বাড়তি মাশুল ভোক্তা ও রপ্তানিকারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে: মোস্তাফিজুর রহমান

Originally posted in প্রথম আলো on 27 July 2025

চট্টগ্রাম বন্দরে মাশুল বাড়ানোর চাপে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীরা

আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা। একই দিন থেকে কার্যকর হচ্ছে বেসরকারি ডিপোতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুল। নতুন করে চট্টগ্রাম বন্দরের সব ধরনের মাশুলের হার বাড়ানোর খবর ব্যবসায়ীদের দুশ্চিন্তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

একসঙ্গে মাশুল বাড়ানোর দুই প্রভাবের কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। যেমন পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে দিন শেষে বাড়তি মাশুল ভোক্তার পকেট থেকেই যাবে। তাতে পণ্যের দাম বেড়ে মূল্যস্ফীতিও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়বে, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় রপ্তানিকারকেরা পিছিয়ে যেতে পারে।

তৈরি পোশাকশিল্পের সংগঠন বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি ও কেডিএস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে অস্বস্তিতে আছি আমরা। এই সময়ে কনটেইনার ডিপোর মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা এল। এখন ব্যবহারকারীদের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা ছাড়াই বন্দরের মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ কোনো যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। রপ্তানিতে প্রতিটি সেন্ট (১০০ সেন্টে এক ডলার) নিয়ে দর-কষাকষি করতে হয়। ফলে এই বাড়তি মাশুল রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা পিছিয়ে দেবে।’

ভোক্তা-রপ্তানিকারকের বাড়তি ব্যয় কত

চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল আদায়ের প্রধান দুটি খাত হলো জাহাজ ও পণ্য পরিবহনের সেবাবাবদ। বন্দরের নিরীক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, বিদ্যমান মাশুলের হার অনুযায়ী ২৩-২৪ অর্থবছরের এই দুই খাতে মাশুল আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৯১২ কোটি টাকা।

বন্দর কর্মকর্তারা জানান, গেজেট প্রকাশের পর বন্দরের নতুন মাশুল কার্যকর হবে। নতুন করে বর্ধিত হারে মাশুল কার্যকর হলে এ ক্ষেত্রে আয় বা আদায় কম-বেশি ৪০ শতাংশ বাড়বে। এ হিসেবে মাশুল হিসাবে বন্দরের দেড় হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে।

বন্দর ডলারের হিসাবে মাশুল আদায় করে। ফলে ডলারের দর বাড়লে বন্দরের বাড়তি আয় আরও বাড়তে পারে।

এর আগে ১৫ জুলাই বেসরকারি কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন এক সার্কুলারে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুলের হার বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। সার্কুলারে সেবাভেদে ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দেয় সংগঠনটি, যা ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হওয়ার কথা রয়েছে। বেসরকারি ডিপোর হিসাবে, ডিপোতে কনটেইনার ব্যবস্থাপনার মাশুল বাড়লে বছরে ৩০০ কোটি টাকার কাছাকাছি খরচ বাড়তে পারে ব্যবহারকারীদের।

অর্থাৎ সরকারি ও বেসরকারি দুই খাতে সব মিলিয়ে ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার কম-বেশি বাড়তি ব্যয় হবে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে এই বাড়তি ব্যয় করতে হবে ব্যবসায়ীদের। সারা দেশের সমুদ্রপথে কনটেইনার পরিবহনের ৯৯ শতাংশই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আনা-নেওয়া হয়। অর্থাৎ কনটেইনারে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে মূল প্রভাব পড়বে।

কনটেইনার ও কনটেইনার জাহাজমালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ কনটেইনার শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ও জাপানভিত্তিক কনটেইনার শিপিং লাইন ওশান নেটওয়ার্ক এক্সপ্রেসের (ওয়ান) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফাইয়াজ খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, বন্দরে কনটেইনার ও কনটেইনার জাহাজের মাশুলের বড় অংশ শুরুতেই পরিশোধ করে কনটেইনার ও জাহাজ পরিচালনাকারী কোম্পানিগুলো। তারা আবার এই বাড়তি মাশুল আদায় করবে আমদানি-রপ্তানিকারকের কাছ থেকে। এর মানে হলো, এই বাড়তি ব্যয় টানতে হবে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকদের।

তড়িঘড়ি করে মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ

বেসরকারি কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশন ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা না করেই আগামী ১ আগস্ট থেকে মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছিল। বেসরকারি সংগঠনটি যখন ঘোষণা দেয়, সে সময় সরকারি পর্যায়েও বন্দরের মাশুল বাড়ানোর প্রক্রিয়াও চলছিল।

সর্বশেষ গত ২ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ব্যবহারকারীদের সঙ্গে বসে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে। আলোচনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ৩০ জুনের মধ্যে মাশুল কত বাড়ানো যৌক্তিক, তার প্রস্তাব জমা দেবে ব্যবহারকারীরা। এই প্রস্তাবনার ওপর দ্বিতীয় দফায় আলোচনার পর মাশুলের হার কত বাড়ানো হবে, তা চূড়ান্ত করার কথা ছিল।

শিপিং অ্যাসোসিয়েশনসহ ব্যবহারকারী সংগঠনগুলো সর্বোচ্চ ১০ থেকে ২০ শতাংশ মাশুল বাড়ানোর যৌক্তিকতা দিয়ে প্রস্তাবনা জমা দেয়। তবে এই প্রস্তাবের ওপর আলোচনা হয়নি। শিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

আলোচনার মাঝপথে গত বৃহস্পতিবার অর্থ মন্ত্রণালয় বর্ধিত মাশুলের প্রস্তাবনায় অনুমোদন দিয়েছে। আলোচনার মাঝপথে একসঙ্গে গড়ে ৪০ শতাংশের বেশি মাশুল বাড়ানোর খবরে হতবাক হয়ে যান ব্যবহারকারীরা।

অথচ গত শুক্রবার বন্দর পরিদর্শনে এসে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মন্ত্রণালয় এককভাবে এই মাশুল বাড়ায়নি। আন্তমন্ত্রণালয় আলোচনা হয়েছে, ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ১৯৮৬ সালের পর মাশুল বাড়ানো হয়েছে, যা এখনো বিশ্বের অনেক বন্দরের চেয়ে কম।হঠাৎ মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়ে ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ রয়েছে। বন্দর লাভজনক প্রতিষ্ঠান। আবার কেউ মনে করছেন, বিদেশি বন্দর অপারেটরদের সুবিধা দিতে মাশুল বাড়ানো হয়েছে।

জানতে চাইলে সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক সরাসরিই প্রথম আলোকে বলেন, ডিপি ওয়ার্ল্ডকে নিউমুরিং টার্মিনাল দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বিদেশি অপারেটরকে সুবিধা দিতেই হঠাৎ করে এই মাশুল বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘মাশুল না বাড়িয়ে গত ১৫ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর খাতে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলো উদ্ধার করুন। মাশুল বাড়ানোর দরকার হবে না। বন্দর এমনিতেই লাভজনক প্রতিষ্ঠান।’

প্রতি ধাপেই বাড়তি মাশুল

সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর একসঙ্গে এই মাশুল বাড়ানোর ঘোষণা আমদানি-রপ্তানি পণ্য আনা-নেওয়ার প্রতিটি ধাপে পড়ছে। যেমন একজন রপ্তানিকারক কারখানা থেকে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোতে পণ্য নেওয়ার পর প্রথমে ডিপোগুলো বাড়তি মাশুল আদায় শুরু করবে। আগামী ১ আগস্ট থেকে মাশুল বাড়ানোর হার কার্যকর করার কথা তারা ১৫ জুলাই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

এরপর ডিপো থেকে রপ্তানি পণ্যবাহী কনটেইনার বন্দরে নেওয়ার পর বাড়তি মাশুল আদায় শুরু করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের এই বাড়তি মাশুল আদায় শুরু হবে গেজেট প্রকাশের পর।

দুই দফায় বাড়তি মাশুল দেওয়ার পর এই রপ্তানি পণ্যের গন্তব্য যদি হয় যুক্তরাষ্ট্র, তাহলে একই পণ্যের ওপর পড়বে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক, যা আদায় হবে আগামী ১ আগস্ট থেকে।

আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেও দিতে হবে বাড়তি মাশুল। যেমন আমদানি পণ্যবাহী জাহাজ বন্দরে আসার পর প্রথমে জাহাজ খাতের বাড়তি মাশুল দিতে হবে। এরপর কনটেইনার বা পণ্য খালাস, সংরক্ষণ, ওঠানো-নামানোর প্রতিটি ধাপেই গুনতে হবে বাড়তি মাশুল।

আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের এই বাড়তি মাশুলের বড় অংশই শুরুতে পরিশোধ করেন শিপিং এজেন্টরা। তাঁরা আবার আমদানিকারক-রপ্তানিকারক থেকে আদায় করে নেন। আবার দিন শেষে আমদানিকারকেরা পণ্যের মূল্যের সঙ্গে যুক্ত করে ভোক্তার কাছ থেকেই আদায় করেন।

ভোক্তার চাপ বাড়বে, রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমবে

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, সেবা প্রদানের খরচ বাড়ায় সরকারি-বেসরকারি খাতে মাশুল বাড়াতে হলে তা ব্যবহারকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিকতা ঠিক করে বাড়ানো উচিত ছিল।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এমনিতেই আগামী ১ আগস্ট থেকে ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক নিয়ে রপ্তানিতে অনিশ্চয়তা রয়েছে। এ সময় মাশুল বাড়ানোর পদক্ষেপ পুনর্বিবেচনা করা উচিত। কারণ, বাড়তি মাশুল রপ্তানিতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমাতে পারে। আবার আমদানিতে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা পড়বে ভোক্তাদের ওপর।