ব্যক্তি খাতের আস্থাহীনতা কাটাতে হবে – মোস্তাফিজুর রহমান

Interview with Professor Mustafizur Rahman on FY2015 budgetary measures for stimulating private sector to enhance investment scenario and economic growth, published in Kaler Kantho on Sunday, 25 May 2014.

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বললেন
ব্যক্তি খাতের আস্থাহীনতা কাটাতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক

mustafizur-rahman-centre-for-policy-dialogue-cpd-executive-director

নির্বাচনের আগে টানা রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। সরকারের প্রতি আস্থাহীনতায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসছে না ব্যক্তি খাত। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বাজেটে সরকারকে এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে ব্যক্তি খাত সরকারের প্রতি আস্থা ফিরে পায়। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদক ফারজানা লাবনীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বিশেষভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হবে। এসব বিষয় গুরুত্ব দিয়েই আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নের সুপারিশ করেন তিনি

আগামী অর্থবছরে সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতির সামষ্টিক সূচক স্থিতিশীল রাখা। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে বিনিয়োগে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বাড়াতে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বিগত দিনের রাজনৈতিক অস্থিতায় দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়েছে। অর্থনীতিবহির্ভূত বিষয় অথচ অর্থনীতির ওপর প্রভাব বিস্তার করে- এমন বিষয়গুলো নজরে আনতে হবে।’

ব্যক্তি খাতের আস্থাহীনতা কাটাতে হবে

বাজেট প্রণয়নকারীদের সতর্ক করে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে গিয়ে বেহিসাবী প্রণোদনা এবং অপরিকল্পিত ভতুর্কি দেওয়া যাবে না। বরং নানা ধরনের নীতি সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষভাবে রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের সম্প্রসারণ, সম্ভাবনাময় ও কৌশলগত খাতে রাজস্ব ছাড় দিতে হবে। এ ছাড়া পরিবেশের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই সরকারকে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জিএসপি বাতিলের পর এখন নতুন কোনো ধাক্কা সামলানো অর্থনীতির জন্য কঠিন হবে। তাই গুণগতমানের বিনিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে। জোর দিতে হবে পিপিপিতে।’

পরিকল্পিত বিনিয়োগে রোডম্যাপ প্রণয়নের পরামর্শ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বাজেটেই তৈরি পোশাক শিল্পের প্রি-ফ্রেবিকেটেড কারখানা নির্মাণ যন্ত্রাংশ আমদানির ওপর সম্পূর্ণ শুল্ক মওকুফ করা প্রয়োজন। আবার সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্পও হুমকির মুখে। সাভারে ট্যানারিশিল্প স্থানান্তরে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করেন তিনি।

জ্বালানি ও সুবিধামতো জায়গার অভাবে বিপাকে আছেন উদ্যোক্তারা। জ্বালানি সমস্যার সমাধানে সরকারকে কয়লার প্রতি মনোযোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে বেসরকারি খাতের সমন্বয় ঘটাতে পারলে দ্রুত শিল্পপার্ক ও অর্থনৈতিক জোন নির্মাণ সম্ভব হবে। আবার অবকাঠামো নির্মাণ এবং যোগাযোগব্যবস্থার সংস্কারেও সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিনিয়োগের জন্য অতি জরুরি এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে এসব খাতে আগামী বাজেটে যথাযথ বরাদ্দ রাখতে হবে।’

রাজধানীর বাইরে শিল্প স্থাপনে সবাইকে উৎসাহী করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দেশব্যাপী সুষম শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে রাজধানীর বাইরে শিল্প স্থাপনে সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর বাইরে শিল্পপার্ক বা অর্থনৈতিক জোনে কম মূল্যে জায়গা দেওয়া, কারখানা নির্মাণ ও পরিচালনায় যন্ত্রপাতি আমদানিতে রাজস্ব ছাড়, কম সুদে ঋণ দেওয়াসহ নানা ধরনের সুবিধার নিশ্চয়তা থাকলে উদ্যোক্তারা ঢাকার বাইরেই বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। বাজেটে এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখেই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন তিনি।

প্রতিবছর ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাই বিদেশে অর্থপাচার রোধে আইনি কাঠামো আরো শক্তিশালী করার পরামর্শ দিয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে অর্থপাচার রোধে আইনি প্রয়োগে আরো কঠোর হতে হবে। বিগত দিনে ট্রান্সফার প্রাইজিং আইন প্রণয়ন করা হলেও তা প্রয়োগ না করায় আইন বাস্তবায়নকারীদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আগামী বাজেটে এ বিষয়গুলো বিবেচনায় কৌশল নির্ধারণে আইনি প্রয়োগে কঠোরতা আনতে হবে।

আগামী বাজেটে ভর্তুকি যাতে না বাড়ে সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ভর্তুকির চাপ কম রেখে প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করাই হবে আগামী বাজেটের বড় লক্ষ্য। তা ছাড়া আমদানির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উৎপাদন পর্যায়েও শুল্কহার একই রাখতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সহায়তায় আগামী বাজেটে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। বিশেষভাবে এ খাতের সুবিধায় টার্নওভার সীমা বাড়াতে হবে এবং মূসক মওকুফের আওতা বাড়াতে হবে। বর্তমানে যেসব খাতে কর অবকাশ সুবিধা রয়েছে, তা বহাল রাখতে হবে। প্রয়োজনে আরো নতুন খাত এ সুবিধার আওতায় যুক্ত করতে হবে। পোলট্রি খাতেওপ্রণোদনা বাড়াতে হবে।

প্রান্তিক কৃষকের সুবিধা নিশ্চিত করতে নানা উদ্যোগের কথা জানান সিপিডির কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ভালো বীজ, ন্যায্য দাম এবং কৃষিঋণের সরবরাহ বাড়াতে পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃষির ওপর শিল্পের নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তাই কৃষিতে সরকারের গুরুত্ব আরো বাড়াতে হবে। অচিরেই ‘কৃষি কমিশন’ গঠনের সুপারিশ জানান এ অর্থনীতিবিদ।

আগামী বাজেটে বিদেশি ঋণের জোগান বাড়াতে পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে মেস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাইপলাইনে থাকা ঋণ পেতে সরকারকে কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। এসব ঋণ না পেলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ কমে যাবে। এতে বেসরকারি খাত আরো বেকায়দায় পড়বে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। শুধু বরাদ্দ বাড়ালেই হবে না, যথাযথ ব্যয়ের ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে হবে।

তিনি বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং এনবিআরবহির্ভূত রাজস্ব আদায়ে এবারও বড় অঙ্কের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এনবিআরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ ৪৯ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার, যা পূরণ প্রায় অসম্ভব। করমুক্ত আয় সীমা বাড়ানোর এবং করপোরেট ট্যাক্স কমানোর কথা শোনা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এ দুই পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন নেই। বরং এ দুই উদ্যোগে রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। তাই রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সুষ্ঠু ও কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করার দিকে আগামী দিনে নজর দিতে হবে।

রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা পেতে বাজেট প্রণয়নের ধারাবাহিকতা থেকে বের হয়ে আসার পরামর্শ দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থনীতির চাহিদা বিবেচনায় রেখেই আগামী বাজেটে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয় পুনর্বিবেচনা করা উচিত।

বড় বাজেট বাস্তবায়নের সক্ষমতা প্রসঙ্গে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেট বাস্তবায়নে নানা কৌশল গ্রহণ করা হলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ বিষয়ে সতর্ক হতে হবে। রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা পেতে বড় অঙ্কের উদ্যোগ গ্রহণ করে হিসাব মেলানোর বাজেট গ্রহণে অর্থনীতির ভারসাম্য নষ্ট হবে।

এই গবেষক বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনীতির বহির্ভূত অনেক ইস্যু। গত প্রায় এক বছর এসব ইস্যুতে এ দেশের অর্থনীতির গতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। রাজনীতির অন্তঃকলহে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। দুর্নীতি-ঘুষ ও অপহরণ-হত্যাও বেড়েছে। এসব কারণে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়েছে। বেসরকারি খাত বিনিয়োগ থেকে পিছিয়ে আছে। এ বিষয়ে আসছে বাজেটে কৌশল নির্ধারণ অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ।