Published in বণিক বার্তা on Tuesday, 3 April 2018
সম্পাদকীয়, সাক্ষাৎকার
বৈষম্য পুরো সমাজ ব্যবস্থায় বিভাজন তৈরি করে, যা অর্থনীতির জন্য সুখকর নয়
ড. ফাহমিদা খাতুন
নির্বাহী পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। অর্থনীতিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি করেছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য থেকে। পোস্টডক্টরারিয়াল রিসার্চ করেছেন কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ভিজিটিং ফেলো ছিলেন নরওয়ের ক্রিশ্চিয়ান মিখেলসেন ইনস্টিটিউট, দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইকোনমিকস অ্যান্ড ট্রেড ও ভারতের সেন্টার ফর স্টাডি অব সায়েন্স, টেকনোলজি অ্যান্ড পলিসিতে। বিআইডিএসে রিসার্চ ফেলো, ইউএনডিপিতে পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও ইউএসএআইডিতে অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। দেশ-বিদেশের বহু জার্নালে তার গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে। দারিদ্র্য দূরীকরণ, আয়বৈষম্য বৃদ্ধি, মজুরি, বিনিয়োগসহ নানা বিষয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় এ অর্থনীতিবিদের।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস
এসডিজি অর্জনে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে দারিদ্র্য দূরীকরণ কী সম্ভব?
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে দারিদ্র্য পুরোপুরিভাবে দূর করতে যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অনেক দেশের জন্যই কঠিন হবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের খানা আয়-ব্যয় জরিপে আমরা দেখছি, আমাদের দেশে দারিদ্র্য কমছে ঠিকই, কিন্তু যে গতিতে কমছে, সেখানে এক ধরনের ধীরাবস্থা তৈরি হয়েছে। যেমন— ২০১০ সালে যেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যা ছিল ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, ২০১৬ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। কিন্তু দারিদ্র্য দূরীকরণের গতি মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। সেক্ষেত্রে আমরা যদি দারিদ্র্য দূরীকরণের হারের মধ্যে একটা গতিময়তা আনতে না পারি, তাহলে দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্পর্কিত এসডিজির সম্ভব হবে না। সেজন্য আমাদের আয়বর্ধক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বেশি করে বিনিয়োগ দরকার। এক্ষেত্রে যে ধরনের বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকসংখ্যক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হতে হবে। গত চার দশকে আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোয় এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে। যেমন— কৃষিনির্ভর অর্থনীতি থেকে ক্রমান্বয়ে আমরা শিল্প ও সেবা খাতনির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছি। অর্থনীতি যখন এগিয়ে যায়, তখন সেখানে এ ধরনের কাঠামোগত পরিবর্তন হয়। তবে পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল রাখতে হয়, পর্যাপ্ত পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে কিনা এবং মানুষের আয় বাড়ছে কিনা। কৃষি খাত থেকে বর্তমানে জিডিপির মাত্র ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ আসে। অথচ সেখানে মোট শ্রমশক্তির প্রায় ৪৪ শতাংশ নিয়োজিত। অর্থাৎ সেখানে উদ্বৃত্ত শ্রম রয়েছে এবং তারা সারা বছর কাজ পান না। অন্যদিকে আমাদের অর্থনীতির প্রায় ৫২ শতাংশ সেবা খাত থেকে আসে। কিন্তু সেখানে যথেষ্ট পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না। আর্থিক খাত, তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশন, ট্যুরিজম ইত্যাদি খাতের আরো প্রসার ঘটাতে হবে।
আয়বৈষম্য বেড়েছে। এটি কমানোর সহজ কোনো পথ আছে কি?
আমাদের অর্থনীতি এগোচ্ছে। মাথাপিছু আয় বাড়ছে। প্রবৃদ্ধির সংখ্যাগত দিক থেকে আমরা খুব ভালো করছি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ কিংবা স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে এমন উদাহরণ বিরল। কিন্তু প্রবৃদ্ধির যে গুণগত দিক, যেমন প্রবৃদ্ধির সুফল সবার মাঝে সমানভাবে বণ্টিত হচ্ছে কিনা, সেটিই দেখার বিষয়। বর্তমানে উচ্চবিত্তদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হচ্ছে। বিবিএসের খানা জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সালে উপরের ৫ শতাংশ লোকের হাতে মোট দেশজ আয়ের ২৭ দশমিক ৯ শতাংশ রয়েছে, যা ২০১০ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে নিচের ৫ শতাংশ লোকের আয় ২০১০ সালের শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে কমে ২০১৬ সালে শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ হয়েছে। আয়বৈষম্য থেকে সৃষ্টি হয় ভোগের বৈষম্য, সম্পদের বৈষম্য, সুযোগের বৈষম্য। এ থেকে তৈরি হয় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য। সম্পদ আমাদের দেশে ক্ষমতার সহায়ক অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করছে। সেজন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিত্তশালীদের প্রভাব বাড়ছে। আয়বৈষম্য থেকে পুরো সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে যে বিভাজন সৃষ্টি হয়, তা অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না। বৈষম্য থেকে জন্ম নেয় সামাজিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত সবার জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে না পারছি এবং সব ধরনের বৈষম্য লাঘব করতে না পারছি, ততক্ষণ উচ্চপ্রবৃদ্ধি তাত্পর্যপূর্ণ হবে না। আমাদের স্বাধীনতার মূল যে উদ্দেশ্যগুলো ছিল, তার মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করা ছিল অন্যতম। এ লক্ষ্যে আমরা কতদূর আসতে পেরেছি, তা এখন দেখার সময় হয়েছে।
টেকসই ও দৃশ্যমান দারিদ্র্য নিরসনে করণীয় কী হতে পারে?
এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান তৈরির দিকে নজর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে শিক্ষার্থীরা পাস করে বের হচ্ছেন, তাদের মধ্যেও বেকারত্বের সংখ্যা অনেক বেশি। অনেকেই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছেন। আমাদের শ্রমশক্তির প্রায় ৮৫ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত। তাদের কাজগুলো সংগঠিত নয়। এ কাজগুলো নিম্ন আয়ের। এ ধরনের কাজের নিশ্চয়তা থাকে না। টেকসই উন্নয়নের জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। যে কাজের উপার্জন দিয়ে পরিবারের মৌলিক চাহিদাগুলো মেটানো সম্ভব হবে, তাই উপযুক্ত কাজ। আমাদের অর্থনীতির আকার বাড়ছে। কিন্তু আমাদের জনসংখ্যা অনুযায়ী অর্থনীতির আকার বড় নয়। তাই সবাইকে কাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেজন্য শিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে স্বনিয়োজনের ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে তাদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে, যা তারা ছোট ও মাঝারি ব্যবসার মূলধন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে।
আমাদের দারিদ্র্য পরিমাপ পদ্ধতি কতটা কার্যকর বলে মনে করেন?
দারিদ্র্য পরিমাপের বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকেই একটি বিতর্কিত বিষয়। এ বিতর্ক সারা বিশ্বে। মূলত দুটি ধারায় এ বিতর্কটি প্রবাহিত হয়। অনেক বিশ্লেষক বলেন যে, দারিদ্র্য পরিমাপের জন্য যে জরিপগুলো পরিচালনা করা হয়, সেগুলোয় সঠিক তথ্য আসে না। কারণ সেগুলোয় যে লোকগুলো তথ্য দেয়, তারা সাধারণত তাদের আয় বা ভোগের পরিমাণ কম করে বলে। আবার আরেকটি ধারার বিশ্লেষকরা বলেন যে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান দারিদ্র্যের মানদণ্ড কম করে রাখে এবং দারিদ্র্য কমানোটা বেশি করে দেখাতে চায়। অনেক দিন থেকে মাথাপিছু আয় ১ দশমিক ২৫ ডলারকে দারিদ্র্যরেখা ধরা হচ্ছে। অর্থাৎ মাথাপিছু দৈনিক এ আয়ের নিচের মানুষটি দরিদ্র। মাথাপিছু দৈনিক ২ ডলারকে দারিদ্র্যরেখা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আমরা যখন মাথাপিছু ২ ডলার ধরে দারিদ্র্যরেখা নির্ধারণ করব, তখন অনেকেই এ দারিদ্র্যরেখার নিচে পড়ে যাবে এবং দরিদ্র জনগণের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তাই এক্ষেত্রে অনেকের অনীহা রয়েছে। কেননা তখন অনেক আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
|দেশের বিভিন্ন অঞ্চলভেদেও তো দারিদ্র্য হারের তারতম্য রয়েছে।
দারিদ্র্য একটি বহুমাত্রিক বিষয়। অঞ্চলভেদে দারিদ্র্যের তারতম্য রয়েছে। গ্রাম ও শহরে দারিদ্র্যের মাত্রা ভিন্ন ভিন্ন। বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম এলাকায় দারিদ্র্য বিভাজন পরিলক্ষিত হচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোয় যেমন— ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে দারিদ্র্যের হার পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো যেমন— বরিশাল, খুলনা ও রাজশাহীর তুলনায় কম। দারিদ্র্যের হার কমানোর ক্ষেত্রেও পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলো পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর চেয়ে এগিয়ে। আঞ্চলিক বৈষম্য রয়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদ বণ্টনের অভাব। যেসব জেলা পিছিয়ে রয়েছে, তাদের জন্য একই পরিমাণ সম্পদ বণ্টন করলে চলবে না। তাদের এগিয়ে আনতে হলে অর্থের বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা একটু বেশি পরিমাণে দিতে হবে। এক্ষেত্রে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব উল্লেখযোগ্য। এলাকার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়, সেটা নিতে পারছেন কিনা এবং সঠিকভাবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা, সে বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।
ইউরোপ-আমেরিকার রফতানি বাজারে বাংলাদেশের আধিপত্য ধরে রাখা ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এখনই কার্যকর উদ্যোগ না নেয়া হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প সমস্যায় পড়বে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
প্রতিযোগিতা সবসময়ই ছিল এবং সামনেও থাকবে। আমাদের দেশের তুলনায় অন্য দেশগুলো যদি উৎপাদন খরচ কমিয়ে সুলভে পণ্য সরবরাহ করতে পারে, তাহলে ক্রেতারা তাদের কাছেই যাবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কমপ্লায়েন্সের জন্য আমাদের যে খরচ বাড়ছে, সেটাকে আমরা কীভাবে পুষিয়ে নেব? এক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। চীনের মতো উৎপাদনশীল হতে হলে শ্রমিকের দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করতে হবে। তখন শ্রমিকের বেতন বাড়লেও আমরা প্রতিযোগী হতে পারব, যেহেতু শ্রমিকপ্রতি উৎপাদন বাড়বে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমাদের জন্য বিশ্বের বাজার পরিস্থিতি আগের মতো আর থাকবে না। সুযোগ-সুবিধাগুলো ক্রমে কমে যাবে। প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই আমাদের টিকে থাকতে হবে। আগামী ছয় বছর পর ২০২৪ সালে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাব। চলতি বছর এ প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছে। তারপর আরো তিন বছর অর্থাৎ ২০২৭ সাল পর্যন্ত আমরা পর্যবেক্ষণে থাকব। ততদিন পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশের প্রাপ্য সুবিধাগুলো আমরা পাব। কিন্তু তারপর স্বল্পোন্নত দেশের সুযোগ-সুবিধাগুলো আমরা আর পাব না। উন্নয়নশীল দেশের জন্যও কিছু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যেমন— আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাওয়ার জন্য জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স প্লাস বা ‘জিএসপি প্লাস’ পাব। কিন্তু সেক্ষেত্রে অনেক শর্ত থাকবে। যেমন— কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচনে সাফল্য, নারীর ক্ষমতায়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানো ইত্যাদি। তাই আমাদের প্রতিযোগীসক্ষম হতে হবে। প্রতিযোগীসক্ষম হওয়ার জন্য অবকাঠামোগুলোর উন্নয়ন প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়াতে হবে। উপযোগী রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করতে হবে। সুযোগ-সুবিধা চলে গেলেও বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে প্রতিযোগীসক্ষম হওয়ার মাধ্যমে।
পোশাক ব্যবসায়ীরা বলছেন, রফতানির অবস্থা ভালো নয়। মজুরি বৃদ্ধি পেলে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ তাদের মোকাবেলা করতে হতে পারে?
জীবনধারণের জন্য শ্রমিকদের উপযোগী মজুরি দিতেই হবে। এটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক কমপ্লায়েন্সের অংশ। আমরা যদি অন্য সব নিয়মনীতি ও শর্ত পূরণ করতে পারি, তাহলে শ্রমিকের উপযুক্ত মজুরি দিতে পারব না কেন? আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে এটি পূরণ করতে হবে। উৎপাদন খরচ বাড়ার অনেক কারণ রয়েছে। যেটি আগেই বলেছি। সুতরাং শুধু মজুরি বৃদ্ধিকেই উৎপাদন খরচ বাড়ার কারণ ভাবলে চলবে না।
দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের আগ্রহ বৃদ্ধির কারণ কী?
ঋণখেলাপির মাধ্যমে অর্থ আত্মাসৎ করার প্রক্রিয়াটি নতুন নয়। তবে বর্তমানে আত্মসাৎকারীর সংখ্যা ও অর্থের পরিমাণ দুটোই বেড়েছে। সৎ উপার্জনকারীদের জন্য এটি নিরুৎসাহজনক। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বৃদ্ধির পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ না করলে এ দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। ঋণখেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি বেশি দিন চললে কেউ আর বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন না। কেননা উচ্চসুদে নেয়া অর্থ এবং সহজলভ্য অর্থ একই বাজারে প্রতিযোগিতা করলে সহজে পাওয়া অর্থ বিনিয়োগ করলেই লাভ বেশি হবে, যেহেতু এ অর্থের জন্য কোনো সুদ দিতে হয় না। এখানে অসম প্রতিযোগিতা হচ্ছে।
আর বিদেশী বিনিয়োগের বিষয়ে বলতে চাই, আমাদের দেশের অবস্থা এমন হয়নি যে, এখানে বিনিয়োগের আর কোনো সুযোগ নেই, তাই দেশের বাইরে বিনিয়োগ করতে হবে। আমাদের ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ তো বাড়ছেই না। জিডিপির অংশ হিসেবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ ২৩ শতাংশের মধ্যে আটকে রয়েছে। তাদের কীভাবে দেশে বিনিয়োগে আগ্রহী করা যায়, সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগ হলে আমাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে। দেশের ভেতরে বিনিয়োগের ক্ষুধা থাকতে বিদেশে বিনিয়োগের আগ্রহের বিষয়টিকে সমর্থন করা যায় না। দেশে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে যে আস্থাহীনতা রয়েছে, তা দূর করা জরুরি।
সরকার কীভাবে রাজস্ব আয় আরো বাড়াতে পারে?
একদিকে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, অন্যদিকে কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। করযোগ্য ব্যক্তিদের করজালের আওতায় নিয়ে আসার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। সবার মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। কর দেয়ার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে কর দেয়া নিয়ে ভুল ধারণা ভাঙতে হবে। সৎ করদাতাদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। রাঘব বোয়াল ও ক্ষমতাশালীদের কাছ থেকে কর আদায় করা কষ্টকর। এদের কাছ থেকে কর আদায়ের জন্য যারা কাজ করছেন, তাদের প্রশাসন ও নীতিনির্ধারকদের পক্ষ থেকে নৈতিক সমর্থন দিতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে জনবল বৃদ্ধির পাশাপাশি কর আদায় ব্যবস্থায় প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ালে রাজস্ব আয় অনেক বাড়বে।
বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার মানদণ্ডগুলো পূরণ করেছে। উন্নয়নশীল দেশ হলে কী সুবিধা হবে?
বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক— এ তিনটি পূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে চলেছে। এটা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতারই পরিচায়ক। সুতরাং বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবেন। বিদেশী বিনিয়োগের সঙ্গে আসবে আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা। এতে আমাদের সক্ষমতা বাড়বে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমাদের ঋণমান বাড়বে। তখন আন্তর্জাতিক আর্থিক বাজার থেকে ঋণ নেয়ার সুযোগ বাড়বে। তবে সুযোগের পাশাপাশি যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে— শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা হারানো, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন— বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে স্বল্পসুদে ও দীর্ঘমেয়াদে ঋণ পাওয়া কিংবা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে স্বল্পোন্নত দেশের জন্য ওষুধের পেটেন্ট করার বর্ধিত সময়সীমা পাওয়ার মতো সুবিধাগুলো চলে যাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের এখন থেকেই তৈরি হতে হবে। সামগ্রিক অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানো, পণ্যের বহুমুখীকরণ, নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করা, সেবার মানোন্নয়ন, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তিগুলোয় সক্রিয় অংশগ্রহণ, প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন এবং সর্বোপরি সুশাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই সামনের দিনগুলোয় আমাদের টিকে থাকতে হবে।