বে-নজির বাজেট – দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in প্রথম আলো on 7 June 2024

বাংলাদেশের ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের কোনো কোনো প্রস্তাব ‘বে-নজির’ বা অনন্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির বিপরীতে বাজেটে ঘোষিত ‘কালোটাকা সাদা করার’ বিশেষ পদক্ষেপ বিবেচনা করে।

অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় প্রত্যক্ষ করের ওপর আলোচনায় একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। সেটা হলো, ‘প্রস্তাবিত বিধান অনুযায়ী, দেশের প্রচলিত আইনে যা-ই থাকুক না কেন, কোনো করদাতা স্থাবর সম্পত্তি, যেমন ফ্ল্যাট, অ্যাপার্টমেন্ট ও ভূমির জন্য নির্দিষ্ট করহার এবং নগদসহ অন্যান্য পরিসম্পদের ওপর ১৫% কর পরিশোধ করলে কোনো কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারবে না।’

এই প্রস্তাবের সুযোগভোগীদের তিনটি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, বিদ্যমান করহারে বিভিন্ন ধরনের স্থাবর সম্পত্তির ওপর কার্যকর কর হবে অন্যান্য তুলনীয় করহারের চেয়ে অনেক কম। দ্বিতীয়ত, যথাসময়ে এই আয় বা সম্পত্তি ঘোষণা না করার জন্য আর্থিক দণ্ড দিতে হবে না। তৃতীয়ত, এবং বিষয়টি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ-এই সম্পদ বা অর্থ যদি দুর্নীতি বা অন্য কোনো অসৎ উপায়ে অর্জিত হয়ে থাকে, তবে দেশের সুশাসন নিশ্চিত করায় নিয়োজিত কোনো নজরদারি প্রতিষ্ঠান এই ধারার সুযোগভোগীদের আইনের আওতায় আনতে পারবে না।

পরিহাসের বিষয় হলো, নতুন বাজেটে অন্য একটি প্রস্তাবের মাধ্যমে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক করদাতাদের বার্ষিক আয়ে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ শতাংশ করহার নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সৎভাবে অর্জিত এবং ঘোষিত আয়ের ওপর আয়কর হবে অঘোষিত এবং সম্ভবত অসদুপায়ে অর্জিত আয়ের প্রায় দ্বিগুণ। কর ব্যবস্থাপনায় এটা বে-নজির, যেখানে সৎ করদাতাদের নিপীড়ন করে অসৎ ব্যক্তিদের তোষণ করা হচ্ছে।

এই নৈতিক বৈপরীত্য আরও প্রকটভাবে প্রকাশ পায় যখন আমরা ক্ষমতাসীন দলের ২০২৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রাসঙ্গিক ধারা স্মরণ করি। ওই দলিলের ‘সুশাসন’-সম্পর্কিত ৩.২ অধ্যায়ের ‘চ’ অনুচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ’। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জন, ঘুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার, স্বজনপ্রীতি, পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য ও দুর্বৃত্তায়ন নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ চলমান থাকবে।’ প্রশ্ন হলো, কী পরিস্থিতিতে সরকার জনগণের কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি থেকে এ রকম বে-নজিরভাবে বিচ্যুত হয়?

বিষয়টি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সাম্প্রতিককালে রাষ্ট্রকাঠামোর অতি উচ্চপর্যায়ে অবস্থিত বা সংযুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও গোষ্ঠীর অকল্পনীয় বিত্তবৈভব অর্জনের তথ্য উৎকটভাবে প্রকাশ হয়ে পড়ায়। এটা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না যে ‘কালোটাকা’ (ধূসর টাকা নয়!) ‘সাদা’ করার এই নীতি বিবর্জিত প্রস্তাবটি কোনো পরাক্রমশালী গোষ্ঠী দ্বারা প্রণোদিত।

সত্য হলো, এসব ক্ষমতাশালী ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিপুল আয় বহুলাংশে ‘পবিত্র’ নয়, তাই তা প্রায়ই করের আওতায় আসে না। অনেক ক্ষেত্রে তা দেশের বাইরে পাচার হয়ে যায়। যেটুকু থাকে, তা ‘জায়েজ’ বা বৈধ করার জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে বিষয়টি এসেছে। এটি আর্থিক শৃঙ্খলাবিরোধী, সামাজিকভাবে অন্যায্য, রাজনৈতিক বিবেচনা বর্জিত ও নৈতিকভাবে গর্হিত।

অতীতের অভিজ্ঞতা বলে, এরূপ করসুবিধা ফলপ্রসূ হয় না। সে অর্থে এই নতুন প্রস্তাব একেবারে বে-নজির নয়। মনে রাখতে হবে, এরূপ অন্যায্য এবং কার্যত বেআইনি আর্থিক সুবিধা প্রদান সরকার কর্তৃক আর্থিক সুশাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ও দ্বিপক্ষীয়ভাবে প্রদত্ত বিভিন্ন অঙ্গীকারের পরিপন্থী।

এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আরেকটি বিষয় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখন দেশের বিত্তশালী বা জাতীয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র কিন্তু পরাক্রমশালী দুর্নীতিপরায়ণ গোষ্ঠীকে পরিপালন করছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যে সার্বভৌমভাবে তার রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের ক্ষমতা বে-নজিরভাবে হারিয়ে ফেলেছে, সেটাও আবার নিষ্ঠুরভাবে প্রকাশিত হলো।

যাঁরা এই বাজেট প্রস্তাব প্রস্তুত করেছেন, হয় তাঁরা জনগণের কাছে প্রদত্ত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী অঙ্গীকার সম্বন্ধে অবহিত নন, না হয় তাঁদের আনুগত্য অন্য কোথাও আবদ্ধ।

– দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সম্মাননীয় ফেলো, সিপিডি