Originally posted in সমকাল on 24 May 2021
কভিডের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট ব্যবস্থাপনা সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ ছিল। কভিডের কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হয়, ধরে নেওয়া হয়েছিল কভিডের মধ্যে প্রত্যাশিত পরিমাণে রাজস্ব আদায় হবে না। এ চ্যালেঞ্জ শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক ছিল না, বরং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জও ছিল বটে। বাংলাদেশের জন্য এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছিল, কারণ আমাদের ঘাটতি বাজেট সাধারণত বৈদেশিক ঋণ ও সহযোগিতা থেকে পূরণ করা হয়। কিন্তু কভিডের সময়ে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট সৃষ্টি হওয়ায় বৈদেশিক সহায়তা প্রত্যাশিত মাত্রায় পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় ছিল। তখন সুশীল সমাজসহ বিভিন্ন পক্ষ থেকে বাজেট প্রস্তাবনায় ব্যয় সংকোচন করে কীভাবে বাজেট ঘাটতি পূরণ করা যায় সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়। সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।
সেই জায়গা থেকে গত বছর সিপিডির পক্ষ থেকে বাজেট প্রসঙ্গে কিছু প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু ছিল রাজস্ব খাতে ব্যয় সংকোচন, আর কিছু ছিল উন্নয়ন খাতে ব্যয় সংকোচন। সাধারণত বলা হয়ে থাকে রাজস্ব খাতে ব্যয় সংকোচনের সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষের ভেতর এমনকি সরকারের ভেতরেও এরকম একটি ধারণা আছে। আমরা বলেছিলাম- রাজস্ব খাতে বেশ কিছু উপখাত আছে, যেগুলোতে ব্যয় কমিয়ে আনা যেতে পারে। প্রতি বাজেটে দেখা যায় সরকার বিভিন্ন ধরনের সম্পদ অধিগ্রহণ, আইসিবির মাধ্যমে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানে বড় বিনিয়োগ করে। এ তিন খাতে যে বিনিয়োগ করা হয় কার্যত এগুলো কোনো বিনিয়োগ নয়।
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন-ভাতাদির জন্য সরকার বিনিয়োগ করে। এ অর্থ ঋণ আকারে দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, এ প্রতিষ্ঠানগুলো বড় হবে, লাভজনক অবস্থানে যাবে, সরকারকে রাজস্ব দেবে এবং ঋণের টাকা উঠে আসবে। প্রকৃতপক্ষে এসব প্রতিষ্ঠান বরাবরই সরকারি অর্থে তাদের ব্যয় নির্বাহ করে আসছে। আমরা বলেছিলাম, এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ বন্ধ করে ব্যয় সংকোচন করা যায় কিনা। পরবর্তীকালে সরকার পাটকল ও চিনিকলগুলো বন্ধ রাখার উদ্যোগ নেয়। এর ফলে গত বছর এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে সরকারকে বিনিয়োগ করতে হয়নি। এতে ব্যয় কমেছে। ঠিক একইভাবে সরকার আইসিবির মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে থাকে। ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার সেখানে সীমিত আকারে বিনিয়োগ করে ব্যয় কমিয়েছে। এ ছাড়া এই সময়ে সম্পদ অধিগ্রহণও কম হয়েছে। আমরা এই ব্যয়গুলো চিহ্নিত করেছিলাম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে।
আমরা বিদেশ ভ্রমণ কমিয়ে আনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছিলাম। ইতোমধ্যে বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদনের জন্য গেলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় বিদেশ ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক প্রকল্প প্রস্তাবনা ফেরত দিয়েছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো- করোনাকালেও বিভিন্ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় নামে-বেনামে বিদেশ ভ্রমণের বিষয়টি রাখা হচ্ছে। কোনো সন্দেহ নেই সরকার ব্যয় সংকোচনের ব্যাপারে সচেতনভাবে চেষ্টা করছে, কিন্তু সরকারের ভেতরেই যারা এসব প্রকল্প তৈরি করছেন তাদের অনেকের মধ্যে আগের ব্যয়টি রেখে দেওয়ার প্রবণতা আছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ব্যয় সংকোচনের বড় উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়। গত বছর সরকার এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্পের প্রাধাকীকরণ করেছিল। অর্থাৎ অধিক গুরুত্বপূর্ণ, মধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ও অল্প গুরুত্বপূর্ণ- এ রকম তিনটি শ্রেণিতে প্রকল্পগুলোকে বিন্যস্ত করতে প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী প্রকল্পের প্রাধাকীকরণ করা হয় এবং অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে, এই সময়ে যে কাজটি সরকার ভালোভাবে করতে পারত বা যে কাজটি হয়নি তা হলো- বড় বড় অবকাঠামো খাতে যেখানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল, সেখানে পর্যাপ্ত মাত্রায় অর্থ ব্যয় হয়নি। এসব খাতে অধিক অর্থ বরাদ্দ দেওয়ায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ অন্য কিছু খাতে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। একদিকে ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দের পরও তা ব্যয় না করার ব্যর্থতাও রয়েছে। যা সরকারের ব্যয় কাঠামো যথাযথভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে অদক্ষতাকে ইঙ্গিত করে। কভিড সংকটকালে এ অদক্ষতাকে মেনে নেওয়া যায় না।
কিছু খাতে ব্যয় বেশি দেখানোর ফলে সরকারের ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু খাত যেমন- স্বাস্থ্য, কৃষি, সামাজিক সুরক্ষা, কর্মসংস্থানমূলক খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া যায়নি। সরকার স্বাস্থ্য খাতের সব প্রকল্প অধিক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে স্বাস্থ্য খাত বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারেনি। গত দশ মাসে স্বাস্থ্যসেবা খাতে মোট বরাদ্দের মাত্র ২১ শতাংশ ব্যয় হয়েছে। অথচ এ সময়ে বাজেট বাস্তবায়নের জাতীয় গড়ই ছিল ৪২ শতাংশ। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, স্বাস্থ্য খাতে জাতীয় গড়েরও দ্বিগুণ ব্যয় হবে। বিগত সময়ে স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক ঘাটতি ও দুর্গতি নিয়ে সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক প্রতিবেদন উঠে এসেছে। আমরা বলেছি গুরুত্বপূর্ণ খাতে যেন সরকার পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়, সরকারও প্রাধিকার দিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন এ সুযোগ ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারেনি। ব্যয় সংকোচন ও বাজেট বাস্তবায়নের বিষয়টি সামগ্রিকভাবে শুধু অর্থ ছাড় বা অর্থ কাটছাঁটের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ অর্থ যারা ব্যবহার করছেন তাদের দক্ষতা-অদক্ষতাও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। উপরন্তু আমরা স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য উঠে আসতে দেখেছি। আমাদের দুর্ভাগ্য হলো- যে খাতকে প্রাধিকার দেওয়া হলো, সে খাত বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারছে না, আবার যতটুকু করছে তার মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতি বিদ্যমান।
আমরা বলেছিলাম, নামসর্বস্ব প্রকল্পে সরকার যেন বরাদ্দ না করে। অনেক সময় রাজনৈতিক চাপে বা বিভিন্ন কারণে প্রচুর সংখ্যক প্রকল্প ছাড় দেওয়া হয়। এই অর্থগুলো কোনো কাজে লাগে না, স্পষ্ট অপচয়। গত বছর ৬৪টি এমন প্রকল্প ছিল যেগুলোতে মাত্র এক লাখ টাকা করে বরাদ্দ ছিল। আমরা জানি না এই টাকাগুলো কোন কাজে ব্যয় হয়। যেসব প্রকল্প এ বছরই শেষ হওয়ার মতো ছিল সেগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে যেন বরাদ্দ বাড়ানো হয় সে ব্যাপারে পরামর্শ ছিল। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।
গত বছর ব্যয় সংকোচনের ক্ষেত্রে সরকারের এক ধরনের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছিল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু উদ্যোগও আমরা দেখেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার সফলও হয়েছে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে ব্যয় সংকোচন হয়নি। ব্যয় সংকোচনের কাঠামো আগামী অর্থবছরের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। ব্যয়ের ক্ষেত্রে প্রাধিকারকেন্দ্রিক যে বিভাজন ছিল তা আগামী অর্থবছরেও সরকার কার্যকর রাখতে পারে। আগামী অর্থবছরে প্রাধিকারে স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকার প্রাধিকার দিতে পারে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে গত বছর সিপিডির যেসব পরামর্শ ছিল, সরকার যেন আগামী অর্থবছরেও এসব পরামর্শ বিবেচনায় রাখে। বিভিন্ন খাতে যে প্রণোদনা দেওয়া হয় এই প্রণোদনা কাঠামোর সুস্পষ্ট পর্যালোচনা দরকার। কারণ, এই কাঠামোর অধীনে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, সেই তুলনায় এই খাতগুলো উন্নত হচ্ছে- এমনটি লক্ষ্য করা যায় না। এই অর্থ যদি উপযুক্তভাবে বিশ্নেষণ করে অন্যান্য খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে সংকটকালে বেশি পরিমাণ রিটার্ন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি প্রকল্প গ্রহণ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন পর্যন্ত তিন স্তরবিশিষ্ট একটি প্রকল্প মূল্যায়ন কাঠামো কার্যকর রাখার ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে অবগত করা হয়েছে। আমরা মনে করি, আগামী বাজেটে এ-সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট কাঠামো উপস্থাপন করা হবে, যেখানে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেওয়া, প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং কীভাবে দুর্নীতি রোধ করা যাবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকবে। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে ধরনের মনিটরিং, অ্যাকাউন্টিবিলিটি এবং ট্রান্সপারেন্সি সিস্টেম ব্যবহার করে, সে ধরনের গ্রহণযোগ্য কোনো আন্তর্জাতিক মনিটরিং সিস্টেম আমাদের দেশে চালু করা আবশ্যক।
মোট কথা, ব্যয় সংকোচনের বিষয়টিকে আগামী দিনে প্রাধিকার দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে শুধু অর্থ ছাড়করণ কমানোর বিষয়টিই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং যেসব উদ্যোগে অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে তা উপযুক্তভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা, যে হিসাব মতে অর্থ নেওয়া হচ্ছে সে হিসাবগুলো যৌক্তিক কিনা যে সময়কালের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তা নির্ধারিত সময়কালের মধ্যে শেষ হচ্ছে কিনা, যারা এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত তারা পুরোপুরি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনুসরণ করছে কিনা, এর মধ্যে কোনো অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি আছে কিনা, সে বিষয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের আগামী দিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত।
গবেষণা পরিচালক, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)