বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, সংকট কাটাতে দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন – ড. মোয়াজ্জেম

Originally posted in খোলাকাগজ on 13 May 2025.

রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় আটকে আছে বিনিয়োগ

অনির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশের সামগ্রিক বিনিয়োগ পরিবেশকে ব্যাপকভাবে ব্যাহত করছে। এর সঙ্গে আরো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জ্বালানি সংকট, আমদানি জটিলতা এবং অর্থনৈতিক নীতির অনিশ্চয়তা। ফলে সরকার ও বেসরকারি খাত নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ প্রবাহ এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকারি পরিসংখ্যানে বিনিয়োগ বৃদ্ধির দাবি করলেও বাস্তব মাঠপর্যায়ে সেই প্রবাহে রয়েছে বড় ধরনের স্থবিরতা।

নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি জবাবদিহিমূলক ও স্থিতিশীল সরকার ছাড়া দেশে টেকসই বিনিয়োগ সম্ভব নয় এমন মত দিয়েছেন দেশের খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শিল্পোদ্যোক্তারা। তাদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। পাশাপাশি দরকার স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নীতি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ এবং একটি প্রকৃত অর্থে উদ্যোক্তাবান্ধব পরিবেশ।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জুলাই-মার্চ) মোট প্রস্তাবিত বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগের হার মাত্র ২০-২২ শতাংশ। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) প্রবাহ গত কয়েক বছর ধরেই স্থবির। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ২.৫৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ২৫ শতাংশ কম। ২০২৫ সালেও এই চিত্র উল্লেখযোগ্যভাবে পরিবর্তিত হয়নি।

ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যবসাবান্ধব নীতিমালার অভাব এবং নীতির অস্থিরতা বিনিয়োগকারীদের আস্থা ক্ষুণ্ন্ন করছে। অনেক প্রতিষ্ঠানকে বারবার নিয়ম পরিবর্তনের কারণে ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। শিল্প খাতে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অভাব বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করছে। বিশেষত পোশাক, সিরামিক ও ইস্পাত খাত এ সমস্যার মুখে। বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়াতে হলে শুধু নীতি প্রণয়ন নয়, বাস্তবায়নেও স্বচ্ছতা আনতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে আসতে চায়, কিন্তু সিস্টেমের জটিলতা ও অস্থিরতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫ এ বাংলাদেশের একটি দ্রুত বর্ধনশীল, বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি হিসেবে ইতিবাচক ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। সম্মেলনে ৫০টি দেশ থেকে ৪১৫ জন বিদেশি প্রতিনিধি এবং উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দেশি উদ্যোক্তা অংশ নেন। সরকারের বিনিয়োগবান্ধব নীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন ও রফতানিমুখী খাতগুলোর অগ্রগতি তুলে ধরার পাশাপাশি রিনিউয়েবল এনার্জি, ডিজিটাল ইকোনমি, গার্মেন্টস, ফার্মা ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ খাতে বিনিয়োগের সুযোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সম্মেলনটি বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং বাংলাদেশের প্রতি দীর্ঘদিনের নেতিবাচক ধারণা ভাঙার একটি সম্ভাবনাময় সূচনা করেছে বলে দাবি করছে সরকার। তবে এ সম্মেলন থেকে কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া যায়নি বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, দেশে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিনিয়োগ আসবে না। তিনি বলেন, ‘আমরা স্বৈরাচারকে বিতাড়িত করেছি। কিন্তু এখনো নির্বাচিত সরকার হয়নি। বাংলাদেশের জনগণের কাছে জবাবদিহি কোনো সরকার হয়নি। যতক্ষণ সেটা না হবে, ততক্ষণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না। ততক্ষণ বিনিয়োগ হবে না। দেশের মধ্যেও হবে না, দেশের বাইরে থেকেও হবে না।’

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো বিনিয়োগের অনেক সার্কাস দেখতে পাচ্ছি। যারা বিনিয়োগ বোঝে, তারা জানে। এই সার্কাসের মাধ্যমে বিনিয়োগ হবে না। বিনিয়োগ হতে হলে বাংলাদেশে নির্বাচিত, স্থিতিশীল সরকার হতে হবে। তখনই বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয় এবং সেই সরকারের পলিসি দেখে, সেই সরকারের অ্যাটিচিউড দেখে বিনিয়োগ করেন।’

বিনিয়োগকারীদের জন্য বাংলাদেশে ন্যূনতম প্রয়োজনীয় সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ‘যারা ইতোমধ্যে বিনিয়োগ করে রেখেছেন, তাদের জন্য যে ন্যূনতম সহায়তা থাকা দরকার, সেটাও আমরা নিশ্চিত করতে পারছি না।’

ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে রয়েছে ঘাটতি এবং দামও অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। ‘ইউটিলিটি ফ্যাসিলিটিগুলোর ঘাটতি রয়েছে। উদ্যোক্তারা সময়মতো প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাচ্ছেন না, অথচ মূল্য হঠাৎ করেই বাড়ছে, যা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও পরিচালনায় বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে।’

তিনি বলেন, রফতানি ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানিতেও দেখা দিচ্ছে জটিলতা। ‘টাকার অবমূল্যায়নের ফলে আমদানিব্যয় বেড়েছে। তার ওপর এলসি খোলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যা কার্যত আমদানি কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে।

তিনি আরো বলেন, ‘রিজার্ভের অবস্থা এখনো স্থিতিশীল নয়। ফলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা তাদের লাভ মুনাফাসহ ফেরত নিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নয়। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে না।’

বাজার চাহিদা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘দেশে এখন ভোক্তাশ্রেণির ওপর চাপ অনেক বেশি। উচ্চমূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের কেনার সক্ষমতা কমেছে, ফলে পণ্যের বাজারে চাহিদাও কম।’

সবকিছু ছাপিয়ে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে তিনি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাকে চিহ্নিত করেন। তার ভাষায়, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় নির্বাচন প্রয়োজন। এই পরিস্থিতি শুধু একটি সুষ্ঠু নির্বাচনেই পরিবর্তন সম্ভব, অন্য কোনো পথ নেই।’

ইয়ুথ গ্রুপের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট শিল্পোদ্যোক্তা আবুল কাশেম হায়দার বলেন, বিনিয়োগের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি শর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ। বিনিয়োগকারী দেশি হোক কিংবা বিদেশি, সবার আগে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা চায়। আর এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রয়োজন একটি নির্বাচিত, শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সরকার।

তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্বল সরকার এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতির অভাব এই সবকিছু বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে। এখন দেশে একটা বিনিয়োগ স্থবিরতা চলছে। বর্তমান সরকার চেষ্টা করলেও কার্যকর কোনো সমাধান দিতে পারছে না।’

জ্বালানি সংকটকে বিনিয়োগের বড় বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে তিনি বলেন, ‘নতুন কেউ যদি এখন বিনিয়োগ করতে চায়, তাহলে তাকে প্রতি ঘনফুট গ্যাসের জন্য ৭০ টাকা গুনতে হবে। বিনিয়োগকারী অবশ্যই লাভ-লোকসানের হিসাব কষে সিদ্ধান্ত নেবে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ কারণেই নতুন বিনিয়োগ আসছে না।’

চলমান কারখানাগুলো নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘যেসব কারখানা এখনো উৎপাদনে আছে, তাদের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। অনেকেই ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারছে না। এসব প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের পক্ষ থেকে জরুরি নীতিগত সহায়তা প্রয়োজন।’

তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সঙ্গে সাধারণ জনগণের যেমন সংযোগ দুর্বল, তেমনি ব্যবসায়ী সমাজের সঙ্গেও সম্পর্ক সীমিত। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোও রাজনীতিকরণে জড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে বাস্তবসম্মত এবং বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না।’

আবুল কাশেম হায়দারের মতে, বিনিয়োগ টানতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জ্বালানির নিরাপত্তা, স্বচ্ছ ও দীর্ঘমেয়াদি নীতি এবং কার্যকরী ব্যবসায়িক সম্পর্ক অপরিহার্য। অন্যথায়, বর্তমান স্থবিরতা আরো দীর্ঘায়িত হবে এবং শিল্প ও অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।