ব্যয় করার সক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধিই বড় বিষয় – ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য

Originally posted in সমকাল on 21 May 2021


অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো। তিনি বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের উদ্যোগে গঠিত এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক। এ ছাড়া তিনি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের এলডিসি সংক্রান্ত কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি বা সিডিপির অন্যতম সদস্য। এর বাইরে তিনি নানা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সমকাল: করোনা সংক্রমণের মধ্যে আরেকটি জাতীয় বাজেট আসছে। বাজেটের আগে মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটকে কীভাবে দেখছেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা চলছে। তৃতীয় ধাক্কা যে আসবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আমরা রয়েছি। করোনার প্রথম ধাক্কার পর অর্থনীতিতে পুনরুদ্ধার কিছুটা শুরু হয়েছিল। সিপিডি ও নাগরিক প্ল্যাটফর্মসহ বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, যারা কাজ হারিয়েছিলেন তাদের অনেকেই আবার কাজে ফিরলেও আয় কমে গেছে। কাউকে কাউকে আগের চেয়ে কম মজুরিতে বা কম দক্ষ কাজে যেতে হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব রয়ে গেছে। অতিমারি সমাজের পিছিয়ে পড়া বা অসুবিধাগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর ওপর বৈরী অনুপাতে আঘাত হেনেছে। তাদের পুষ্টিহীনতা বাড়ছে এবং স্ব্বাস্থ্যঝুঁকি তো রয়েই গেছে। পাশাপাশি তাদের ঋণগ্রস্ততা বাড়ছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া বাড়ছে এবং সামাজিক বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার মধ্যে পড়ছেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ভেতরে বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে।

সমকাল: সামষ্টিক অর্থনীতির কোন অবস্থায় সরকার নতুন বাজেট দিতে যাচ্ছে? সাম্প্রতিক সময়ে বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতি কেমন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এ মুহূর্তে সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থিতিশীলতা বিরাজমান। মূল্যস্ম্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যদিও খাদ্য মূল্যস্ম্ফীতি ইদানীং কিছুটা বেড়েছে। বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খুব শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রয়েছে। অন্যদিকে বাজেট ঘাটতিও প্রাক্কলনের চেয়ে কম আছে। সমস্যা দেখা যাচ্ছে সরকারের আয় ও ব্যয়ে। গত বাজটে যে প্রাক্কলন ছিল, সে তুলনায় আয় ও ব্যয় অনেক পিছিয়ে আছে।

আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত খুবই কম এবং গত বছর তা কমে গেছে। বাংলাদেশ একটি অদ্ভুত দেশ, যেখানে ৬ থেকে ৭ শতাংশের বেশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয় অথচ কর-জিডিপি অনুপাতের পতন ঘটে। গত অর্থবছরে কর-জিডিপি অনুপাত ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৪১ শতাংশে নেমেছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে কর আদায় হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার মাত্র অর্ধেক এবং বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩ শতাংশ। যদি ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরেন এবং ৫ শতাংশ মূল্যস্ম্ফীতি ধরেন, তাহলে একই অবস্থায় থাকতে হলে কর আদায় অন্তত ১০ শতাংশ বাড়াতে হবে।

ব্যয়ের ক্ষেত্রে আরও অদ্ভুত পরিস্থিতি। বাংলাদেশের সাম্প্রতিকতম ইতিহাসে ব্যয়ের হার এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়। গত অর্থবছরে যা নেমে গেছে ১৪ দশমিক ৫ শতাংশে। চলতি অর্থবছরে কর আদায়ের হারও পড়ে গেছে, ব্যয়ও পড়ে গেছে। ৯ মাসে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ কম ব্যয় হয়েছে। মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪২ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে। এদিকে, বাজেটের ঘাটতি মেটাতে সরকার বৈদেশিক সহায়তা ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছে না। সঞ্চয়পত্রের মতো দামি উৎস থেকে ঘাটতি মেটানো হচ্ছে, যা সরকারের ঋণের সুদ বাবদ খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সমকাল: অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে তাহলে পরিকল্পনা কেমন হওয়া উচিত?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: একটা মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর আমি জোর দিতে চাই। গত বাজেটের আগে যখন মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজনীতার কথা বলেছিলাম, তখন সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটিকে ব্যঙ্গাত্মকভাবে নিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, সেপ্টেম্ব্বর নাগাদ বাংলাদেশ আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে। এখন আরেকটি বাজেট চলে এসেছে এবং আমরা আরেকটি শীর্ষ ধাক্কার অতিমারির মধ্যে জীবনযাপন করছি। আবার যদি আগের মতো অনীহা ও অস্ব্বীকারের মনোভাব থাকে, তাহলে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হবে।

আগামী দিনে পুনরুজ্জীবনের জন্য চারটি বড় এলাকায় দৃষ্টি দিতে হবে। প্রথমত- ব্যক্তি পর্যায়ে ভোগ বাড়াতে হবে। যদি মানুষের ভোগ কমে যায় তাহলে পুষ্টিহীনতা থেকে শুরু করে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ওপর তার প্রভাব পড়বে। এর ফলে দারিদ্র্য ও বৈষম্য বাড়বে। দ্বিতীয়ত- বিশেষ করে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ যদি না বাড়ে তাহলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হবে। তৃতীয়ত- সরকারি ব্যয় বাড়াতে হবে গুণমান সহকারে। চতুর্থত- প্রকৃত বা নিট রপ্তানি বাড়াতে হবে। আমদানি করা কাঁচামালনির্ভর রপ্তানিতে দেশজ মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বাড়াতে হবে।

আমি মনে করি, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দুই থেকে তিন বছরের একটি নীতি কাঠামো নিয়ে চিন্তা করা উচিত। ধারাবাহিকতার দিক থেকে এবং নীতির প্রতি আস্থার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক বছরের বাজেট চিন্তা উপকারী নয়। সে ক্ষেত্রে দুই থেকে তিন বছরের কাঠামোতে একটি ভিত্তি বাজেট করা বাঞ্ছনীয়। পুনরুজ্জীবনের পদক্ষেপগুলোর সঙ্গে কাঠামোগত সংস্কারকে যুক্ত করতে হবে। শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। নতুন নতুন ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিনিয়োগ করতে হবে। দক্ষতা বাড়িয়ে নারীদের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। যুব সমাজের বিশেষ করে তার শিক্ষিত অংশের বাজারভিত্তিক কর্মসংস্থানের জন্য বাজেটে উদ্ভাবনী চিন্তা থাকতে হবে। রপ্তানি পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। নতুন রপ্তানি বাজারে যেতে হবে। বেশিরভাগ মানুষ এখন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে এবং তা কভিডের কারণে বেড়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে বের হতে হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হলো, সরকারের পক্ষ থেকে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা বাড়াতে হবে। এটি যদি না করা যায়, তাহলে ভোগ ও জীবনের মানের বিষয়ে গুরুতর ব্যত্যয় ঘটবে এবং বৈষম্যের পরিমাণ আরও বেড়ে যাবে এবং যা প্রকারান্তরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমস্যাসংকুল করে তুলবে।

সমকাল: এমন প্রেক্ষাপটে আর্থিক ব্যবস্থাপনার নীতিভঙ্গি কী হওয়া উচিত?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই মুহূর্তে লকডাউনসহ নানা কারণে একটা মন্দা পরিস্থিতি রয়েছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শ্নথ হয়ে গেছে। এ কারণে চক্রের বিপরীতে একটি নীতিভঙ্গি নিতে হবে। চক্রের বিপরীতে যেতে হলে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক ব্যবস্থাপনায় যেতে হবে। অর্থাৎ সরকারের ব্যয় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে তারল্য সঞ্চালন দুটোই বাড়াতে হবে। তারল্য বাড়ালে অনেক সময় মূল্যস্ম্ফীতি হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে বাংলাদেশে মূল্যস্ম্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। সরকারের ব্যয় বাড়ালে দায়দেনা বেড়ে যায়। আমাদের দায়দেনা একটু একটু করে বাড়লেও তাও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। বৈদেশিক সহায়তা বেশি নিতে গেলে অনেক সময় বিনিময় হারের ওপর চাপ পড়ে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ অনেক ভালো অবস্থায় থাকার কারণে সে ক্ষেত্রেও তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ব্যয় বাড়ালে বাজেট ঘাটতি বেড়ে যেতে পারে। তবে এ মুহূর্তে বাজেট ঘাটতি অনেক কম আছে। সে ক্ষেত্রে ঘাটতি বাড়লে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সব মিলিয়ে সম্প্রসারণমূলক আর্থিক নীতিভঙ্গিতে যাওয়ার জন্য অনুকূল পরিস্থিতি রয়েছে।

সমকাল: ব্যয় বাড়াতে হলে তো আয় বাড়াতে হবে। কিন্তু করদাতারা তো করোনার কারণে অসুবিধার মধ্যে আছেন। তাহলে আয় বাড়বে কীভাবে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আগামী অর্থবছরের বাজেটে নতুন করে কোনো কর আরোপ করা উচিত হবে না। করের হারও বাড়ানো উচিত হবে না। কারণ এই মুহূর্তে মানুষ ব্যাপকভাবে আর্থিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। তাই প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করেই কর আহরণ বাড়াতে হবে। তাছাড়া যেসব জায়গায় ফাঁক-ফোকর আছে অর্থাৎ যারা কর দেয় না এবং যারা কম কর দেয়- সেই জায়গায় নজর দিতে হবে। এ ছাড়া বিভিন্ন রেয়াত দেওয়া আছে, যার কোনো অর্থনৈতিক যৌক্তিকতা নেই। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে এসব রেয়াত দেওয়া হয়। আগামী অর্থবছরে এ প্রবণতা বাদ দিতে হবে।

সমকাল: কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থেকে রাজস্ব আয় বাড়ছে বলা হচ্ছে। এ সুযোগ কি রাখা উচিত মনে করেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অবশ্যই নয়। এ সুযোগ অর্থনৈতিকভাবে যুক্তিহীন, নৈতিকভাবে গর্হিত এবং রাজনৈতিকভাবে উপকারী নয়। একই সঙ্গে সাম্য পরিপন্থি। সর্বোপরি বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের যে সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। এর ফলে সৎ করদাতারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। করদাতাদের একটি অংশ ভবিষ্যতে কম করের সুযোগ পাওয়া যাবে ভেবে অর্থ প্রদর্শিত রাখছেন। ফলে কালো টাকার সুযোগ দেওয়ার ফলে বর্তমান কর আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না যে, কালো টাকার মালিকরা উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ করছেন। বেশিরভাগই আবাসন খাতে গেছে। কিছু গেছে পুঁঁজিবাজারে।

সমকাল: কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যয় বাড়ালে অর্থনীতি এই মুহূর্তে বেশি লাভ পেতে পারে?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: যে সমস্ত জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক খরচ করার প্রবণতা বেশি- যেমন দরিদ্র পরিবারগুলো, তাদের প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা বেশি করে দিতে হবে। কেননা, টাকা পেলেই তারা খরচ করবে ভোগে। এই মুহূর্তে অর্থনীতিতে ভোগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রান্তিক- যারা টাকা পেলেই ব্যবসার কাজে লাগাবে, তাদের প্রত্যক্ষ সহায়তা দিতে হবে। ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হাতে টাকা দিতে হবে। কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে হবে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে তারল্য সহায়তা দিতে হবে। স্থানীয় বাজারনির্ভর শিল্প খাতে কার্যকর সুবিধা দিতে হবে। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে শ্রমঘন শিল্প- অভ্যন্তরীণ বাজারের জন্য উৎপাদন করে তাদের জন্য সহায়তা বাড়াতে হবে। এই মুহূর্তে তাদের জন্য সরকারের সাহায্য-সহযোগিতা যতটুকু আছে, তা যথেষ্ট ও প্রকাশ্য নয়। যতটুকু রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য হিসাব ও অনুমিতি প্রকাশ্যে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পের জন্য তা হয় না। এখানে মনোযোগ দিতে হবে।

সমকাল: করোনাকালে প্রত্যক্ষ সহায়তার মাত্রা খুব কম বলে আপনি সম্প্রতি নাগরিক প্ল্যাটফর্মের এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে আলোকপাত করেছেন। এ বিষয়ে একটু ব্যাখ্যা করবেন?

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: সরকার গত দেড় বছরে প্রায় ২৫টি কর্মসূচি নেওয়ার কথা বলেছে। ১৯টি নতুন এবং ৬টি পুরোনো কর্মসূচির সম্প্রসারণ। তবে ১১টি কর্মসূচি হাইব্রিড। অর্থাৎ ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে সহায়তা প্রত্যক্ষ নয়, এটি সহজ শর্তে ঋণ। খাদ্য সহায়তাসহ প্রত্যক্ষ সহায়তা মোটের ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা ছিল জিডিপির মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। আর্থিক সহায়তা ২০২০-২১ বছরে বেড়ে জিডিপির শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ হওয়ার কথা। এটা দেখে প্রথমে উৎসাহিত হয়েছিলাম কিন্তু পরক্ষণেই উৎসাহ থাকেনি। কারণ এর ভেতরে সরকার এমন কিছু কর্মসূচি ঢুকিয়েছে, যা আদতে কভিডের সঙ্গে জড়িত নয়। যেমন ধান-চাল সংগ্রহের খরচকে এই সহায়তার তালিকার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার কৃষিতে যে ভর্তুকি দেয়, তাকেও এই তালিকার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের জন্য একটা বড় অঙ্কের বরাদ্দ করেছে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে গরিব মানুষকে যে ঘরবাড়ি দেওয়া হয়েছে, তাও এর মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দুস্থ মানুষের জন্য কভিডের প্রেক্ষিতে নিট আর্থিক সহায়তা অনেক কম।

শুধু আর্থিক সহায়তা কম দেওয়া হয়েছে তা নয়, যা বরাদ্দ হয়েছে তাও সব খরচ করতে পারেনি। আড়াই হাজার কোটি টাকার বিনামূল্যে খাদ্য বিতরণের মাত্র ৪৩ শতাংশ বাস্তবায়িত হয়েছে। ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে আড়াই হাজার করে নগদ টাকা দেওয়ার কর্মসূচিও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

সুতরাং সরকার যে আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, তার মধ্যে পুরোনো কর্মসূচি দিয়ে স্টম্ফীত করা হচ্ছে। প্রকৃত আর্থিক সহায়তা তুলনামূলকভাবে অনেক কম এবং যেটুকু বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তাও বিতরণের ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণতা রয়েছে। গত বছর আমরা আলোচনা করেছি, টাকা-পয়সা আছে কিনা, দেওয়া যাবে কিনা। এ বছরে চিন্তা টাকার লভ্যতা নয়, টাকা খরচ করার যোগ্যতা ও দক্ষতা। খরচ করা না গেলে পিছিয়ে  পড়া মানুষগুলোর দৈন্য, অভাবগ্রস্ততা ও ঋণগ্রস্ততা বাড়বে।

সরকারের পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য তিন স্তরের কমিটি গঠন করা হবে বলে পড়েছি। শুধু সরকারের পরীবিক্ষণ কমিটি দিয়ে বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করা যাবে না। কারণ, এর গভীরে গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও কাঠামোগত সংস্কার বাস্তবায়ন করা লাগবে এবং নীতি ও মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। সরকারি কর্মসূচি বাস্তবায়ন ও ফলাফল মূল্যায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণ, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এবং ব্যক্তি খাতকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশে আমরা এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছি, যেখানে এই দুর্যোগকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগাতে হবে। আগামী বাজেট সেই ধরনের সাহসিকতা, সেই ধরনের দূরদর্শিতা এবং সেই ধরনের উদ্ভাবনী ব্যবস্থা নিতে পারবে বলে প্রত্যাশা করছি।

সমকাল: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।