Originally posted in সময়ের আলো on 3 January 2024
দেশের ব্যাংক খাত রীতিমতো ধুঁকছে। খাতটি এখন বহুমুখী সংকটে। তাই জনগণের আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে এ খাতের ওপর। পুরো ব্যাংক খাতেই এখন অতিমাত্রায় তারল্য সংকট চলছে। অধিকাংশ ব্যাংক গ্রাহকের আমানতের বিপরীতে নিরাপত্তা হিসেবে সিএলআর ও এসএলআর রক্ষা করতে পারছে না। ইসলামী ব্যাংকসহ শরিয়াহভিত্তিক পাঁচ ব্যাংকে আস্থা সংকট এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, অনেক আমানতকারীই টাকা তুলে নিচ্ছেন ব্যাংকগুলো থেকে। ডলার সংকটের মধ্যেই নির্ধারিত দরের চেয়ে বেশিতে ডলার বিক্রি করে প্রায় সব ব্যাংকে চলছে ডলারের ব্যবসা। এ কারণে ডলারের বাজার আরও অস্থির হচ্ছে। খেলাপি ঋণও দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছেছে।
সরকারি ট্রেজারিতে বিনিয়োগ বাড়ার ফলে ব্যাংকগুলোর আমানতে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলেও ঋণে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৪ শতাংশে উঠেছে। এতে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ২০ হাজার কোটি টাকা ধার দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। গত জুলাই থেকে ব্যাংক ঋণের সুদহারে নতুন নিয়ম চালু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সুদহার ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এতে হয়তো ব্যাংকগুলো এখন উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করতে পারছে, কিন্তু গ্রাহকের আস্থা ফেরানো যাচ্ছে না।
এদিকে ব্যাংক খাতের দৈন্যদশার চিত্র ফুটে উঠেছে সম্প্রতি সিপিডির দেওয়া তথ্যে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) বলেছে, ২০০৮ থেকে ২০২৩-এ ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাত থেকে ছোট-বড় ২৪টি অনিয়মের মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ব্যাংক খাত থেকে অনিয়মের মাধ্যমে বের করে নেওয়া এ অর্থ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশের বেশি। অথচ এ অর্থে অনায়াসে বাজেট ঘাটতি মেটানো সম্ভব হতো।
এ বিষয়ে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ব্যাংকিং খাত কিছুসংখ্যক ব্যক্তিস্বার্থের হাতে কুক্ষিগত হয়ে গেছে। এ কারণে সমস্যা আরও বাড়ছে। অথচ ব্যাংক খাতে নিয়মকানুনের কোনো অভাব নেই। দুর্বলতা আইনের প্রয়োগে। অনিয়ম করে যারা ঋণ নিচ্ছে তারা আবার পুনঃতফসিলসহ ব্যাংকের নানা নিয়মকানুন তৈরিতে সহায়তা করছে। তাই অর্থনীতির স্বার্থে ব্যাংক খাতকে শক্তিশালী করতে আমরা মনে করি খুব দ্রুত অস্থায়ী ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা দরকার।
এদিকে আরেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর ব্যাংক খাতের চলমান সংকট সম্পর্কে সময়ের আলোকে বলেন, ব্যাংক খাত এখন কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। এসব ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের মর্জিমাফিকই এখন ব্যাংক খাত চলছে। এভাবে দেশের ব্যাংক খাত চলতে পারে না। দ্রুতই ব্যাংক খাতের সংস্কার দরকার।
তিনি মনে করেন, সামনে জাতীয় নির্বাচন, এ জন্য হয়তো এদিকে সরকারের নজর কম। তবে নির্বাচনের পর ব্যাংক খাতের সংস্কার করে আর্থিক খাতে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতেই হবে। ডলারের দাম ও সুদহার বাজারভিত্তিক করা এবং অনিয়মে জড়িত ইসলামি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেওয়াই হবে অন্যতম প্রধান কাজ।
রেকর্ড খেলাপি ঋণ : চলতি বছরে খেলাপি ঋণের রেকর্ড তৈরি হয় দেশের ব্যাংক খাতে। চলতি বছরের জুন প্রান্তিক শেষে ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ। এ সময় পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৬৫৫ কোটি টাকা। এ ছাড়া আর্থিক হিসাবের সূচকে ঘাটতি দেখা দিয়েছে চলতি অর্থবছরে। দেশের ইতিহাসে এর আগে কখনো আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল না।
ডলার কিনে সামাল দেওয়ার চেষ্টা : আইএমএফের ঋণের শর্ত পূরণের জন্য ডলার কিনে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুদ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও বাজারে এখনও ডলার সংকট চলছে। ডলার বিক্রি করার মতো পরিস্থিতিতে নেই ব্যাংকগুলো। এরপরও কিছু ব্যাংক উচ্চমূল্যে প্রবাসী আয়ের ডলার কিনে তা আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে কম মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
ব্যাংকগুলো এখন ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা দামে প্রবাসী ও রফতানি আয়ের ডলার কিনছে। আর আমদানিকারকদের কাছে বিক্রির ক্ষেত্রে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম হচ্ছে ১১০ টাকা। তবে বেশিরভাগ ব্যাংক ১১০ টাকার বেশি নিচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে নিজেদের আড়াই শতাংশ প্রণোদনাসহ প্রতি ডলার কিনছে ১১২ টাকায়। আবার ইসলামি ও প্রচলিত ধারার কিছু ব্যাংক ১২৩ টাকা দামেও এ ডলার কিনছে। উচ্চমূল্যে কেনা ডলার তারা কম মূল্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বিক্রি করেছে।
রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও স্বস্তি আসেনি : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া ঋণের অর্থ এবং এডিসিহ আরও কিছু দাতা সংস্থার দেওয়া অর্থের কল্যাণে সম্প্রতি রিজার্ভ কিছুটা বাড়লেও এখনও স্বস্তি আসেনি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গত ৩০ নভেম্বর মোট রিজার্ভ ছিল ২৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার, যা আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম-৬ অনুযায়ী ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার। তবে ৭ ডিসেম্বর রিজার্ভ কমে ২৪ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে নামে, যা বিপিএম-৬ অনুযায়ী ১৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার। এরপর ১৪ ডিসেম্বর রিজার্ভ আরেকটু কমে হয় ২৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন, তবে বিপিএম-৬ অনুযায়ী এবার বেড়ে ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারে ওঠে। এরপর গত বুধবার রিজার্ভ বেড়ে হয় ২৬ দশমিক শূন্য ৪ বিলিয়ন এবং বিপিএম-৬ অনুযায়ী ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়।
শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের আমানতে ধাক্কা : ব্যাংকগুলোতে ইদানীং আমানত কিছুটা বাড়লেও পরিস্থিতি এখনও ভালো না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত জুনে ব্যাংকের বাইরে থাকা মুদ্রার পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে কমে হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৪৩ কোটি টাকা। ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে থাকা অর্থের পরিমাণ কমায় আমানত বেড়েছে ব্যাংকে। গত জুন মাসে ব্যাংকগুলোতে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৯৫ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা, যা অক্টোবরে বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। আর জুন মাসে ঋণ ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা, অক্টোবরে যা বেড়ে হয়েছে ১৬ লাখ ১ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ, তবে ওই মাসে ঋণে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ। যদিও গত জুলাই-অক্টোবর সময়ে ঋণের চেয়ে আমানত বেশি বেড়েছে। এ চার মাস সময়ে আমানত বাড়লেও সম্প্রতি শরিয়াহভিত্তিক কয়েকটি ব্যাংকে আবার চলতি হিসাবে ঘাটতি হয়েছে। আর এ খবর আলোচনায় আসার পর এসব ব্যাংকের আমানতে ধাক্কা লেগেছে।
সরকার ধারও নিচ্ছে বেশি : টাকা ছাপিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ার পর ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে ধার করে চলছে সরকার। ফলে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের সুদহার বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ১০ শতাংশ, ১৮২ দিন বিলের সুদহার ১১ দশমিক ২০ শতাংশ এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের সুদ বেড়ে হয়েছে ১১ দশমিক ৪০ শতাংশ। ব্যাংকগুলোতে ঋণের সুদ যেখানে সর্বোচ্চ সাড়ে ১১ শতাংশ, সেখানে একই সুদহারে টাকা ধার করছে সরকার। ফলে সুযোগ নিচ্ছে সবাই। ব্যাংকগুলোর পাশাপাশি এখন করপোরেট প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিও ট্রেজারি বিলে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংকের তারল্য সংকটে এটি বড় ভূমিকা রাখছে। সরকার এ সুদহারে গত রোববার ৯১ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকা, ১৮২ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ৪২৭ কোটি টাকা এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদি বিলের মাধ্যমে ১৪১ কোটি টাকা ধার করেছে।
ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলোর ব্যবসা : দেশের প্রায় সব ব্যাংকই এখন ডলার নিয়ে ব্যবসা করছে। আমদানিতে ডলারের নির্ধারিত দাম ১১০ টাকা। কিন্তু বাস্তবে এ দামে কোনো ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। গুনতে হচ্ছে ১২৩-১২৪ টাকা। কখনো ১৩০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। এভাবেই দেশের প্রায় সব ব্যাংকে চলছে ডলারের ব্যবসা। ব্যবসায়ীদের আমদানি দায় পরিশোধে ঘোষিত দামের চেয়ে বেশি দরে ডলার কিনতে হচ্ছে।
একইভাবে ঋণপত্র (এলসি) খোলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ব্যাংকের কাছ থেকে সুবিধা পেলেও সাধারণ ব্যবসায়ীদের অনেককেই ডলার সংকটের কারণে এলসি খুলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বেশ কিছু ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন অনেক গ্রাহক : আস্থাহীনতার কারণে এবং নানা রকম অনিশ্চয়তার ফলে অনেক গ্রাহক ব্যাংকে জমানো টাকা তুলে নিচ্ছেন। গত বছর যখন একটি শীর্ষ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকের ঋণ কেলেংকারির খবর বের হয় এবং একটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ ব্যাংকটি থেকে টাকা নিয়ে পাচার করেছে বলে খবর বের হয়-তখনও অনেক গ্রাহক ব্যাংকটি থেকে অর্থ তুলে নিতে শুরু করে। সম্প্রতি আবারও একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে কয়েক দিন আগে পাঁচ শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের খবর বের হলে আবার অনেক গ্রাহক খোঁজখবর নিতে থাকেন-এসব ব্যাংকে রাখা আমানত তুলে নেবেন কি না। অনেকেই আবার টাকা তুলেও নিয়েছেন।
ঢাকার মিরপুর মধ্যপাইকপাড়ার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম জানান, তার বাবার পেনশনের টাকা রাখা ছিল একটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকে। অনিশ্চয়তার কথা শোনার পর সে অর্থ তারা তুলে নিয়ে সরকারি ব্যাংকে রেখেছেন। তার মতো অনেকেই টাকা তুলে নিয়েছেন বলে জানা গেছে।