ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ ছাড়া উচ্চ কর লক্ষ্যমাত্রা টিকবে না – ফাহমিদা খাতুন

প্রয়োজন ৩৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি

Originally posted in নয়া দিগন্ত on 7 August 2025

রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের চাপে এনবিআর

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে বিশাল এক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেশি রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে রাজস্ব বোর্ডকে। গত অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ২৩ শতাংশ, সেখানে এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা।

এনবিআরের তিনটি প্রধান শাখা আয়কর, মূসক (মূল্য সংযোজন কর) এবং শুল্ক বিভাগ সবার জন্যই উল্লেখযোগ্য হারে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় আয়কর বিভাগকে ৪২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ভ্যাট শাখাকে ৩০ দশমিক ৪৯ শতাংশ এবং শুল্ক শাখাকে ২৯ শতাংশ বেশি আদায় করতে হবে।

তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য এনবিআরের মোট রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ দশমিক ৯৯ লাখ কোটি টাকা, যেখানে গত অর্থবছরে (২০২৪-২৫) মোট সংগ্রহ ছিল ৩ দশমিক ৭০ লাখ কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে রাজস্ব সংগ্রহে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ।

তথ্যে দেখা যায় ২০২৪-২৫ অর্থবছর এনবিআরকে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিনিয়োগ স্থবিরতা, এবং উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দেয়। অর্থবছরের শেষ মাস, জুনে, রাজস্ব সংগ্রহ নির্ধারিত মাসিক লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ কম হয়। এমনকি আগের বছরের জুনের তুলনায়ও আদায় ১৯ শতাংশ কম।

এনবিআর এর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত জুন মাসে দ্বিগুণ বা তিনগুণ রাজস্ব আদায় হতো, কিন্তু এবারে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে লক্ষ্য পূরণ হয়নি। তিনি আরো বলেন, এনবিআরের অভ্যন্তরে অসন্তোষ, আইনি সংস্কারের অনিশ্চয়তা এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের স্থবিরতা সব মিলিয়ে এই সঙ্কট তৈরি করেছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এত উচ্চ রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য বাস্তবসম্মত নয়। বরং এটি করদাতাদের ওপর অযথা চাপ সৃষ্টি করবে এবং হয়রানির ঝুঁকি বাড়াবে। তিনি বলেন, ব্যবসায়িক পরিবেশ এখনো পুরোপুরি স্থিতিশীল হয়নি। উৎপাদন খরচ বেড়েছে, মুনাফা কমেছে, ফলে কর পরিশোধের সক্ষমতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা নতুন করে চাপে পড়ছেন। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত শুল্ক নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশী পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চরম প্রতিযোগিতায় পড়ছে।

ড. ফাহমিদা আরো বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুনছি কর নীতি এবং কর প্রশাসন পৃথক করার পরিকল্পনার কথা। এটি ২০২৫ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ছিল, কিন্তু এখনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। কর নীতি ও প্রশাসন আলাদা না হওয়ায় একদিকে যেমন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বচ্ছতা আসছে না। অন্য দিকে কর কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার এবং করদাতাদের হয়রানি বেড়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি সতর্ক করেন যে, কর কর্মকর্তা ও রাজস্ব কর্মকর্তারা যেহেতু লক্ষ্যমাত্রা পূরণে তীব্র চাপের মধ্যে থাকবেন, তাই তারা বিদ্যমান করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবেন। এতে হয়রানি বাড়বে এবং রাজস্ব কাঠামোর প্রতি আস্থা কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

এ দিকে অর্থ উপদেষ্টা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, চলতি বছরের বাজেট বেশ রক্ষণশীলভাবে তৈরি করা হয়েছে। কম রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ব্যয়ের সীমা কমানো হয়েছে। এ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারি ব্যয় জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসবে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। উন্নয়ন বাজেটও বিগত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নির্ধারণ করা হয়েছে। ড. সালেহউদ্দিন মনে করেন, রাজস্ব ঘাটতি সাময়িকভাবে ব্যয় সঙ্কোচনের মাধ্যমে মোকাবেলা করা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি অর্থনীতির গতি কমিয়ে দিতে পারে।

এ দিকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতারা জানিয়েছেন, ব্যবসা-বাণিজ্য এখনো আগের গতিতে ফিরতে পারেনি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি, ডলার সঙ্কট ও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে। এর ফলে সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো সবাই আর্থিক চাপে রয়েছে। একজন ব্যবসায়ী নেতা জানান, আমাদের কোম্পানির লাভ ৩০ শতাংশ কমেছে, অথচ কর কর্মকর্তারা বলছেন কর দিতে হবে আগের চেয়ে বেশি। পরিস্থিতি যদি না বুঝে চাপ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে হয়রানির মাত্রা বাড়বে বলে তিনি মনে করেন।

২০২৫-২৬ অর্থবছরে এনবিআর-এর ৪ দশমিক ৯৯ লাখ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেশের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চতম। কিন্তু রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত দুর্বলতা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সংস্কারের স্থবিরতা লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি সরকার ও এনবিআর সময়মতো সংস্কার না আনে, কর প্রশাসনকে স্বচ্ছ না করে এবং করদাতাদের আস্থা পুনর্গঠন না করে, তবে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হবে।