Published in Prothom Alo on Sunday, 6 September 2015.
বিশেষ সাক্ষাৎকার: মোস্তাফিজুর রহমান
বিনিয়োগ ও ভোক্তাস্বার্থ ধাক্কা খাবে
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফ
সরকার কর্তৃক বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য আরেক দফা বাড়ানোয় প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভোক্তা ও বিশেষজ্ঞ মহলে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করা হলো।
প্রথম আলো : এই সরকারের দুই আমলে বিদ্যুতের দাম বাড়ল অষ্টমবারের মতো। গ্যাসের দামও বেড়েছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
মোস্তাফিজুর রহমান : এ মুহূর্তে বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানির দাম—এই তিনের মধ্যে সমন্বয়ের নীতি থাকা উচিত। বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম বাড়া-কমার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। জ্বালানির দাম সরকার সরাসরি নির্ধারণ করে। এই তিনের সমন্বয় করেই এগোনো উচিত। এখন বিদ্যুৎ-গ্যাসকে আলাদা করা হয়েছে। জ্বালানির দাম নিয়ে কী করবে, তা যদিও অস্পষ্ট। একদিকে যখন বিশ্ববাজারে তেলের দাম পড়ে গেছে, তখন এই মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি সমন্বিতভাবে করা সম্ভব ছিল। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম যে কমল, সেটার সুযোগ ভোক্তা পর্যায়ে কীভাবে দেওয়া যায়, আমার মনে হয় সেই দিকটা মূল্যবৃদ্ধির সময় কম চিন্তা করা হয়েছে। সরকারিভাবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণকারীরা ক্রয় করে জনসাধারণের কাছে যেভাবে বিক্রি করছে, তাতে আগে কিছুটা ভর্তুকি দিতে হতো। উৎপাদন খরচের চেয়ে কমে দিচ্ছে তারা। তবে এখন মূল্যবৃদ্ধির কারণে সরকারের কিন্তু লাভ হবে। এভাবে দাম বাড়ানোয় যেমন বিনিয়োগ ও ভোক্তাস্বার্থ ধাক্কা খাবে, উল্টোদিকে সরকারের কোষাগারে অতিরিক্ত অর্থও জমবে।
প্রথম আলো : উৎপাদন বৃদ্ধি ছাড়া উন্নয়ন কঠিন। গ্যাস ও বিদ্যুতের ঘন ঘন মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন খাতে কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে?
মোস্তাফিজুর রহমান : গ্যাসের ক্ষেত্রে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব অনুভূত হয়। অনেক পোশাক কারখানা ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের আমরা গ্যাস সরবরাহ করতে পারছি না। অনেক শিল্পকারখানা রয়েছে, যাদের অনেক কর্মকাণ্ড কেবল গ্যাস দিয়েই চালাতে হয়। আমাদের এখানে গ্যাসের দাম ঐতিহাসিকভাবে নির্ধারণ করা হতো। অর্থাৎ এর অর্থনৈতিক মূল্যকে শূন্য ধরে বিপণন-বিতরণের খরচটা শুধু দামের মধ্যে ধরা হতো। এখন সেটা ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করা দরকার। যাঁরা পাইপলাইনে গ্যাস পাবেন, তাঁদের তুলনায় এলপিতে পাওয়া গ্যাসের মূল্য কিছুটা সুবিধা দিয়ে সমন্বয় করা যেত। অন্যদিকে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা মোটেই বোধগম্য হচ্ছে না। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, সরকারের উৎপাদিত বিদ্যুতের দাম কমানো হলেও ভোক্তাদের কাছে তার সুবিধা যায় না। দাম না বাড়িয়েও সেই প্রাপ্য সুবিধা যাতে ভোক্তা পায়, তা দেখার দায়িত্ব তো সরকারেরই। সেই কাজে যদি ব্যর্থতা থাকে, সরকারের সুশাসনের সেই ঘাটতির খেসারত কেন জনগণ দেবে? সেটা দক্ষতা ও সুশাসন না বাড়ে, তাহলে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি করে ঘাটতি মেটানোর কোনো মানে হয় না।
প্রথম আলো : বিদ্যুৎ খাতের বেসরকারীকরণ তথা কুইক রেন্টালে বিপুল ব্যয় হচ্ছে। ঘাটতি মিটছে না ঠিকই কিন্তু কোষাগার থেকে বিপুল অর্থ যাচ্ছে।
মোস্তাফিজুর রহমান : আশা করেছিলাম, কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর ওপর নির্ভরশীলতা রয়েই গেছে। কুইক রেন্টাল কোম্পানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে সরকারকে। বাড়তি উৎপাদন খরচ হচ্ছে, এবং তার খেসারত দিচ্ছে সাধারণ বিদ্যুৎ-ক্রেতারা। এটাই কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যর্থতা। বিদ্যুৎ খাতে দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলে কুইক রেন্টাল থেকে বেরিয়ে আসা যেত। জরুরি প্রয়োজনে কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ কাজে লাগে; স্থায়ীভাবে এর ওপর নির্ভরশীলতা জনস্বার্থ ও জ্বালানি স্থিতিশীলতার জন্য ভালো নয়। সুতরাং সরকারিভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলে ভোক্তাদের ওপর চাপ দিতে হতো না। বিতরণ কোম্পানিগুলোর দুর্বলতায়ও লোকসান হয়; তারও খেসারত দেন ভোক্তাসাধারণ!
প্রথম আলো : ভর্তুকি কমানো ও মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে যে অর্থ সঞ্চয় হয়, তা কী কাজে লাগে?
মোস্তাফিজুর রহমান : আমরা বলেছিলাম গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মধ্যে দিয়ে আহরিত অর্থ এমন ভাবে ব্যয় করতে হবে, যাতে বাপেক্স শক্তিশালী হয়। প্রাপ্ত অর্থ যাতে সমুদ্র থেকে গ্যাস উত্তোলনে ব্যবহৃত হয়। অথচ সরকারের সেদিকে নজর নেই। অনেক দিন ধরে তাদের উদ্যম-উদ্যোগ দেখি না। এখন দাম বাড়ার কারণে সরকারের কোষাগারে বেশি অর্থ গেল ঠিকই, কিন্তু বিনিযোগের ওপর আঘাতও এল। ভোক্তার ব্যয় বাড়ছে, উৎপাদন ও বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কিন্তু এই বাড়তি অর্থ দিয়ে যদি সরকার উৎপাদকের কাছে প্রয়োজনমতো গ্যাস দিতে পারে, শিল্প খাতে অবকাঠামোগত বিনিয়োগ করে, তাহলে সার্বিকভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য লাভবান হবে। এই মুনাফা স্থলে ও সমুদ্রে গ্যাসক্ষেত্র উন্নয়ন এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় করা দরকার ছিল। ভর্তুকি কমানোর সাশ্রয় যদি উৎপাদনবান্ধব, পরিবেশ ও কৃষিবান্ধব হয়, তাতে ক্ষতি নেই।
প্রথম আলো : তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ কোন প্রক্রিয়ায় করা উচিত?
মোস্তাফিজুর রহমান : জ্বালানি তেল যেহেতু কৌশলগত পণ্য, তাই সরকার এর মূল্য সরাসরি ঠিক করে। যেভাবে সরকার মূল্য সমন্বয় করে, সে ক্ষেত্রে এর ভার বাজারের হাতে পুরোপুরি হয়তো দেবে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠা-পড়া এবং নিকট ভবিষ্যতে এর মূল্য বাড়া বা কমার সম্ভাবনার নিরিখে মূল্য নির্ধারণ করা যেত। এবার আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম দুই-তৃতীয়াংশ পড়ে গেলেও এবং নিকট ভবিষ্যতে এর দাম বাড়ার সম্ভাবনা কম থাকলেও, সরকারের নীতিনির্ধারণে এর প্রভাব পড়ল না। এই তেলই বিদ্যুৎ উৎপাদনে লাগে, ফলে সেখানেও উৎপাদন খরচ কমে গেল। তাই বাজারমূল্য ব্যবহার করে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করার কৌশলগত প্রয়োজন ছিল।
প্রথম আলো : গ্যাস ও বিদ্যুতের দায়িত্ব বিইআরসির। তাদের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া কি স্বচ্ছ?
মোস্তাফিজুর রহমান : স্বাধীনভাবে কাজ করে গণশুনানির মাধ্যমে ৯০ দিনের মধ্যে মূল্য নির্ধারণ করার কথা বিইআরসির। কিন্তু তারা কী শুনল, কাদের কাছ থেকে শুনল, বোঝা গেল না। তারা প্রজ্ঞাপন দেয় কিন্তু ব্যাখ্যা করে না। এ বিষয়ে বিশ্লেষণ ও তথ্য-উপাত্ত-যুক্তিসহ প্রজ্ঞাপন দিলে বোঝা যেত কিসের ভিত্তিতে দাম বাড়ানো হলো। যেভাবে পাবলিক-প্রাইভেট সংমিশ্রণ করে বিদ্যুতের দাম কমানোর কথা ছিল, সেটা হয়নি। সরকারের যে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি পরিকল্পনা ছিল, তা বাস্তবায়ন করলে আমরা কুইক রেন্টাল থেকেও বেরিয়ে আসতে পারতাম। তাতে উৎপাদন খরচ কমে আসত এবং দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। অথচ প্রাইভেট রেন্টালগুলোকে ব্যয়বহুল প্রক্রিয়ায় টিকিয়ে রাখা হচ্ছে।
প্রথম আলো : অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের বিদ্যুৎ-গ্যাস ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা কেমন চরিত্রের?
মোস্তাফিজুর রহমান : সরকার জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করে লাভের দায়ভার উৎপাদক ও ভোক্তা পর্যায়ে দিচ্ছে; এটা কোনো ভালো নীতি নয়। উন্নয়নের জন্য সম্পদের ভালো ব্যবহার প্রয়োজন। তার জন্য যত স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সঙ্গে রিসোর্সকে ব্যবহার করা যাবে, তত এর যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা হয় এবং রাজনৈতিকভাবেও এর ফল নেতিবাচক হয় না। কিন্তু দেখছি উল্টা। এটা ভালো অর্থনীতি না, ভালো রাজনীতিও না।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
মোস্তাফিজুর রহমান : ধন্যবাদ।