Originally posted in দেশ রূপান্তর on 6 June 2021
সাক্ষাৎকার : বাজেট ২০২১-২০২২
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর সম্মাননীয় ফেলো। বহু বছর ধরে তিনি বাজেট পর্যালোচনা করে আসছেন। ২০২১-২২ জাতীয় অর্থবছরের বাজেট, করোনাকালের অর্থনীতিসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়াবলি নিয়ে দেশ রূপান্তরের সঙ্গে কথা বলেছেন এই অর্থনীতিবিদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেশ রূপান্তর সম্পাদকীয় বিভাগের এহ্সান মাহমুদ
দেশ রূপান্তর: ‘জীবন-জীবিকায় প্রধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে। এই বাজেটটি বাংলাদেশের ৫০তম বাজেট। একইসঙ্গে এবার দেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করল। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতেও এসব বিষয়ে উঠে এসেছে। আগামীর বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে যে বাজেট প্রস্তাব করা হলো, সেটি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ যে ৫০তম বাজেট পাস করতে যাচ্ছে, এটা নিঃসন্দেহে আনন্দের ও গর্বের বিষয়। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, যেহেতু এটা বাজেট, তাই বলতে হচ্ছে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে বাজেট দিয়েছিলেন, সেটিতেও দেশজ আয়ের ১৫ শতাংশ ছিল। ৫০ বছর পরেও আমরা সেই ১৫ শতাংশেই আছি। টাকার অংকে বাজেট বড় হয়েছে। কিন্তু, অর্থনৈতিক আয়তনের অনুপাতে বাজেট বাড়েনি। বর্তমান সরকার ১৭-১৯ শতাংশ পর্যন্ত খরচ করার ব্যাপারে বাজেটে অঙ্গীকার রাখলেও বাস্তবে তা পূরণ করতে পারছে না। এটা আমার একটি বড় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়। আর দ্বিতীয় যেটি, বাজেটে জীবন-জীবিকার কথা বলা হয়েছে, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। বর্তমানে যে মহামারী পরবর্তী বাস্তবতা আছে দারিদ্র্য বেড়েছে, বৈষম্য বেড়েছে, কর্মসংস্থানের সুযোগ কমেছে, লোকের আয় কমেছে, পুষ্টিহীনতা বেড়েছে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া বেড়েছে এই সমস্ত বহুবিধ যে নেতিবাচক পরিস্থিতি রয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণের বিষয়টি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে আমি খুব একটা দেখিনি। নতুন যে দরিদ্র সৃষ্টি হয়েছে, নতুন করে বৈষম্য বেড়েছে এসবের কোনো স্বীকৃতি তার বক্তৃতায় ছিল না। এটা দুঃখের বিষয়।
দেশ রূপান্তর: বাজেট বাস্তবায়নে সমস্যা কী বলে মনে করেন?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: এই মুহূর্তে সরকারের জন্য সম্পদের স্বল্পতা কোনো সমস্যা নয়। সমস্যা হচ্ছে সরকার যে উন্নয়ন বিনিয়োগের কথা বলে সেটি কার্যকর করতে না পারাটাই সমস্যা। এটা ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে। ৫০ শতাংশের মতো বাস্তবায়িত হয়েছে প্রথম ৯-১০ মাসে। তাই এই বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে। এখানে কেবল টাকার অংকই নয়। কারণ, বিগত বছরগুলোতে আমরা দেখেছি, টাকার অংক কীভাবে বেড়ে যায়। দশ টাকার জিনিস হাজার টাকায় কেনা হয়। সরকারের ক্রয়ের ভেতরে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। প্রায়ই দেখা যায় স্ফীত হচ্ছে প্রকল্প ব্যয়। যে প্রকল্প পাঁচ বছরে শেষ হওয়ার কথা সেটি পনেরো-কুড়ি বছরেও শেষ হচ্ছে না। এই কারণেও প্রকল্প ব্যয় বাড়ছে। তৃতীয়ত, প্রকল্পটি যে এলাকায় হওয়ার কথা ছিল, স্থানীয় জনগোষ্ঠী যারা রয়েছেন, তারা প্রকল্পের মাধ্যমে উপকৃত হলেন কি না এটা মূল্যায়িত হওয়া দরকার। আমি মনে করি, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কিছু সংস্কারের দরকার আছে। তারচেয়েও বেশি জরুরি, প্রকল্পগুলো যে অঞ্চলে বাস্তবায়িত হবে সেখানকার নাগরিকদের জড়িত করতে হবে। যাতে তারা নিশ্চিত করতে পারেন যে প্রকল্পটি ভালোভাবে হচ্ছে। নইলে আমরা দেখব যে, লোহার রডের বদলে বাঁশ ব্যবহার করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়ি দুদিনে ভেঙে পড়বে। দেখা যাবে, স্বাস্থ্যসেবায় ডাক্তার থাকবে না, ওষুধ থাকবে না। প্রতিটি উন্নয়ন কাজে জনগণের কণ্ঠস্বরকে যুক্ত করতে হবে।
দেশ রূপান্তর: বাজেট প্রস্তাবে মধ্যবিত্ত উপেক্ষিত বলে সমালোচনা আছে। এ বিষয়ে আপনার মতামত কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আমি মনে করি, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ যে অবস্থায় আছে, তাতে সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল গত দশ বছরে দেশে নতুন মধ্যবিত্ত তৈরি হওয়া। একটি বিকাশমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি দেশে তৈরি হয়েছিল। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হচ্ছে সরকার বর্তমান বাজেটে নিজের সৃষ্ট সবচেয়ে বড় সুফলকে অবজ্ঞা করে গেছে। তারা নব্য দরিদ্রে পরিণত হয়েছে। এই নব্য দরিদ্র যাদের আয় কমেছে, কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে, গ্রামে ফিরে গেছে, গ্রাম থেকে ফিরে তুলনামূলক কম আয়ের চাকরি করছে তাদের জন্য বাজেটে কিছু রাখা হয়নি। ব্যাপকহারে প্রচ্ছন্ন বেকারত্ব আছে তাদের মধ্যে। সরকার এদের জন্য তেমন কিছু রাখেনি। সরকার বাজেট রেখেছে উচ্চআয়ের লোকদের জন্য। কর ছাড় পেয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে যারা কর দিয়ে থাকেন, তারা কোনো ছাড় পাননি। যারা বছরে ৩ লাখ টাকার ওপরে আয় করেন, অর্থাৎ মাসে ২৫ হাজার টাকার ওপরে যারা আয় করেন তাদের জন্য কোনো ছাড় রাখা হয়নি। মধ্যবিত্ত আয়করের দিক দিয়ে কোনো সুযোগ পায়নি। করোনার এই সময়ে তাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় বেড়েছে, শিক্ষার ক্ষেত্রেও তারা কোনো ছাড় পায়নি। তাই মধ্যবিত্ত আয়করের দিক দিয়ে কোনো সুযোগ পায়নি। তাই আমি মনে করি, তাদের ক্ষেত্রে এসব বিবেচনায় করছাড়ের ব্যবস্থা করা যেত। সামাজিক সুরক্ষা খাতের যে বরাদ্দ রয়েছে, সেখানে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্তদের জন্য কিছু নেই। যেমন নেই শিক্ষিত যুবকদের জন্য। তাদের জন্য প্রত্যক্ষ আর্থিক সহায়তা, তাদের তালিকা প্রস্তুত করা গত এক বছরে এসব হতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। যেহেতু কোনো ডাটাবেজ তৈরি করা হয়নি, তাই সরকার এখন যেসব সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করছে, তাতের সমস্যা থেকে যাচ্ছে। এই শ্রেণির যারা তারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে কাজ করে, তাদের জন্য কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তারা যাতে সহজে ঋণ সুবিধা বা প্রণোদনার মধ্যে থাকে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি মনে করি, বাজেট প্রস্তাবে সরকারের ভাবনায় মধ্যবিত্ত ছিল না।
দেশ রূপান্তর: করোনায় শিক্ষাব্যবস্থায় অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে। শিক্ষায় বরাদ্দ যথেষ্ট বলে মনে করেন কি না?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: শিক্ষায় তথাকথিত বরাদ্দের বিষয় এখানে নয়। বিষয় হলো, কোন খাতে সরকার বরাদ্দগুলো দিচ্ছে? করোনাকালে সরকার যে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের কথা বলছে, সেখানে ৭০-৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে অ্যান্ড্রয়েড বা স্মার্ট ফোন নেই। বাসায় টেলিভিশন নেই। তাদের অর্থ নাই যে ইন্টারনেটের গিগাবাইট কিনবে। ওয়াইফাই সুবিধা সবখানে নেই। আবার যেখানে ব্রডব্যান্ড রয়েছে সেখানে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সুবিধা নেই। আমরা এই বিষয়ে সার্ভে করেছি। সেখানে এমন ফলাফল দেখা গেছে। এই বিপুল পরিমাণ শিক্ষার্থীর জন্য সরকার কোনো বরাদ্দই রাখেনি। যেহেতু সরকার করোনাকে স্বীকৃতির মধ্যে রাখে না, তাই এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার করণীয় ঠিক করতে পারে না। যেহেতু সমস্যার স্বীকৃতিই নেই। সমাধান আসবে কোথা থেকে! শিক্ষার জন্য কী কী দিল এই প্রশ্নের চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে সরকার শিক্ষার জন্য কিছু দিল কি? পিছিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের জন্য সরকার কী দিল? এই যে মেয়েদের বাল্যবিয়ে হয়ে গেল, তাদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকার কী করল? এটা কি সরকার বলেছে, যে সমস্ত মেয়ে শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়ে গেছে, তারা স্কুলে ফিরলে বেতন মওকুফ করে দেব? তাদের উপবৃত্তির পরিমাণ বাড়িয়ে দেওয়া হবে? বলেনি। তাহলে সরকার শিক্ষার জন্য কী করল এটা বলার আগে আরও ভাবতে হবে। মূল সমস্যাটা হচ্ছে সরকার মহামারীর কারণে দেশের ভেতরে যে মানুষগুলো ল-ভ- হয়ে গেল তাদের চোখে দেখছে না।
দেশ রূপান্তর: প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটটি করোনাকালের দ্বিতীয় বাজেট। স্বাভাবিকভাবেই স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ এগিয়ে থাকার কথা ছিল। হয়েছেও তাই। আগামী অর্থবছর টিকা সফলতার ওপরে নির্ভর করবে বলে মনে করা হচ্ছে। গত অর্থবছরে করোনা মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বরাদ্দ পূরণ করতে পারেনি। তাই এবারের বাজেট নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা অর্জনে আপনার পরামর্শ কী?
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: শুধু টিকা দিলেই তো হবে না। টিকা দেওয়ার পাশাপাশি যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের সেবাটাও দিতে হবে। গত বছরেও স্বাস্থ্য খাতের বাজেট বাস্তবায়নের দিক থেকে সবচেয়ে দুর্বলতম বাজেট ছিল। তারা চারভাগের একভাগ বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা খাত সবচেয়ে পিছিয়ে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরেও তারা তৃণমূল পর্যায়ে হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারেনি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ তৈরি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরেও বাস্তবায়ন না হওয়াটা খুবই হতাশার। তাই স্বাস্থ্য বিভাগকে পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই।
দেশ রূপান্তর: বাজেট নিয়ে আপনার সুনির্দিষ্ট পরামর্শ জানতে চাই।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: পরামর্শ হচ্ছে প্রতি তিন মাস পরপর বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে হবে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে আরও জোরদার নজরদারি করতে হবে। যে সমস্ত এলাকায় কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে, সেসব এলাকার জনসাধারণকে যুক্ত করতে হবে। যাতে করে টাকাগুলো সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না, তার নজরদারি করতে হবে। কাজের মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
দেশ রূপান্তর: অনেক ধন্যবাদ, আপনাকে।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: আপনাকেও ধন্যবাদ।