Originally posted in Prothom Alo on 22 April 2024
বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ নিকটঅতীতে আমরা যেসব ঋণ পেয়েছি, তার সদুহার আগের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের স্থিতিও বাড়ছে। চলমান অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সুদাসল পরিশোধের পরিমাণ বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। সুদ ব্যয় বেড়েছে ১১৭ শতাংশ আর আসল ব্যয় বেড়েছে ২২ শতাংশ।
২০১৫ সালে বাংলাদেশ নিম্ন আয় থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণের প্রেক্ষাপটে সহজ শর্তের ঋণ প্রাপ্তির বিপরীতে তুলনামূলকভাবে কঠিন শর্তের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে আমরা যেসব ঋণ পেয়েছি, তার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুদহার যেমন ছিল বেশি, তেমনি গ্রেস পিরিয়ড ও মেয়াদকাল ছিল কম।
বিগত সময়ে বাংলাদেশ বেশ কিছু প্রকল্পের জন্য সরবরাহকারী ঋণ বা সাপ্লয়ার্স ক্রেডিট নিয়েছে—যে ঋণের সুদহার বেশি; অন্যান্য শর্তও কঠোর। কিছু কিছু ঋণ নেওয়া হয়েছে নমনীয় লাইবর/ এসএফওআর সুদহারে। কয়েক বছর আগেরকার ১ শতাংশের জায়গায় এই সুদহার এখন দাঁড়িয়েছে ৪-৫ শতাংশে। ফলে প্রাক্কলিত সুদের হারের চেয়ে প্রকৃত হার কোনো কোনো ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। কিছু কিছু বড় প্রকল্পের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছে তার গ্রেস পিরিয়ড বর্তমানে শেষ হচ্ছে। নিয়ম হলো, গ্রেস পিরিয়ডের সময় কেবল সুদ পরিশোধ করতে হয়, তার পরবর্তী সময়ে মেয়াদকাল শুরু হলে সুদের সঙ্গে আসলও যোগ হয়। ফলে ঋণ পরিষেবার দায়ভার বৃদ্ধি পায়।
২০১৫-২০ সালের দিকে যেসব বৈদেশিক ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার অনেকগুলোর গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়েছে বা শেষের পর্যায়ে আছে। ফলে আমাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং আগামী কয়েক বছর বাড়তে থাকবে। চলমান অর্থবছরে ঋণ পরিষেবার উপরোল্লিখিত চিত্র এই প্রবণতারই পূর্বাভাস মাত্র। বর্তমানের সঙ্গে যোগ হবে নতুনভাবে নেওয়া বৈদেশিক ঋণও।
বৈদেশিক ঋণের দায়ভার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এ সময়ে টাকার বিনিময় হারের বড় ধরনের অবনমন হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। ফলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের দিক থেকে আমরা ত্রিমাত্রিক চাপে আছি। সামনে টাকার অবমূল্যায়ন অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বাড়বে। বেসরকারি খাতের পক্ষে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা কিছুটা সহজ। কারণ বেসরকারি খাত রপ্তানি করে ডলার আয় করতে পারে এবং সেই অর্থ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ পরিশোধ করতে পারে। কিন্তু সরকার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করে, তার আয় হয় মূলত স্থানীয় মুদ্রায়, টাকায়। তাই মুদ্রার বিনিময় হারের অবনমনে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সরকারের জন্য বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।
ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত সমস্যায় পড়েনি। কিন্তু বিকাশমান পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নির্বাচনে অধিকতর সতর্কতা ও বাস্তবায়নে সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। অতি মূল্যায়িত প্রকল্প ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্র প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করে। তাতে ঋণের খরচ বেড়ে যায়। তাই এসব বিষয়ে এখনই দৃষ্টি দিতে হবে, সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ আহরণ (রাজস্ব-জিডিপি রেশিও) উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সর্বনিম্নের কাছাকাছি। তাই রাজস্ব আদায় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অনুকূল শর্তে ঋণপ্রাপ্তির প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তুলনামূলকভাবে সহজ শর্তের ঋণের উৎস খুঁজতে হবে (যেমন জলবায়ু ফান্ড)। বৈদেশিক ঋণের আলোচনায় বিশ্লেষণ-নির্ভর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সাশ্রয়ীভাবে ও সময়মতো প্রকল্প শেষ করতে হবে। বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দক্ষতা, উৎকর্ষ, সাবধানতা ও সতর্কতার সময় এখনই।