Originally posted in সময়ের আলো on 12 January 2024
বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একের পর এক পরিকল্পনা নিয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে উৎপাদন সক্ষমতা। চাহিদা না থাকা সত্ত্বেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে সক্ষমতা বাড়িয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্য পরিশোধ জ্বালানি খাতের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুয়ায়ী, ২০২৩-২০২৪ ও ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৩৬১ মেগাওয়াট। সে হিসেবে ২০২৫ সালে উৎপাদন ক্ষমতা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩৮ হাজার মেগাওয়াট। যদিও গত বছর জ্বালানি সংকটে অর্ধেকের বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে ছিল। এর ফলে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ায় করতে হয়েছে লোডশেডিং। গত বছর ১৯ এপ্রিল সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সে হিসেবে সাড়ে ১১ হাজার মেগাওয়াটের বেশি সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র অলস বসে ছিল।
অপরদিকে, ২০১৬ সালে করা মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, বছরভিত্তিক বিদ্যুৎ চাহিদার যে প্রক্ষেপণ করা হয় তাতে ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ চাহিদার প্রক্ষেপণ করা হয় ১৭ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট। কিন্তু গত বছরের ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতের সর্বোচ্চ গড় সরবরাহ ছিল ১৩ হাজার ৫৫৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ প্রক্ষেপণের চেয়ে প্রকৃত চাহিদা প্রায় ২১ শতাংশ কম হয়েছে। ২০২২ সালে বিদ্যুৎ চাহিদার প্রাক্কলন ছিল ১৫ হাজার ৭৪৬ মেগাওয়াট। এর বিপরীতে প্রকৃত চাহিদা ছিল ১২ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। ২০২১ সালে চাহিদার প্রক্ষেপণ ছিল ১৪ হাজার ৪৬০ মেগাওয়াট, সেখানে প্রকৃত চাহিদা দাঁড়িয়েছিল ১৩ হাজার ৫৫৪ মেগাওয়াটে। বিভিন্ন সংকটে বিদ্যুতের এ চাহিদা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী মেলাতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। এ অবস্থায় আরও ১১ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সক্ষমতা বৃদ্ধিকে বড় রকমের বোঝা মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, চাহিদা না থাকা বা উৎপাদন করতে না পারা সত্ত্বেও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে তা বসিয়ে রেখে হাজার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্য দিতে হয়েছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে তা বসিয়ে রাখলে ক্যাপাসিটি চার্যের বোঝা বাড়বে। আরও ঋণের দায়ে ডুববে বিপিডিবি, যার প্রভাব পড়বে সমগ্র অর্থনীতিতে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে এখনই পরিকল্পনা সংশোধন করা উচিত।
পিডিবির বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত ১১ হাজার ৭৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে পাবলিক সেক্টরে ৫৫৩৪ মেগাওয়াট, ১৮৬১ মেগাওয়াট জয়েন্ট ভেঞ্চারে এবং প্রাইভেট সেক্টরে ৩৬৮৪ মেগাওয়াট সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নেওয়া হয়। আর ২০২৩ সালে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল পাবলিক সেক্টরে ৫০ মেগাওয়াট, জয়েন্ট ভেঞ্চারে ৬১৬ মেগাওয়াট এবং প্রাইভেট সেক্টরে ২০১৫ মেগাওয়াট, মোট ২৬৮২ মেগাওয়াট। ২০২৩ সালের চেয়ে ২০২৪ সালে দ্বিগুণের বেশি সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। এ সময় পাবলিক সেক্টরে ২৭৭২ মেগাওয়াট, ১২৪৪ মেগাওয়াট জয়েন্ট ভেঞ্চারে এবং পাইভেট সেক্টরে ১৪৯২ মেগাওয়াট, মোট ৫ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। ২০২৫ সালে পাবলিক সেক্টরে ২৭৪০ মেগাওয়াট, প্রাইভেট সেক্টরে ১৭৭ মেগাওয়াট, মোট ২৯১৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হবে। এ সময় জয়েন্ট সেক্টরে কোনো সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেই।
পিডিবি বলছে, ইতিমধ্যে ২৭টি প্রজেক্টের কাজ চলমান। এর মধ্যে পাবলিক সেক্টরের ১০টি কেন্দ্রে ৩৫৪৩ মেগাওয়াট, জয়েন্ট ভেঞ্চারে ২টি কেন্দ্রে ২৪৮৬ মেগাওয়াট এবং আইপিপির ১৫টি প্রজেক্টে ৩৩০৫ মেগাওয়াট। এগুলো থেকে মোট ৯৩৩৪ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া প্রাইভেট সেক্টরে ১৪টি প্রজেক্ট (৬৫৯ মেগাওয়াট) চুক্তি, পাবলিক সেক্টরে ৪টি এবং প্রাইভেট সেক্টরে ৩টি প্রজেক্ট (৬২৮) টেন্ডারের অপেক্ষায় রয়েছে।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) লোকসান ৫২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, যা এ যাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত অর্থবছরে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন এ সরকারি সংস্থাটি মূলত টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানির খরচ বৃদ্ধি ও ভারত থেকে অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানি করে ৪৭ হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা লোকসান করেছে। সবমিলিয়ে পিডিবি গত অর্থবছরে ৮৮ হাজার ৪৫০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে ৯৬ হাজার ৮৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। ছয়টি বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে এ বিদ্যুৎ বিক্রি করেছে ৫০ হাজার ৮৫৮ কোটি ২৫ লাখ টাকায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৮৩৪ মেগাওয়াট। এ সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে দিনে ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট। ১১ হাজার ৭৩৬ মেগাওয়াট সক্ষমতা বসিয়ে রাখতে হয়েছে। তার মানে সর্বোচ্চ চাহিদার সময়েও ৪৪ শতাংশ বিদ্যুৎ সক্ষমতা অলস ছিল। গড়ে ৫০ শতাংশের বেশি বসিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু উৎপাদন না করলেও দিতে হয় কেন্দ্র ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)।
সিপিডির ডিরেক্টর রিসার্চ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সময়ের আলোকে বলেন, আমাদের সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে আমরা ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না। অব্যাহতভাবে জেনারেশনকে গুরুত্ব দিয়ে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। অথচ এখন সেই চাহিদা নেই। এটা অর্থনীতির দায় বাড়াচ্ছে। বিপিডিবিকে আরও দেনায় ডুবিয়ে ফেলবে। সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
তিনি বলেন, ২০২৪ সালের মধ্যে সরকারের কুইক রেন্টাল প্লান্ট বন্ধ করে দেওয়ার কথা থাকলেও কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে নো ইলেকট্রিসিটি নো পে কঠোরভাবে মানা, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কম খরচের বিদ্যুতের দিকে যাওয়া, রিনিউয়েবলকে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। সেই জায়গায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের বোধোদয় হয়েছে বলে মনে হয় না।
শুরুতে কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার যুক্তি ছিল। কিন্তু সক্ষমতা অতিরিক্ত করার পরও এটি এখন অর্থনীতির জন্য মাথাব্যথা হয়ে গেছে। এটা থেকে বের হতে হবে। এ কেন্দ্র ভাড়া বড় রকমের অপচয়। এ অপচয় নেওয়ার মতো সামর্থ্য এখন অর্থনীতির নেই। এখন কেন্দ্র ভাড়া দিয়ে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার কোনো যুক্তি নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন সময়ের আলোকে বলেন, অন্তত ১০ বছর নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার পরামর্শ দিয়েছি বিদ্যুৎ বিভাগকে। সোলার পাওয়ার প্লান্ট করা যেতে পারে। যেখানে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎকেন্দ্র বসে থাকছে, সেখানে আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা আমাদের জন্য সাংঘাতিক রকমের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এ ধরনের ভুল সিদ্ধান্তের জন্যেই আমরা ভুগছি। আজ ডলারের যে চাপ তার মূলে রয়েছে পাওয়ার সেক্টর।