিতিশীলতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কোভিডকে যথোপযুক্তভাবে মোকাবিলা এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারছি কিনা। দেখতে হবে এর মাধ্যমে আগামী অর্থবছরের বাজেট আমাদের একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিনা।
যুগান্তর: আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. দেবপ্রিয়: ধন্যবাদ।