Originally posted in বাংলাদেশ প্রতিদিন on 4 January 2024
বিদেশি ঋণ চাপ বাড়াচ্ছে রিজার্ভে
দেশি প্রকল্পে বিদেশি ঋণের দায় এখন ‘হাতির খোরাক’-এর মতো বোঝা হয়ে চেপে বসেছে সরকারের ঘাড়ে। রপ্তানি, রেমিট্যান্স বিদেশি ঋণ অনুদানসহ নানা মাধ্যমে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা জমা হচ্ছে- পরিশোধ করতে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে তরতর করে কমে যাচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ডলার কিনেও সেই মজুদ সামাল দিতে পারছে না। সরকারি তথ্য অনুযায়ী চলতি অর্থ বছর বিদেশি ঋণের কিস্তি হিসেবে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিশোধ করতে হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)-এর হালনাগাদ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিদেশি ঋণের সুদাসল বাবদ গত জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসেই পরিশোধ করতে হয়েছে ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এটি আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪৫ কোটি ডলার বেশি। আর্থিক খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ঋণ শোধ করতে শুধু যে কিস্তি পরিশোধের চাপ বেড়েছে তাই নয়, কোনো কারণে ব্যর্থ হলে তার ওপর উচ্চ সুদ আরোপের হুমকিও আছে।
বিদেশি ঋণে গৃহীত বড় প্রকল্পের কিস্তি পরিশোধের চাপ অর্থনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিশেষ করে রাশিয়া, চীন ও জাপানের অর্থায়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় এখন একে একে কিস্তি পরিশোধের সময় চলে এসেছে। ‘বাংলাদেশের বৃহৎ বিশটি মেগা প্রকল্প : প্রবণতা ও পরিস্থিতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখা গেছে, চলমান ২০ মেগা প্রকল্পের সর্বমোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ৪৩ বিলিয়ন ডলার নেওয়া হয়েছে বিদেশি ঋণ হিসাবে। এসব প্রকল্পে ঋণ পরিশোধের সবচেয়ে বড় অংশ ৩৬ দশমিক ৬ শতাংশ দিতে হবে রাশিয়াকে, জাপানকে দিতে হবে ৩৫ শতাংশ এবং চীনকে প্রায় ২১ শতাংশ অর্থ পরিশোধ করতে হবে। পরিমাণের হিসাবে চীন তৃতীয় হলেও দায়দেনা পরিশোধের সময়সূচি অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে চীনকে। দেশি প্রকল্পে বিদেশি ঋণের দায় নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিলেন নাগরিক প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘প্রকৃত অর্থে সরকার বিদেশি ঋণের দুষ্টচক্রে পড়ে গেছে। পরিস্থিতি এত খারাপ যে, এখন ঋণ করে ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি থেকে বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ নিয়েছে সরকার। এই বাজেট সহায়তার অর্থ বিদেশি ঋণের কিস্তি বাবদ আবার পরিশোধ করতে হচ্ছে। এক ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আরেক ঋণের বোঝা চাপছে দেশের ওপর। ‘আমরা বলেছিলাম, দেশের মেগাপ্রকল্পগুলোর ঋণের কিস্তি পরিশোধে সবচেয়ে বড় ধাক্কা আসবে ২০২৪ সাল থেকে ২০২৬ সালে। এখন সেই সময় উপস্থিত।
দেনার চাপ বাড়ছে যেসব প্রকল্পে: কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পের জন্য নেওয়া চায়নিজ ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে প্রকল্পটি উদ্বোধনের আগেই। প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটিতে চীন ও বাংলাদেশ যৌথভাবে অর্থায়ন করেছে। দুই শতাংশ সুদে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে বেইজিং। গ্রেস পিরিয়ড শেষ হওয়ায় গত অর্থবছর থেকেই এ প্রকল্পের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে। পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের জন্য চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ২ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তি হয় ২০১৮ সালে। গত এপ্রিলে এই প্রকল্পের পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে। ফলে চলতি অর্থবছর থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ পড়েছে সরকারের ঘারে। ১৫ বছর ধরে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হবে। ডিপিডিসি প্রকল্পের আওতায় পাওয়ার সিস্টেম নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণের জন্য ২০১৯ সালে চীনের কাছ থেকে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নেয় সরকার। এই ঋণের গ্রেস পিরিয়ড শেষ হবে আগামী জুনে। এ ছাড়া চোখ রাঙাচ্ছে রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মাণ হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নে রাশিয়া থেকে ঋণ নেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার। স্থানীয় মুদ্রায় এই ঋণের পরিমাণ প্রায় (ডলারপ্রতি ১১০ টাকা ধরে) ১ লাখ ২৫ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। ২০২৪ সালে উৎপাদনে যাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি। চুক্তি অনুযায়ী ২০২৬ সাল থেকে সুদে-আসলে কিস্তির অর্থ পরিশোধ করতে হবে। ফলে চলমান কিস্তির সঙ্গে এই একটি প্রকল্পের জন্য আরও প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ কিস্তি পরিশোধের চাপ তৈরি হবে সরকারের ওপর। আলোচিত এসব প্রকল্প ছাড়াও বিমান বাহিনীর জন্য হেলিকপ্টার ও এয়ারক্রাফট কেনার জন্য রাশিয়া থেকে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-১, মাতাবাড়ী ১ হাজার ২০০ মেগওয়াট কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা মাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট লাইন-৫, লাইন-৬, ফোর্থ প্রাইমারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট প্রশস্তকরণ প্রকল্প, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ যমুনা নদীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে ব্রিজ প্রকল্পের মতো বড় প্রকল্প রয়েছে যেগুলোর বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ প্রতি বছরই যুক্ত হবে।