Published in Prothom Alo on Thursday, 1 January 2015.
বিশেষজ্ঞ মন্তব্য : দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
অনুন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক বিকাশকে যদি ত্বরান্বিত করতে হয়, তাহলে অর্থনীতির কাঠামোগত যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলোকে চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে হবে। সে জন্য আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার চেয়ে স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেছি। সে কারণেই আয় বাড়ানোর পাশাপাশি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতার দিকেও মনোযোগী হওয়ার কথা বলছি।
দ্বিতীয়ত, মধ্যম আয়ের দেশের এই ধারণা এমন একটা আত্মতৃপ্তির সৃষ্টি করে যে মধ্যম আয় হলেই কিংবা ১০০০-১২০০ ডলার আয় হয়ে গেলেই আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। পৃথিবীতে এখন গড়ে ৫৫-৫৬ বছরের চেয়ে কম কোনো মধ্যম আয়ের দেশ নেই। সবচেয়ে ত্বরান্বিতভাবে যে দেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশের দিকে গেছে, তার লেগেছে ২৬ বছর। ছোট দেশ হিসেবে আগে গেছে মালটা, তারপর গেছে জাপান, তারপর গেছে দক্ষিণ কোরিয়া। সেটা গেছে আশির দশকে।
পুরো লাতিন আমেরিকা, ব্রাজিল, ইকুয়েডর থেকে শুরু করে সবাই ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে মধ্যম আয়ের দেশে রয়েছে। তারা একটা ফাঁদে (ট্র্যাপ) আছে। ফাঁদটা হলো, তাদের কাঠামোগত সমস্যাগুলোর সমাধান হচ্ছে না। প্রথম যে জিনিসটার সমাধান হয় না, সেটা হলো অবকাঠামো। দ্বিতীয়ত আছে পাবলিক সার্ভিস। এরপর স্যানিটেশন। এরপর অপরিকল্পিত নগরায়ণ। সামাজিক বিভিন্ন সমস্যারও সমাধান হয় না। এর সঙ্গে আছে সুশাসনের সমস্যা। এখন যে একটা কথা বলা হয়, মধ্যম আয়ের দেশ হলে আমরা বিরাট হব। মধ্যম আয়ের দেশ হলে ঢাকার এই যানজট আমাদের সঙ্গেই থাকবে। এর সঙ্গে পুষ্টিহীনতাও থাকবে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুও থাকবে এবং এর সঙ্গে দুর্নীতিও থাকবে। আমার দৃষ্টিতে আরেকটু সামগ্রিকতার নিরিখে লক্ষ্য ঠিক করা উচিত।
আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়
প্রবৃদ্ধির সুফল গড়িয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে যাওয়ার যে তত্ত্ব, তা মোটামুটিভাবে বাতিল হয়ে গেছে সেই ষাটের দশকেই। কারণ, অনেক দেশই প্রবৃদ্ধি বাড়ালেও তাতে দারিদ্র্য তেমন কমাতে পারেনি, বরং বৈষম্য বেড়ে যায়। সত্তরের দশকে এ নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা গবেষণা করে দেখান, অনেক দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়লেও এর সুফল দরিদ্র মানুষেরা পাননি। অনেক দেশে বৈষম্য বেড়েছে, অপূর্ণাঙ্গ কর্মসংস্থান বেড়েছে কৃষি খাতে এবং সাধারণ মানুষের জীবনমানেরও অবনতি ঘটেছে।
সত্তরের দশকেই অর্থনীতিবিদেরা এটা মেনে নেন যে কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি একটি দেশের উন্নয়নের সঠিক বা যথাযথ নির্দেশক নয়। এরপরই উন্নয়ন তত্ত্বে পুনর্বণ্টন এবং সামাজিক সূচক বিষয়টি গুরুত্ব পায়। অথচ মধ্যম আয়ের দেশ হতে হলে এখনো কেবল মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিকেই সূচক হিসেবে গণ্য করা হয়।
মধ্যম আয়ের ফাঁদ
কেবল আয় বাড়িয়ে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পর ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদ’-এ পড়ে আছে অসংখ্য দেশ। এর মধ্যে এমন অনেক দেশও আছে, যারা দ্রুত আয় বাড়িয়ে দ্রুত মধ্যম আয়ের দেশ হতে পেরেছে। কিন্তু কয়েক দশক চলে যাওয়ার পরও দেশগুলো আর উচ্চ আয়ের দেশ হতে পারেনি। এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো আটকে আছে বহুদিন ধরে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা। এমনকি চীন ও রাশিয়াও আটকে আছে মধ্যম আয়ের ফাঁদে। মূলত যারা কেবল আয় বাড়াতেই মনোযোগ দিয়েছে বেশি, অবকাঠামো, শিক্ষাসহ মানবসম্পদ উন্নয়ন, রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামুখী থাকার দিকে নজর দেয়নি, তারাই আটকে আছে এই ফাঁদে। ফাঁদে না পড়ার সবচেয়ে ভালো উদাহরণ দক্ষিণ কোরিয়া।
বিশ্বব্যাংকের পরামর্শ: মধ্যম আয়ের দেশ হতে বাংলাদেশের দুর্বলতা আছে। তাই যা দূর করতে হবে—
১. দুর্বল অবকাঠামো
২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
৩. উৎপাদন খাতে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সীমিত সাফল্য
৪. দুর্বল অর্থনৈতিক শাসন পরিচালনা
৫. দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং
৬. বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের অভিঘাত
বিজিএমইএর উদ্যোগ
মধ্যম আয়ের দেশ হতে িবজিএমইএ ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করতে চায় ২০২১ সাল নাগাদ
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার, বাংলাদেশ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০১০–২০২১, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)